চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ইলম এমন একটি নূর যা অন্তরকে আলোকিত করে। ইলম শিক্ষা করাকে প্রতিটি নারী-পুরুষের উপর ফরজ করা হয়েছে। ইলম অর্থ জ্ঞান, বিশ^াস, কোন জিনিসকে ভাল ভাবে তথ্য সহকারে জানা।
শরীয়তের দৃষ্টিতে ইলম তাকেই বুঝায়, যে ইলম কোন নবী-রাসূলের দ্বারা আল্লাহ পাকের নিকট থেকে পাওয়া যায়। মানুষের বুদ্ধি-বিবেক সে ইলম আবিষ্কার করতে পারে না। আল্লাহ প্রদত্ত ইলম এর নাম তৌহিদী ইলম, যা অন্তরে আল্লাহ-ভীতি সৃষ্টি করে। আলেম অর্থ জ্ঞানী। শরীয়তের দৃষ্টিতে কোরআন, হাদীস এবং শরীয়তের হুকুম-আহকাম, সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। অর্থাৎ তৌহিদী ইলম এর অধিকারী।
দুনিয়াবী ইলম যিনি জানেন তাকেও আরবী ভাষায় আলেম বলা হয়। যেমন বলা হয় আলেমুল হেকমাত। অর্থাৎ বিজ্ঞানী, আলেমুশ শারিয়াহ, শরীয়তের আলেম ইত্যাদি। তবে আলেমের অর্থ এই নয় যে, কোন বিষয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হতে হবে। আপনি যতটুকু জানেন ততটুকুর জন্য আপনি আলেম। এই যে আমি আপনাদের সামনে প্রতি শুক্রবার জুমআর পূর্বে কোরআন হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করছি, আপনারা ধৈর্য সহকারে শুনছেন, আমি যে কথাগুলো বলছি এগুলো আপনারা জেনে গেছেন, কাজেই আপনারা এই কথাগুলোর আলেম।
আমি আপনাদের সামনে অত্যন্ত সংক্ষেপে বিশেষ প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরছি। সেগুলো আপনাদের জানা অত্যন্ত জরুরী। কারণ, না জানলে আমল করবেন কি করে? জানাটা আগে ফরজ। এর পরে কাজে পরিণত করা। যেমন- আপনি নামাজ পড়বেন। নামাজের পূর্বে আপনাকে অজু করতে হবে, তখন আপনাকে জানতে হবে অজু কি এবং কিভাবে অজু করতে হয়। কারণ অজু ছাড়া নামাজ হবে না। আল্লাহকে ভয় করতে হলেও আপনাকে জানতে হবে আল্লাহ কে, আল্লাহর কি ক্ষমতা, আল্লাহ পাক কি করতে পারেন। এ কথাগুলো জানা থাকলে আপনার অন্তরে আল্লাহ-ভীতি সৃষ্টি হবে। তখন আপনি আল্লাহ পাকের কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চেষ্টা করবেন। আর যদি তাঁর সম্পর্কে আপনি কিছুই না জানেন তাহলে কেন আপনি তাকে ভয় করবেন? তাই আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কোরআনকে নাযিল করেছেন। জ্ঞান অর্জনের কথা দিয়ে অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন কর। আর রাসূলে পাক (সা:) বলে দিয়েছেন যে, “জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি নর-নারীর উপর ফরজ।”
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ওলামায়ে কেরাম বলেছেন যে, ইলম ততটুকু জানা ফরজ, যেটুকু না জানলে আল্লাহ পাককে চেনা যায় না। তাঁর ইবাদত করা যায় না। কারণ আল্লাহ পাক মানুষ এবং জিন জাতিকে একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন।
আমি আমার এই আলোচনার দ্বারা এটি বুঝাতে চেষ্টা করেছি, যাতে আপনারা আল্লাহ পাক সম্পর্কে জানতে পারেন। তাঁর রাসূলদের সম্পর্কে জানতে পারেন। ইবাদত অর্থাৎ নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত সম্পর্কে জানতে পারেন। এসব ইবাদত কখন করতে হবে, নিয়ম পদ্ধতি যা না জানলে ইবাদতই হবে না। আর ইবাদত না হলে আল্লাহ পাকের দরবারে ‘মুজরিম’ হিসেবে হাজির হতে হবে।
আমি আরও চেষ্টা করছি আপনাদের সামনে সঠিক ইসলামকে তুলে ধরতে। কোরআন হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করতে। কারণ আজকাল দেশটা ভণ্ড আলেমে ভরে গেছে। পোশাকে আলেম, কিন্তু ভিতরে কোরআন হাদীসের ইলম নেই, তাদের অধিকাংশই কোরআন হাদীস জানে না। কোরআন হাদীসের অপব্যাখ্যা করে। মানুষ তাদের অপব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।
প্রকৃত আলেমের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল, জনগণের সামনে কোরআন হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা। অকপটে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে সংগ্রাম করা।
রাসূলে পাক (সা:) বলেছেন; “অত্যাচারী শাসনকর্তার সামনে সত্য কথা বলাই উত্তম জিহাদ। সত্যিকারের মুমিন কখনও সত্য বলতে ভয় পায় না। সত্যের প্রতিরক্ষায় দ্বিধাহীন চিত্তে এগিয়ে যায়।”
