পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের অকাম এবং কুকাম বলে শেষ করা যাবে না। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সালের অগাস্ট পর্যন্ত ১২ বছর ১ মাসে তারা যেসব অপর্কম এবং অপরাধ করেছে সেগুলোর ফিরিস্তি বানালে একটি মহাকাব্য রচনা করতে হবে। সেটি অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আজ আমরা ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর অপকর্ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কয়েকটি নজির তুলে ধরবো। প্রসঙ্গত আমরা বলতে চাই যে, যেসব তথ্য নিচে তুলে ধরা হবে সেগুলি আমাদের বা দৈনিক ইনকিলাবের নিজস্ব কোনো তথ্য নয়। গত রবিবার ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার সবগুলি জাতীয় দৈনিকে শোভন ও রাব্বানীর অপসারণের খবর ছাপা হয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসে তাদেরকে ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট এবং সাধারণ সম্পাদক বানানো হয়। তারা তাদের পদে ছিলেন মাত্র ১৪ মাস। এই ১৪ মাসেই তাদের কুকীর্তি সম্পর্কে কোনো কোনো কাগজে তথ্যবহুল সংবাদ ছাপা হয়েছে। বক্ষমান নিবন্ধে সেই সব অপকীর্তির কিছু কিছু তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে।
(১) একটি বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকে এই মর্মে রিপোর্ট করা হয়েছে যে, ২০১৭ সালের ৬ জুলাই মাদক ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে পুলিশ ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট রেজওয়ানুল হোক চৌধুরী শোভনকে গ্রেফতার করে। ভবিষ্যতে আর এমন অপকর্ম করবো না, এই মর্মে মুচলেকা দিয়ে তিনি ছাড়া পান।
(২) বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ছাত্রলীগের একটি অফিস রয়েছে। ঐ অফিসে অতি সম্প্রতি বেশ কিছু ফেনসিডিল পাওয়া গেছে।
(৩) গত ১ বৈশাখ নববর্ষের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শোভনের নির্দেশে অনুষ্ঠানের যন্ত্রপাতি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কারণ ঐ অনুষ্ঠানের একটি হিস্যা শোভনকে দেওয়া হয়নি।
(৪) শোভন এবং রাব্বানী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের শাখা গঠন করে গত ১৩ জুলাই। এই শাখার সাধারণ সম্পাদক করা হয় রকিবুল হাসানকে। রকিবুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করার বিনিময়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাব্বানী ৪০ লক্ষ টাকা গ্রহণ করে। এ সম্পর্কে রকিবুলকে প্রশ্ন করা হলে সে বলে, ৪০ লক্ষ টাকা কোনো ব্যাপার নয়। কারণ এর পর সে এর দ্বিগুণেরও বেশি টাকা কামাই করবে। এ সম্পর্কে তাদের মধ্যে যে কথোপকথন হয় তার টেপ ঐ ইংরেজি দৈনিকের কাছে রয়েছে বলে পত্রিকাটি গত ১৫ সেপ্টেম্বরের রিপোর্টে দাবি করে।
(৫) ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারি হওয়ার আগে শোভন এবং রাব্বানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি হওয়ার পর তারা হাতিরপুল বা তার আশে পাশের এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া করেন। শোভনের ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ছিল ৭০ হাজার টাকা এবং রাব্বানীর ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ছিল ৪০ হাজার টাকা।
(৬) ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারি হওয়ার আগে তারা রিকশা বা সিএনজিতে যাতায়াত করতেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট-জিএস হওয়ার পর তারা দুজনেই দুটি ব্র্যান্ড নিউ নোয়া মাইক্রোবাসে চলাচল শুরু করেন। এসব মাইক্রোবাসের এক একটির মূল্য ২০ লক্ষ টাকার ওপর।
(৭) এর আগে ডাকসুর জিএসের রুমে কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছিল না। কিন্তু রাব্বানী জিএস হওয়ার পর তার কক্ষে এসি চালু করেন বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বসান।
