পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
করোনাভাইরাসের মধ্যেই বছর ঘুরে এসেছে পবিত্র রমজান মাস। সিয়াম সাধনার এ মাস তামাম দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য ইবাদতের বিশেষ মৌসুম। এ মাসে পাল্টে যায় সারা দুনিয়ার মুসলমানদের যাপিত জীবন। খাওয়া-দাওয়া চলাফেরায় আসে ব্যাপক পরিবর্তন। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে টানা লকডাউনে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ে গেছে বাংলাদেশের আলেম সমাজ। বিশেষ করে কওমি মাদরাসাগুলোয় পড়–য়া হতদরিদ্র কয়েক লাখ ছাত্রছাত্রী চরম বেকায়দায় পড়ে গেছেন। এরা সাধারণ স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ধনী ঘরের শিক্ষার্থীদের মতো নয়। মূলত এরা গরীব ঘরের হতদরিদ্র সুবিধাবঞ্চিত সমাজের মানুষের সন্তান। সাধারণত গরীর ঘরের ছেলেমেয়েরাই কওমি মাদরাসায় পড়ে থাকেন। এ সব মাদরাসা মূলত স্থানীয় সাহায্য, অনুদান ও কিছু শিক্ষার্থীর বেতনের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। দারুল উলুম দেওবন্দের রীতিনীতি অনুসরণকারী মাদরাসাগুলোতে সরকার কোন সহায়তা দেয় না। করোনার এই ১৩ মাসে এসব মাদরাসা পড়–য়া হতদরিদ্র শিক্ষার্থীরা পড়ে গেছেন দুর্বিসহ অবস্থায়।
কওমি মাদরাসায় বহু শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যুগের পর যুগ ধরে কওমি মাদরাসাগুলো এভাবে চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই বেশিরভাগ মাদরাসা ছুটি ঘোষণা করা হয়। কিছু কিছু মাদরাসা খোলা ছিল। তবে লকডাউন শুরু হলে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজ বাড়ি বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে চলে গেছেন। যেখানেই যান তারা নিদারুণ কষ্টে দিন যাপন করছেন। বিশেষ করে যাদের পিতামাতা নেই এবং লিল্লাহ বোর্ডিং এ থেকে লেখাপড়া করেন তাদের অবস্থা করুন। সরকারি দান-অনুদান কিছুই তাদের ভাগ্যে জোটে না। আবার করোনার কারণে রমজান মাসে তাদের যে আয়ের উৎস তা বন্ধ।
সরকারি হিসাবে জানা যায়, বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৯৭টি। পড়ালেখা করেন ১৪ লাখ শিক্ষার্থী। তবে কওমি সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন সারা দেশে মাদরাসার সংখ্যা আরো বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানে ২০ থেকে ২২ লাখের বেশি গরীব মেধাবী শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন। এসব মাদরাসার অধিকাংশতেই লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থেকে এতিম ছাত্ররা পড়ে থাকেন। কেউ কেউ মাসিক বেতন ও খাওয়া থাকার টাকা দিয়ে পড়েন। কওমি ও নূরানী মাদরাসার বেশির ভাগেরই নির্দিষ্ট আয়ের কোনো উৎস নেই। সমাজের দানশীল ব্যক্তি ও বিত্তবানরা সহায়তা করেন। আবার মাদরাসার অনুদানের সবচেয়ে বড় অংশটি আসে রমজান মাসে নানা সহায়তা আর ঈদুল আজহার কোরবানির চামড়া থেকে। গত বছর রমজান মাসে লকডাউন গেছে। মাদরাসার হতদরিদ্র শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা পায়নি। ঈদুল আহজার কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে চলছে ভয়ঙ্কর কান্ড। আগের কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগের স্থানীয় নেতারা নিজ নিজ এলাকায় চামড়া জোর করে সংগ্রহ করে বিক্রি করতো। এখন ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছে। গত ঈদে লাখ লাখ চামড়া মাটির নীচে পুঁতে ফেলা হয়েছে। ফলে কোরবানির পশুর চামড়া থেকে সারা দেশের কওমি মাসরাসার গরীব শিক্ষার্থীরা কোনো অর্থ পায়নি। আবার এই বছর রমজানে লকডাউনের ফলে বেশিরভাগ মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় মাদরাসাগুলোরও আয় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কোনো কোনো পরিচালনা করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। আর যেসব গরীব-দুঃখী ছাত্র লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থেকে পড়াশোনা করেন তাদের পড়াশোনা দূরের কথা থাকা খাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে জামিয়া ইমদাদিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা কবির আহম্মদ আড়াইহাজারী বলেন, করোনা এবং লকডাউনে কওমি মাদরাসাগুলো মারাত্মক সমস্যায় পড়ে গেছে। মাদরাসা পরিচালনার জন্য রমজান মাস ও ঈদুল আযহার পশুর চামড়া ছিল আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু সেগুলো করোনার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। করোনার কারণে গত বছর সরকার ৮ কোটি টাকা কওমি মাদরাসায় অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। কারা কারা পেয়েছেন জানি না। আবার কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) সে সময় কিছু মাদরাসায় সহায়তা দিয়েছে। এবার কেউ সহায়তা দিচ্ছে বলে শুনিনি। সরকারের এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। একই সঙ্গে কওমি মাদরাসার হেফজ মাদরাসাগুলো চালু করা উচিত।