মুমিন যেখানে অন্যায় দেখবে, অত্যাচার উৎপীড়ন দেখবে, মানবতা বিপন্ন হতে দেখবে, সেখানেই শাসকের বিরুদ্ধে, শোষকের বিরুদ্ধে, জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে যাবে।
আমি একজন আলেম হিসেবে আপনাদের সামনে আমার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। কারণ আমি জানি সঠিকভাবে এই দায়িত্ব পালন না করলে কিয়ামতের দিন আমাকে জবাবদিহী করতে হবে। আর এই জবাবদিহিতার ভয়েই আমি শত কাজ ফেলেও আপনাদের সামনে হাজির হই। রাসূলে পাক (সা:) বলেছেন; “সত্য কথা বলতে যারা নির্বাক থাকে অথবা ভয় পায়, তারা বোবা শয়তান সমতুল্য।
এ পর্যায়ে আমি হযরত আবু হানিফা (রহ:) যিনি আমাদের ইমাম, ইমামে আজম, তিনি কিভাবে সত্য কথা বলতেন এবং সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শাসক দ্বারা কিভাবে নির্যাতিত হয়েছেন তা উল্লেখ করছি।
একবার হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ:) এর নিকট খলিফা লোক পাঠিয়ে প্রধান কাজীর পদ গ্রহণ করতে অনুরোধ জানালেন। হযরত আবু হানিফা (রহ:) জিজ্ঞেস করলেন যে, “আমি প্রধান কাজীর পদ গ্রহণ করে যে বিচার করব, তা কি সঠিকভাবে করতে পারব? কোরআন হাদীসের আলোকে করতে পারব? ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারব? নাকি খলিফার কথা অনুযায়ী চলতে হবে, তাঁর হুকুমে বিচার করতে হবে, নিরপরাধীকে শাস্তি দিতে হবে এবং অপরাধীকে ছেড়ে দিতে হবে।” তখন তিনি বললেন, “হুজুর আপনি বুঝতেই তো পারছেন, বাদশাহর হুকুম অমান্য করা কি কারো পক্ষে সম্ভব হবে? তিনি যেভাবে বলবেন সে ভাবেই তো কাজ করতে হবে, বিচার করতে হবে।” তখন ইমাম আবু হানিফা (রহ:) বললেন, “আমার দ্বারা এ পদ গ্রহণ করা সম্ভব না। আমি কোরআন হাদীসের বাইরে কোন ফয়সালা দিতে পারবো না, সত্য কখনও গোপন করতে পারবো না, আর এতে করে বাদশাহর মনের ইচ্ছে পূর্ণ হবে না। আমি এ পদ গ্রহণ করতে পারব না। বাদশাহকে আমার অপারগতার কথা জানিয়ে দেবেন।”
খলিফা এ কথা শুনে অত্যন্ত রেগে গেলেন এবং হযরত আবু হানিফা (রহ:) কে বন্দি করে জেলে ঢুকিয়ে দিতে হুকুম দিয়ে দিলেন। খলিফার হুকুম পেয়ে তার পুলিশ বাহিনী তাই করল।
হযরত আবু হানিফা (রহ:) জেলে যেতে রাজি হলেন কিন্তু প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। এটিই হল একজন শরীয়তের আলেমের কর্তব্য। কারণ, আলেম যদি সত্য কথা বলতে ভয় পায়, আলেমের যদি পদস্খলন ঘটে তা হলে সমাজে ন্যায়-নীতি বলে কিছু থাকবে না।
রাসূলে পাক (সা:) কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলো, “সর্বাপেক্ষা মন্দ লোক কে?” রাসূলে পাক (সা:) বললেন, “মন্দ লোক সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা কর না, বরং আমাকে ভাল লোক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কর।” এ কথাটি তিনি তিনবার বললেন, অত:পর বললেন, “জেনে রেখ, সর্বাপেক্ষা মন্দ লোক হচ্ছে আলেমদের মধ্যে যারা মন্দ। এভাবে সর্বাপেক্ষা ভাল লোক হচ্ছে আলেমদের মধ্যে যারা ভাল। এর অর্থ মানুষ আলেমদের অনুকরণ ও অনুসরণ করে। আলেমগণ যখন মিথ্যার আশ্রয় নেন, সত্য গোপন করেন, মানুষ তখন স্বাভাবিক ভাবেই বিপথগামী ও অসৎ হয়ে যায়।
যে আলেম মানুষের মন যুগিয়ে কথা বলে, নেতা অখুশী হবে বলে মিথ্যার আশ্রয় নেয়, সে আলেম সম্পর্কে আল্লাহর নবী বলেন, “তার চেয়ে মন্দ ও নিকৃষ্ট এ বিশে্ব আর কেউ নেই। সে হল সর্বাপেক্ষ নিকৃষ্ট লোক।” অন্য এক হাদীসে আছে, হযরত আবু দার্দা (রা:) বলেন, “কিয়ামতের দিন মর্যাদার দিক দিয়ে আল্লাহ পাকের নিকট সর্বাপেক্ষা মন্দ বা নিকৃষ্ট ব্যক্তি সেই হবে যে তার ইলম দ্বারা উপকৃত হতে পারেনি।”
হযরত জিয়াদ ইবনে যুবাইর (রা:) বলেন; একদিন হযরত ওমর (রা:) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইসলামকে কিসে ধ্বংস করবে বলতে পার?” তখন তিনি বললেন, “আলেমদের পদস্খলন, মোনাফেকদের আল্লাহ পাকের সাথে বিশ^াস ঘাতকতা।”
(আলহাজ¦ মাওলানা এম.এ.মান্নান (রহঃ) এর রচনাবলী হতে সংগৃহীত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।