(৮) প্রেসিডেন্ট এবং জিএস হওয়ার পর শোভন এবং রাব্বানী ঢাকা বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতেন। যেহেতু তারা ভিআইপি লাউঞ্জে সদলবলে ঢুকতেন তাই তাদের ছাত্র বা অন্যান্য অনুসারীরাও ঐ লাউঞ্জের টারমাকে ভিড় জমাতেন।
(৯) বাংলাদেশের একটি অতিকায় কর্পোরেট হাউজের বাংলা দৈনিকে গত শনিবার রিপোর্ট করা হয়েছে যে, মাদক সেবন, চাঁদাবাজি এবং অস্ত্রবাজির অভিযোগে তাদেরকে ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ও জেনারেল সেক্রেটারির পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে।
(১০) তবে ধারণা করা হচ্ছে যে, যে অভিযোগে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের ওপর অপসারণের খড়গ নেমে এসেছে সেটি হলো জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের অভিযোগ। ভিসি অভিযোগ করেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প অর্থাৎ ১৪ হাজার ৪৫ কোটি টাকার ৪ থেকে ৬ শতাংশ চাঁদা হিসাবে শোভন এবং রাব্বানী দাবি করেছিলেন। উল্লেখ্য, ১৪৪৫ কোটি টাকার ৪ শতাংশ হয় ৬৬ কোটি টাকা এবং ৬ শতাংশ হয় ৮৬ কোটি টাকা। গত মঙ্গলবার ১০ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফারজানা ইসলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে এই অভিযোগ করেন।
(১০) অন্যদিকে ছাত্রলীগের নেতারা দাবি করেন যে, ভিসি উন্নয়ন প্রজেক্ট থেকে ইতোমধ্যেই তাদেরকে ১ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু এই অংকে তারা সন্তুষ্ট নন। তারা আরো বেশি চান। বেশি টাকা দেননি বলে গত শনিবার পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলছে।
এখানে আমরা একটি কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই। ভিসি অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে, আর ছাত্রলীগ অভিযোগ করেছে ভিসির বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের কোনটি সত্য আর কোনটি সত্য নয় সে সম্পর্কে আমাদের নিজস্ব কোনো মন্তব্য নাই। একমাত্র বিচার বিভাগীয় তদন্তই এই ধরনের গুরুতর অভিযোগের সত্যাসত্য খুঁজে বের করতে পারে।
দুই
এটাতো গেলো কেলেঙ্কারির একটি দিক। কেলেঙ্কারির অপর পৃষ্ঠায় রয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফারজানা ইসলাম, তার স্বামী ও তার পুত্র। মাঝখানে রয়েছে কনস্ট্রাকশন কন্ট্রাক্টর। অপর একটি ইংরেজি দৈনিকের বরাতে ভিন্ন খবর পাওয়া যাচ্ছে। ঐ পত্রিকার ১৫ সেপ্টেম্বর ‘‘New Age Youth’’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধের নাম ‘Jahangirnagar against corruption..’ লেখক নাহিদ রিয়াসাত। এই নিবন্ধে বলা হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি ছাত্রী হল নির্মাণের জন্য প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে গাছ কাটা অন্যতম। কিন্তু ছাত্রলীগ এসব গাছ কাটায় বাধা দেয়। এই সময় এই খবরটি ফাঁস হয় যে, নির্মাণ কাজে বাধা না দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রলীগের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটকে ইতোমধ্যেই ২ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছে। খবরে বলা হয় যে, গত ৮ অগাস্ট ভিসি ফারজানা ইসলাম ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে স্থির হয় যে, এই বিশাল অর্থ ছাত্রলীগের মাঝে কীভাবে বণ্টন করা হবে। এই সভায় ভিসির স্বামী এবং তার পুত্রও উপস্থিত ছিলেন। কারণ তার স্বামী এবং পুত্রই নাকি ঠিকাদারের সাথে যোগাযোগের সেতুবন্ধন ছিলেন। রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, ছাত্রলীগের সাথে ভিসির যে ডিল হয় সেটি ছিল ৬ কোটি টাকার। যে ২ কোটি টাকা দেওয়া হয় সেটি ছিল ৬ কোটির প্রথম ইনস্টলমেন্ট। অবশিষ্ট ৪ কোটিও সমান কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে।
