Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া মুলতানী (রহ.) উত্তর ভারতে যিনি ইসলাম প্রচার করেন

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

(শনিবার প্রকাশের পর)
হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) ও সে সময়কার মুলতানের কাজী (বিচারক) মওলানা শরফউদ্দীন ইস্পাহানী কাবাচা’র এ ষড়যন্ত্রকে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর মনে করেন এবং তারা সুলতানকে অবহিত করার জন্য দুই খানা আলাদা আলাদা পত্র প্রেরণ করেন। ঘটনাচক্রে দুখানা পত্রই সুলতান আলতামাশের পরিবর্তে তার প্রতিপক্ষ কাবাচার হস্তগত হয়ে যায়। পত্রদ্বয় পাঠ করে কাবাচা রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) ও মওলানা শরফউদ্দীনকে গ্রেফতার করার নির্দেশ প্রদান করে এবং দুজনকে তার সামনে উপস্থিত করতে বলে। নির্দেশ অনুযায়ী দুজনকে গ্রেফতার করে কাবাচার সামনে হাজির করা হয়। কাবাচা তার ডান দিকে হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) কে এবং বাম দিকে কাজী শরফউদ্দীনকে বসার নির্দেশ দেয় এবং তাদের লেখা চিঠি দুই খানা দুই জনের হাতে প্রদান করে। কাজী শরফউদ্দীন পত্রখানা পাঠ করে নীরবতা পালন করেন। কাবাচা জল্লাদকে নির্দেশ দেয় এক্ষুনি তাকে হত্যা করা হোক। জল্লাদ অগ্রসর হয়ে তাঁর শিরোচ্ছেদ করে দেয়। যখন শায়খ বাহাউদ্দীনের হাতে তাঁর পত্রখানা প্রদান করা হয়, তখন তিনি দৃঢ় বিশ^াস ও আস্থার সাথে জবাব দেন এবং বলেন, ‘নিশ্চিত এ পত্র আমার। আমি যা কিছু লিখেছি আল্লাহর নির্দেশে সঠিক লিখেছি।’

হজরত শায়খ এর এ সত্য ভাষণ শুনে কাবাচার কম্পন শুরু হয়ে যায় এবং সে ভীত - সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কাবাচা তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তাকে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সাথে বিদায় করে। তাঁর জীবনে এরূপ গুরুত্বপূর্ণ আরো নানা ঘটনা রয়েছে। সোহরাওয়াদীয়া তরিকার প্রধান প্রবর্তক হিসেবে অনেকে তার নাম উল্লেখ করে থাকেন। তাঁর সমকালীন আওলিয়ায়ে কেরামের মধ্যে অনেকের সাথে তাঁর দেখা-সাক্ষাৎ ও যোগযোগ ছিল।
হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) বংশ মর্যাদার দিক থেকেও ছিলেন অতি শরীফ খান্দানের। আরবের শ্রেষ্ঠ গোত্র কোরেশের সাথে তার গোত্রীয় সম্পর্ক ছিল। তাঁর দাদার নাম হজরত কামালুদ্দীন আলী শাহ এবং পিতার নাম মওলানা শায়খ ওয়াজিহ উদ্দীন। তাঁর দাদা কামালুদ্দীন শাহ কোরেশী চেঙ্গীজ খানের যুগে মক্কা হতে খাওয়ারেজমে আগমন করেন এবং সেখান হতে মুলতানে এসে বসবাস আরম্ভ করেন এবং তাঁর নানা মঙ্গলদের হামলায় দেশ ত্যাগ করে হিন্দুস্থানে আগমন করেন। তাঁর নাম মওলানা হোসামুদ্দীন। তিনি মুলতানের নিকট কোটদুর্গে অবস্থান করেন। হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) এর পিতা শায়খ ওয়াজিহ উদ্দীনের জন্ম এখানেই। তিনি তাঁর শ^শুরের সাথে এখানেই বসবাস করতে থাকেন এবং এখানেই হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) জন্ম লাভ করেন।

আল্লাহ তাআলা এ শিশুকে এক অসাধারণ প্রতিভা দান করেন। অল্প বয়সেই তার চারিত্রিক গুণাবলির প্রকাশ ঘটতে থাকে এবং তিনি অন্যান্য শিশুদের জন্য নমুনা হয়ে দাঁড়ান। বারো বছর বয়সে তার পিতা ইন্তেকাল করেন। এবার তিনি অসহায় হয়ে পড়েন এবং নানা বিপর্যয়ের একাই মোকাবিলা করতে থাকেন। তিনি কোরআন হিফজ করেন এবং সাত কেরাতে পারদর্শিতা লাভ করেন। ‘আনওয়ারে গাওসিয়া’ গ্রন্থের বরাতে বলা হয় যে, হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) এর ওয়াজ শ্রবণ করে সিন্ধু, মুলতান ও লাহোরের অসংখ্য লোক ইসলাম গ্রহণ করে, যাদের মধ্যে বহু ধনী ব্যবসায়ী ও কোন কোন শাসকও ছিলেন এবং তারা সবাই হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) এর মুরীদ হন। তাঁর মুরীদদের মধ্যে তাঁর পুত্র শায়খ রোকুনুদ্দীন আবুল ফাতাহ ও শায়খ সদরুদ্দীন আরেফ ইসলাম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। শায়ক রোকুনুদ্দীন সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তাঁর একজন বিশিষ্ট মুরীদ ছিলেন হাকেম শাহ, তিনি প্রথমে মাকরান নামক এলাকার গভর্ণর ছিলেন, পরে সংসার ত্যাগী হয়ে যান এবং শায়খের কাছ থেকে খিলাফত লাভের পর ‘ও”’ ও ‘সাখার’ এর মধ্যবর্তী এলাকায় তবলীগের কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং তার হাতে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করে।

