বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
দ্বীন ইসলামে নতুন আবিষ্কৃত পদ্ধতিকে বিদায়াত বলে, বাহ্যিকভাবে শরীয়তের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সাধারণত মানুষ শরয়ী পদ্ধতির মধ্যে যে আশা আকাক্সক্ষা পোষণ করে, সাদৃশ্য থাকার কারণে বেদআতের দ্বারাও সেই আশায় পোষণ করে। এই সংজ্ঞার সাথে জড়িত ইসলামী কতিপয় শব্দাবলীর বিবরণ জানা একান্ত দরকার। যেমন তরিক, তরিকা, সিরাত, ইত্যাদি। এগুলো একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর তা হল ‘আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের পথ চলার পদ্ধতি’। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এই পদ্ধতিকে দ্বীনের সাথে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু দিনের মধ্যেই নতুন গজানো পদ্ধতিকে বিদআত বলে নামকরণ করা হয়েছে।
আমরা দেখেছি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নিত্য-নতুন আবিষ্কারের ফলে বিশ্বের মানুষের মাঝে নতুন নতুন ধরন, পদ্ধতি, রীতিনীতির ব্যাপকতা, ক্রমশই বিস্তৃত হতে বিস্তৃততর হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় অঙ্গনে এর ছোঁয়াচ লাগেনি, এ কথা হলফ করে বলা যায় না। তবে, এ সকল বিষয়ের উপর বিদআতের সংজ্ঞা প্রযোজ্য হয় না। কেননা, পার্থিব ও জাগতিক প্রয়োজনে নতুন আবিষ্কৃত পদ্ধতিকে বিদআত বলা যাবে না। যেমন : নতুন দ্রব্য, নতুন সামগ্রী, নতুন নগর-শহর, নতুন ব্যবহারের পোশাকাদি ও পানীয়-এর আবিষ্কার বিদআত নয়। (আল ইতিসাম : খ- ১ পৃষ্ঠা ১৯)।
এ পর্যায়ে স্বভাবতই একটি প্রশ্ন মনের কোণে উঁকি মেরে ওঠে। তাহলে কী কারণে বেদআতের উদ্ভব হয়? এর উত্তরে বলা যায় যে, একাধিক কারণে বিদআতের জন্ম হয়ে থাকে। যেমন (ক) শরীয়তের বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতা, (খ) মূল শরীয়ত কী এবং এর ব্যবহারিক রূপ কী সে সম্বন্ধে অজ্ঞতা, (গ) শরীয়ত সম্পর্কে উদাসীনতা, (ঘ) নফস ও প্রবৃত্তির আনুগত্য, (ঙ) ধর্মীয় ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও গোঁড়ামি এবং (চ) কাফির ও অবিশ্বাসীদের সাথে মিল রেখে চলা ইত্যাদি।
বস্তুতঃ বেদআতের উল্লেখিত কারণগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে এর মাধ্যমে আরও একটি কারণ বেরিয়ে আসে। তা হল, শরীয়তের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞতা ও মূর্খতা। কেননা, ইসলামের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ধারণাপ্রসূত আনুমানিক অর্থ বের করা ও প্রথম দৃষ্টিতেই চিন্তা-ভাবনা ছাড়া তা গ্রহণ করা ঠিক নয়। এক্ষেত্রে ইসলামের আসলি জিন্দেগী, অবিচলতা ও জ্ঞানের গভীরতা পরিপূর্ণভাবে অনুপস্থিত থাকে। একটু অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে চোখ খুললে দেখা যাবে যে, খারিজীগণ কীভাবে দ্বীন ইসলাম হতে বের হয়ে গেছে। যেমন শিকারের প্রতি নিক্ষিপ্ত তীর ধনুক হতে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যায়, ঠিক তেমনি। আল-ইতিসাম : খ- ২ পৃষ্ঠা ১৫২-১৫৭।