আলোচ্য ইংরেজি দৈনিকটি অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছে যে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের ৩টি উপদল রয়েছে। একটির নেতা হলেন প্রেসিডেন্ট জুয়েল রানা, অপরটির নেতা হলেন জেনারেল সেক্রেটারি আবু সুফিয়ান চঞ্চলের এবং তৃতীয়টির নেতা হলেন জয়েন্ট সেক্রেটারি সাদ্দাম হোসেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়ামুল হাসান তাজ। প্রথম দুইটি উপদল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট শোভনের অনুসারী। আর পরেরটি হলো সেক্রেটারি রাব্বানীর অনুসারী। ঐ সভায় স্থির হয়েছিল যে, ঐ ২ কোটি টাকা প্রথম দুইটি উপদলের মধ্যে ফিফটি ফিফটি হিসাবে বণ্টন করা হবে। কিন্তু পরদিন অর্থাৎ ৯ অগাস্ট ইকুয়েশনটি বদলে যায়। কারণ তৃতীয় উপদলটি ভিসির সাথে বৈঠকে বসে এবং তারা অর্ধেক অর্থ দাবি করে। তারা কারণ দেখায় এই যে তারা কেন্দ্রীয় জেনারেল সেক্রেটারি রাব্বানীর গ্রুপ। পরে ঠিক হয় যে জুয়েল রানা গ্রুপ পাবে ৫০ লাখ টাকা এবং অপর দুই গ্রুপ পাবে ২৫ লাখ টাকা করে। কারণ ঈদের আগেই ঈদের ‘সালামি’ হিসাবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রে ১ কোটি টাকা পাঠানো হয়েছে।
তিন
এসবের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের দাবি, প্রস্তাবিত ১০ তলা ভবনের স্থান পরিবর্তন, দুর্নীতির অভিযোগের বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং নতুন গৃহীত মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষকরাও বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রায় ৫০ জন শিক্ষক দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত দাবি করে ক্লাস নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। আর একটি দল হলো ভিসি ফারজানা ইসলামের নেতৃত্বাধীন দল। গত ১১ তারিখে প্রফেসর এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে বিশিষ্ট নাগরিকরা দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত দাবি করে একটি বিবৃতি দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। গত মার্চ মাসে কোনো রকম এ্যাডমিশন টেস্ট বা ভর্তির বিজ্ঞাপন ছাড়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৪ জন ছাত্রকে ব্যাংকিং এবং ইনস্যুরেন্স বিভাগে ভাইস চ্যান্সেলরের সরাসরি নির্দেশে ভর্তি করা হয়। অবৈধভাবে ভর্তি হওয়া এই ৩৪ ছাত্রের মধ্যে ৮ জন ইতোমধ্যেই ডাকসুর তথাকথিত নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ইউনিটের নিকট থেকেও শোভন ও রাব্বানী চাঁদা দাবি করেছিল। গত জুলাই মাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়ে গেছে। অথচ তারপর প্রায় আড়াই মাস পার হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি গঠন করা হয়নি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দ শোভন ও রাব্বানীর কাছে গেলে তারা বলে যে যখন সোহাগ ও নাজমুল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিল তখন তোরা অর্থাৎ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ মাসে মাসে টাকা দিতিস। এখন বল মাসে মাসে আমাদেরকে কত দিবি?
এই হলো ছাত্রলীগের সংক্ষিপ্ত কাহিনী। এছাড়াও রয়েছে হত্যা, খুন এবং রাহাজানির কাহিনী। বিগত প্রায় ১২ বছরে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। শুধু মাত্র কমিটি থেকে বহিষ্কার করলেই কি এই কোটি কোটি টাকা লোপাটের শাস্তি হয়ে গেলো? এই ১২ বছরে তো শোনা যায়নি যে চাঁদাবাজি এবং কোটি কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের জন্য কোনো ছাত্রলীগ নেতার জেল বা রিমান্ড হয়েছে। ২ কোটি টাকার তথা কথিত আত্মসাতের অভিযোগে বেগম জিয়া ১০ বছরের জেল খাটছেন। আর ছাত্রলীগের বেলায়? একমাসও নয়? তবে কথায় বলে, এক মাঘে শীত যায় না। শুধু ছাত্রলীগ নয়, আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যক্তিদের শত শত নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের বিস্তারিত খবরও বেরিয়ে আসবে। এই সরকার তাদের বিচার করতে না পারে, কিন্তু জনতার আদালতে একদিন তাদের বিচার হবেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।