‘ও”’ শরীফের বোখারী সৈয়দদের প্রধান প্রবর্তক সৈয়দ জালাল উদ্দীন মুনীর শাহ, মীরসুর্খ বোখারী এবং সিন্ধুর লাল শাহবাজ কলন্দর ও শায়খ রোকুনুদ্দীন আবুল ফাতাহর কাছে তালীম ও তারবিয়াত লাভ করেছিলেন। শায়খ বাহাউদ্দীনের খলিফা সৈয়দ জালাল মুনীর শাহ মীরসুর্খের জন্মস্থান ছিল বোখারায়। বিভিন্ন স্থান হয়ে ১২৪৪ খৃষ্টাব্দে ও”ে চলে আসেন, তখন তা দেওগঢ় নামে পরিচিত ছিল এবং সেখানে হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগুরু।

বর্ণিত আছে, সেখানে তাঁর আগমনের ফলে ইসলামের রওনক বৃদ্ধি পায়। দেওগঢ়ের রাজা ইসলামের বিরোধিতা করে রাজ্য হারায় এবং এই শহর ইসলামের কেন্দ্রে পরিণত হয়। তিনি পাঞ্জাবেও ‘ঝংসাবালান’ শহর গড়ে তোলেন এবং বহু দিন যাবত সেখানে ইসলাম প্রচারের কাজ অব্যাহত থাকে। রাজপুতদের কয়েকটি গোত্র তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে। এ অঞ্চলে হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) এর অপর এক খলিফা হজরত মুসা-নওয়াব ইসলাম প্রচার করেন। তাঁর হাতে আরো দুইটি গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে।

হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া মুলতানী (রহ.) এর মানবতা, প্রেম, উদারতা এবং দানশীলতার নানা কাহিনী প্রচলিত। একবার তাঁর মুরীদের একটি জাহাজ সাগরে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। তাঁর মুরীদ আরোহীগণ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে তার নিকট রূহানী সাহায্য প্রার্থনা করেন। আল্লাহর অসীম কুদরতে জাহাজ বিপদ হতে রক্ষা পায়। জাহাজে আরোহণকারীদের মধ্যে বড় বড় ব্যবসায়ীও ছিলেন, যারা মণি-মুক্তার ব্যবসা করতেন। জাহাজ যখন নিরাপদে তীরে পৌঁছে যায়, তখন এসব ব্যবসায়ী একমত হয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ মালের এক তৃতীয়াংশ হজরতের খেদমতে পেশ করার অঙ্গীকার করেন এবং ঐ সব ব্যবসায়ীর পক্ষ হতে খাজা ফখরুদ্দীন গিলানীকে তাদের উপহার সামগ্রী পৌঁছানোর দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি যখন নগদ অর্থ, মণি-মুক্তা ও মূল্যবান উপহার সামগ্রী নিয়ে হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) এর খেদমতে হাজির হন এবং হাদিয়া পেশ করেন, তখন তা তিনি গ্রহণ করলেন। কিন্তু নিজের কাছে কিছুই রাখলেন না। তিন দিনের মধ্যে সমস্তই ফকির-মিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। মণি-মুক্তার মূল্য ছিল সত্তর লাখ টাকার সমপরিমাণ। খাজা ফখরুদ্দীন গিলানী এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে এতই বিস্মিত, অভিভূত হয়ে পড়েন যে, তিনি দুনিয়াবী মায়া ত্যাগ করে হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) এর মুরীদানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান এবং তার সমস্ত সম্পদ ফকির-মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। এই খাজা সাহেব পাঁচ বছর হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.) এর খেদমতে (সেবায়) নিয়োজিত ছিলেন। অতঃপর হজ¦ পালন করার উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহ শরীফের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে পথেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকার মহান সাধক উত্তর ভারতে ইসলাম প্রচারকারী হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া মুলতানী (রহ.) শতবছর বয়সে হিজরী ৬৬৬ সালের ১৭ সফর (মতান্তরে ৭ সফর) ইন্তেকাল করেন। মুলতানে তাঁর মাজার অবস্থিত। (সমাপ্ত)

‘আনওয়ারে গাওসিয়া’ গ্রন্থের বরাতে বলা হয় যে, হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.)-এর ওয়াজ শ্রবণ করে সিন্ধু, মুলতান ও লাহোরের অসংখ্য লোক ইসলাম গ্রহণ করে, যাদের মধ্যে বহু ধনী ব্যবসায়ী ও কোনো কোনো শাসকও ছিলেন এবং তারা সবাই হজরত শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রহ.)-এর মুরীদ হন। তাঁর মুরীদদের মধ্যে তাঁর পুত্র শায়খ রোকুনুদ্দীন আবুল ফাতাহ ও শায়খ সদরুদ্দীন আরেফ ইসলাম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম

৩ মার্চ, ২০২৩
২ মার্চ, ২০২৩
১ মার্চ, ২০২৩
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন