চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
পৃথিবীতে মানুষের বসবাস আসলে কতদিন তা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে মানুষের বসবাসের জন্য। পৃথিবীর সব কিছুই সৃষ্টি হয়েছে মানুষের জন্য। মানুষ ছাড়া পৃথিবীর সৌন্দর্য কল্পনা করা যায় না। সৃষ্টির আদি কাল থেকেই মানুষ পৃথিবীকে শাসন করে আসছে। মানুষের জীবন ধারণ ও তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা হয়েছে পৃথিবীর সব কিছু। এককথায় বলতে গেলে যেখানে মানুষ নেই সেখানে অন্যান্য সব কিছুই বৃথা। প্রাচীনকালে মানুষের জীবন যাত্রা ছিলো অনেক কঠিন। বর্তমান সময়ের মত আগুন, পানি, বিদ্যুৎ এর সুবিধা ছিলো না। গাছের চামড়া, লতা পাতা, ফলমুল ইত্যাদি দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হতো। সময়ের ব্যবধানে মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা বেড়েছে। পরিবর্তন হয়েছে মৌলিক অধিকারের। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান একটি গরীর দেশ। গত কয়েক দশকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবর্তন হয়েছে আমাদের দেশের সভ্যতা সংস্কৃতি এবং মানুষের জীবন যাত্রার মানের। দেশের উচ্চ বিত্তদের মৌলিক চাহিদার বাইরেও বেড়েছে বিলাসজাত অভাব। দেশে নাগরিক হিসাবে প্রতিটি মানুষের রয়েছে মৌলিক অধিকার। আমাদের দেশের মৌলিক অধিকার বলতে আমরা সাধারণত অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে বুঝি। এগুলোর কোনটি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না আবার কোনটি ছাড়া বাঁচতে পারলেও বাচার মত বলা যায় না। রাষ্টের নাগরিক হিসাবে তার মৌলিক সকল সকল অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কাজ। আমাদের দেশের কতিপয় নাগরিক এ সকল সুবিধা ভোগ করতে পারলেও অধিকাংশ মানুষের জন্য সহজ ভাবে জীবন পরিচালনা করা কষ্টকর। নাভিশ্বাস অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করতে হিমশিম খাচ্ছে অধিকাংশ পরিবার।
নাগরিক জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের অতিক্রম করতে হচ্ছে মহা সংগ্রাম। খাদ্য, বস্ত্র,শিক্ষা চিকিৎসা মৌলিক অধিকার হলেও আজকাল এ গুলো অত্যন্ত ব্যয় বহুল ।
অনায়াসে বলতে পারি আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কথা। একটি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে যে পরিমাণ আর্থিক ভোগান্তির স্বীকার হতে হচ্ছে তা হয়তো পৃথিবীর অন্য কোন রাষ্টে নেই। যে দেশের প্রতিটি মানুষ মাথাপিছু ঋণ নিয়ে জীবন যাপন কওে সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থা এতটা ব্যয়বহুল হওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত তা আলোচ্য বিষয় নয়। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সরকারীভাবে শুরু হয় প্রাইমারী অর্থাৎ প্রথম শ্রেণি হতে। এর বাইরে মক্তব, কিন্ডার গার্ডেন ইত্যাদির মাধ্যমে অনেকেই শুরু করে থাকে। শুরুর এই পর্যায়টা বর্তমান সময়ে তুলনামুলক অনেক ব্যয়বহুল। সরকারীভাবে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বই সরবারহ করলেও এর বাইরে পরিক্ষার ফি, কোচিং, গাইড ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে গিয়ে অধিকাংশ অভিবাবককেই হিমশিম খেতে হয়। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গুলোর খরচ আরো নির্মম। ভর্তি, বই, খাতা, কলম, বেতন এগুলো ধীরে ধীরে হয়ে গেছে আকাশচুম্বী। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে রয়েছে আলাদা পোষাক। সব কিছু মিলে একটি মোটামুটি ভাল প্রতিষ্ঠানে আদরের সন্তানকে ভর্তি করানো এবং আনুসাঙ্গিক খরচ বহন করতে স্বচ্ছল পরিবারগুলো কিছুটা সামর্থ হলেও আর্থিক ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে অনেক পিতামাতাই পারে না নিজের সন্তানকে ভাল স্কুলে ভর্তি করাতে। আর অনাথ অসহায় বা নি¤œশ্রেনীর পরিবারের জন্য তো এগুলো স্বপ্ন ছাড়া কিছুই না।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র আরো ভয়াবহ। ভাল কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যেন সোনার হরিণ। শুধু ভাল ফলাফল হলেই ভাল কলেজে জায়গা হচ্ছে না মেধাবীদের। গুণতে হচ্ছে বড় অংকের টাকা। ভর্তি ফি, পরিক্ষার ফি সংগ্রহ করতে না পারায় ঝড়ে পড়ে অসংখ্য মেধাবী মুখ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সেশন ফি, পরিবহন ফি, হল গুলোতে সিট ভাড়া বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। মেডিকেল আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যেন ধনী আর উচ্চ বিত্তদের জন্য আশ্রম।
প্রতিবছর দ্রব্য মূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে ভর্তি, বেতনসহ শিক্ষা উপকরণের দাম। অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে কোচিং নামক কিছু কসাই খানা। নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে গড়ে ওঠা এ সকল জায়গায় ছাত্র ও অভিভাবকের নিকট থেকে নেওয়া হয় বড় অংকের অর্থ।