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, খেলাফতে রাশেদার যুগ ছিল সুন্নাতের যুগ। তারপর হিজরী প্রথম শতক শতাব্দীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত সুন্নাতের যুগ ছিল। অতঃপর হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীতে বিদআতের আগমন ঘটে। সেই সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে বর্তমান সাহাবায়ে কেরামসহ তৎকালীন সময়ে কেরাম ও বুজুর্গ বিদআতিদেরকে সামগ্রিকভাবে প্রতিরোধ ও প্রত্যাখ্যান করেন। সর্বপ্রথম বিদআত ছিল তাকদির আবিষ্কার করার বিধান। হকপন্থীদের সত্যাশ্রয়ী প্রতিরোধ সত্বেও বিদআতের আবিষ্কার থেমে থাকেনি। খোরাসান, শাম, বসরা ও কুফা হতে মুরজিয়া, খারেজী, রাফেজী, মুতাজিলা, শিয়া, কাদেরিয়া, জাহারিয়া ইত্যাদি দল বা সম্প্রদায়ের উদ্ভাবিত বিদআতসমূহ আত্মপ্রকাশ করে। মদিনা-মুনাওওয়ারা ইলমে নববীর কেন্দ্র ছিল বিধায় সংরক্ষিত ও বিমুক্ত ছিল। তারপরও ‘হারুয়া’ নামক স্থানটি খারেজীদের মাটিতে পরিণত হয়েছিল। (শরহে আকিদায় সিফারানিয়্যাহ : খ- ১ পৃষ্ঠা ৭১)।
উপরোক্ত বিষয়টিকে আরো খোলাসা করে ‘আকদাতুল হানাফিয়া’ গ্রন্থের ২৯ পৃষ্ঠায় এবং ‘আল-ইরশাদ ফী সহীহিল ইতিকাদ’ গ্রন্থের ২৯৬ - ২৯৭ পৃষ্ঠায় এভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ‘তৎকালীন বড় বড় শহর যেখানে রাসূলুল্লাহ সা. এর সাহাবাগণ অবস্থান করতেন এবং যেখান হতে ঈমানও চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তা ছিল পাঁচটি। তা হল, দুই হারাম- মক্কা ও মদিনা। দুই ইরাক-বাগদাদ ও কুফা। এক শাম অর্থাৎ সিরিয়া। এই শহরগুলোতেই কুরআন, হাদিস ও ইসলামের অনুকরণীয় সকল বিষয়ের জ্ঞান বিস্তৃতি লাভ করেছিল। তন্মধ্যে একমাত্র মদিনা-মনোয়ারা ছাড়া অন্যান্য শহরগুলো হতে মূল বিদাআদীদের উদ্ভব ঘটেছিল। মুরজিয়া মতবাদ কুফা হতে বের হয়ে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল। কাদেরিয়া ও মুতাজিলা সম্প্রদায় বসরা হতে আত্মপ্রকাশ করে সব দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর জাহামিয়াদের বিকাশ ঘটে খোরাসানের আশপাশ হতে। তারা ছিল নিকৃষ্টতম বিদআতি দল। কুফায় শিয়াগণ ও মুরজিয়াগণ, ও বসরায় মুতাজিলা সম্প্রদায় প্রকাশ্যে নিজেদের মতবাদ প্রচার করে বেড়াতো। হযরত ওসমান গনি রা. এর শাহাদাতের পর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন দলের উৎপত্তির সাথে সাথে হারুরিয়্যাদের আত্মপ্রকাশ করে। তবে মদিনা শরীফ বিদআত হতে মুক্ত ও পবিত্র ছিল। বেদাতিদের যে সকল লোক সেখানে ছিল, তারা ছিল গোপনে লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত অবস্থায়। তারা নিজেদেরকে প্রকাশ করতে পারত না। এই নিরিখে একথা সহজেই বলা যায় যে, এ সবগুলোই হচ্ছে বাতিল-ফিরকা, যারা প্রকৃতই পথভ্রষ্ট, বিভ্রান্ত এবং ইসলামের মূলে কুঠারাঘাতকারী। সুতরাং তাদের থেকে দূরে থাকা এবং সাবধানতা অবলম্বন করা ঈমানদারদের একান্ত কর্তব্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।