জানা যায়, কওমি মাদরাসার গরীব ছাত্ররা মাদরাসার আয়ের পাশাপাশি নিজেরাও প্রতিবছর রমজান মাসে ওয়াজ নছিহত করে আয় রোজগার করে থাকেন। কেউ তারাবিহ নামাজে ইমামতি করে আয় করেন। কেউ অন্যভাবে রোজগার করেন। লকডাউনের কারণে সেটাও বন্ধ রয়েছে। বেশ কয়েকটি কওমি মাদরাসার শিক্ষকরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে লকডাউন শুরু হওয়ার পর তাদের মাদরাসার আয় তলানিতে নেমে গেছে। ১৩ মাস থেকে করোনায় অনেক লিল্লাহ বোর্ডিং বন্ধ করতে হয়েছে। অর্থের অভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানই শিক্ষকদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছে না। এক সঙ্গে কয়েক মাসের বেতন বাকি রয়েছে হাজার হাজার মাদরাসায়। অথচ ওই সব মাদরাসার অনেক শিক্ষক হেফাজত করায় তাদের গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে গণদলের চেয়ারম্যান এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী বলেন, কওমি মাদরাসার ছাত্ররা সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি ও মাথায় টুপি পড়ে রাস্তায় বের হলে সে দৃশ্য দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। করোনাকালে এই ছোট্ট ছোট্ট শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের উচিত কিছু বরাদ্দ দেয়া। কওমি মাদরাসাতে যারা পড়েন তারা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত। এদের পাশে সরকারের যেমন দাঁড়ানো উচিত; তেমনি সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসা উচিত। কওমি মাদসারা ছাত্রদের সহায়তা করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। তারা দেশের নাগরিক হিসেবে অন্য মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মতো সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না।
ঢাকার একাধিক মাদরাসায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাভাইরাসে সবকিছু বন্ধ থাকায় ছাত্রদের নিয়ে দূর্বিসহ অবস্থায় পড়েছে ওই সব মাদরাসা। অর্থের অভাবে অনেক মাদরাসায় হতদরিদ্র ছাত্রদের লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে রাখাই কঠিন হয়ে গেছে। এতিম ছাত্রদের খাওয়ার খরচ হিসেবে আগে নানাভাবে অর্থ এলেও দীর্ঘদিন মাদরাসাগুলোর আয় রোজগার নেই। করোনাভাইরাসে অনেক প্রতিষ্ঠান সঙ্কটে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছে না, চালাতে পারছে না। আগে যে ব্যবসায়ী, সমাজের দানশীল ব্যক্তিরা মাদরাসায় সাহায্য সহযোগিতা করতেন, তাদের ইচ্ছা থাকলেও এখন সেভাবে দান-খয়রাত করতে পারছেন না। এ অবস্থায় সরকারের উচিত কওমি মাদরাসার ছাত্রদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া।
জানতে চাইলে রাজধানীর শান্তিনগর মসজিদের খতিব ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা রুহুল আমিন বলেন, রোজা হলো ফজিলতের মাস। আল্লাহ বলেছেন রমজান মাসে বেশি বেশি দোয়া করলে তিনি কবুল করেন। কওমি ও নূরানী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা রমজানে রোজা, ইবাদত বন্দেগির পর আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করেন। করোনা মহামারীতে মাদরাসার এতিম শিক্ষার্থীরা রোজা রেখে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইলে আল্লাহ তা কবুল করবেন। এখন আলেম-মসজিদের ইমামরা গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে থাকেন। ইমাম-মুয়াজ্জিনরা মসজিদে যেতে ভয় পান। রমজানে এ অবস্থায় ইবাদত বন্দেগি কেমন হবে? তিনি আরো বলেন, কওমি মাদরাসায় হতদরিদ্র, ছিন্নমূল ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করেন। এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনায় সবকিছু বন্ধ। সরকার থেকে তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া উচিত। সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। কওমিতে পড়াশোনা করা হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করা উচিত। গ্রেফতার আতঙ্ক আলেমদের জন্য ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে; এতিমরা সরকারি সহায়তা না পেলে রমজান-ঈদ তাদের কাছে বিষাদে পরিণত হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।