সার্বিকভাবে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট এই সকল ব্যয়ের পরিমাণ দেখে একথা ভাবাই যায় যে বর্তমান সময়ে শিক্ষার মত মৌলিক অধিকার শুধু মাত্র সমাজের উচ্চ শ্রেণির জন্যই শোভা পায়। অনেক সময়ে শুধুমাত্র আর্থিক যোগান দিতে না পারার কারনে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী।
শিক্ষার ন্যায় স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসা আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি। দূ:খ জনক হলেও সত্য যে আমাদের স্বাস্থসেবা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ধনী শ্রেণির জন্য সহনীয় হলেও নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য চিকিৎসা সেবা পাওয়া খুবই দুষ্কর। ক্লিনিক গুলোতে ভাল কোন ডাক্তার দেখাতে দিতে হচ্ছে বড় অংকের ফি। বিভিন্ন প্রকারের টেষ্ট ও পরীক্ষার ফি বহন করা কষ্ট সাধ্য। যদিও বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালে নিয়ম বহির্ভুতভাবে অহেতুক টেষ্ট সহ মাত্রাতিরিক্ত ফি নেওয়ার অভিযোগ প্রায়ই দৃশ্যমান। শহরের ভাল মানের কোন ডাক্তার বা হাসপাতালের সেবা পাওয়া যেন আজকাল স্বর্ণের ডিমের চেয়েও দামী। আবার সমাজের অভিজাত শ্রেণিসহ অনেক রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রায়ই হাসপাতাল গুলো থেকে দেশের বাইরে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয় যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এছাড়াও দেশের অধিকাংশ হাসপাতাল ও ফার্মেসীতে ঔষধের নির্দিষ্ট দামের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগ প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখা যায়। চিকিৎসা খাতের এই যাতাকলে পিষ্ট হয়ে অনেক পরিবার সর্বশান্ত হয়ে যাচ্ছে।
মানুষের বেঁচে থাকার উপাদানগুলোর মধ্যে খাদ্য অন্যতম। খাদ্য ছাড়া আমরা একদিনও চলতে পারি না। অথচ আমাদের দেশের খাদ্য সমাগ্রীর দাম আকাশ চুম্বী। যুগের সাথে দাম বাড়ানোর কিছুটা বাস্তবতা থাকলেও চাল, ডাল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর দাম এখনো সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার উর্ধ্বে। উৎপাদন ও যোগান পর্যাপ্ত থাকার পরও কিছু অসাধু ও স্বার্থন্বেষী ঠিকাদার আর মজুদদারের কারণে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে মানুষের প্রয়োজনীয় সকল খাদ্য সামগ্রীর মূল্য। সিন্ডিকেট ব্যবসার কাছে জিম্মী সকল সাধারণ মানুষ। এছাড়াও খাদ্যে ভেজাল ও অস্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থার কারনে মানুষের জীবনযাত্রার মান বর্তমান সময়ে অনেক বেশি ব্যয়-বহুল ও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্দোগে সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবারহ করা হচ্ছে নানা ভাবে। বৈদ্যতিক সেবার দ্বারা মানুষের জীবন যাত্রা অনেক সহজ হলেও বাসা বাড়ি সহ সব জায়গাতে বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে কয়েক গুণ। এখানে উল্লেখ্য যে, বিদ্যুৎ সরবারহ ও ব্যবহারে এখনও আমরা অনেকটা অনিয়ন্ত্রিত।
এছাড়া রাস্তাঘাটে, যানবাহনে যাতায়াত হয়েছে অনেক কষ্টসাধ্য। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ও অনিরাপত্তার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
মৌলিক অধিকার পেতে যেখানে এত হিমশিম খেতে হয় সেখানে অন্যান্য সুবিধা পেতে গেলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির যেন কোন শেষ নেই।
একটি স্বাধীন ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে সকল ধরণের নাগরিক সুবিধা প্রতিটি মানুষের প্রাপ্য। সুতরাং খাদ্য,ব¯্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সহ সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করণে কার্যকরী ভুমিকা থাকা অপরিহার্য। সবার জন্য শিক্ষা এ কথাটি মুখে মুখে না থেকে ধনী, গরীব, জাতি, ধর্ম -বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যেন সহজে শিক্ষার সুযোগ সমান ভোগ করতে পারে সে ব্যবস্থা থাকা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দ্বার প্রান্তে পৌছে দিতে নানা উদ্দোগ গ্রহণ করা হলেও এটাকে মিতব্যয়ী, সহজলভ্য ও নিরাপদ করে সাধারণ মানুষকে সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
শুধুমাত্র ব্যয়বহুল জীবন যাপনের জন্য মানুষ এখনো রাস্তায় দিনাতিপাত করছে। ডাষ্টবিন থেকে খাবার সংগ্রহ করছে। শুধুমাত্র দাম বেশি বলেই বাবা তার মেয়েকে ভাল পোষাক কিনে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলশ্রতিতে সামান্য একটা পোষাকের জন্য আতœহত্যার মত ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
সর্বপরি মানবজীবন সহজ ও মিতব্যয়িতার মধ্যে রাখতে পারলে সমাজ ও রাষ্ট্রী হতে পারে স্বাবলম্বী ও সুখি সমৃদ্ধ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।