Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২৫ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সর্বাত্মক কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

যতই দিন যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াটি ততই যেন জটিল হয়ে উঠছে। গত ২২ আগস্ট ৩ হাজার ৪৫০ জনের একটি রোহিঙ্গা দলের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা ভেস্তে গেছে। রোহিঙ্গারা রাখাইনে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ও নিরাপত্তার ব্যাপারে আশস্ত হতে না পারা এবং মিয়ানমার এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় মূলত এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারেনি। উল্টো মিয়ানমার ঐ দিনই এক প্রেস রিলিজে বাংলাদেশকে দোষারোপ করে বলেছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ফেইল করেছে। এ প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন গত বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা পরিস্থিতির সর্বশেষ তথ্য জানাতে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফ করেন। রাষ্ট্রদদূতদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আপনারা আরও সক্রিয় উদ্যোগ নেন, যেন মিয়ানমার তাদের স্বজাতিকে নিজে দেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। তিনি বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, মিয়ানমারের দায়িত্ব ছিল রোহিঙ্গাদের মাঝে আস্থা বা বিশ্বাসের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা, যাতে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরে যায়। মিয়ানমার সেই আস্থা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে চীনের কার্যকর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি জরুরি। মূলত এক চীনের কারণে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তালবাহানা করে চলেছে। এতদিন চীন এ ব্যাপারে আশ্বাসের মাধ্যমে ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো আচরণ করলেও সম্প্রতি কোনো রাখঢাক না করেই বলেছে সে মিয়ানমারের সাথে রয়েছে। এ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে চীন যদি কোনো ধরনের ভূমিকা না নেয়, তবে তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এদিকে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে নবনিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং পরারাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। বৈঠক শেষে রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে। এ থেকে প্রতীয়মাণ হচ্ছে, চীন সেই আগের মতোই এ সমস্যায় ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আশাবাদের দোলাচালে রেখে দিয়েছে। দেশটি সুস্পষ্টভাবে তার উদ্যোগের কোনো ঘোষণা দিচ্ছে না। কেবল করব, করছির মধ্যে রয়েছে। কবে করবে তা অনিশ্চিত। অথচ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে ঠাঁই দেয়া, তাদের ভরণপোষণের ব্যয়ভার বহন করা, সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা নিয়ে এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার বোঝা বহন করা বাংলাদেশের জন্য একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে জন্মগ্রহণের মাধ্যমে দিন দিন রোহিঙ্গার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার নিজ দেশে ফিরতে না পারার কারণে তাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকছে না। পৃথিবীতে তারা ভূমিহীন এবং বসবাসের অধিকারহারা হয়ে পড়েছে। অধিকারহারা এবং ভাসমান এসব রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখন অপরাধ প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের অনেকের মধ্যে যেন এ মনোভাব কাজ করছে, ‘আমরা বেঁচে থেকেও মরে আছি’, কাজেই হয় ‘মরব না হয় মারব’। এ ধরনের মনোভাব থেকে অনেকে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ থেকে উগ্রবাদের সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। যদি তাই হয়, তবে তা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে এবং এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশের জন্যই হুমকি হবে না বরং বিশ্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো খুব একটা ভাবছে বলে মনে হচ্ছে না। জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো এ ব্যাপারে কেবল লিপ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না এবং মিয়ানমারকে তার দেশের মানুষগুলোকে ফিরিয়ে নিতেও বাধ্য করছে না। যে চীনের একক উদ্যোগেই এ সমস্যা সহজতর হয়ে যেতে পারে, সে চীন আশ্বাস ছাড়া বাস্তবিক কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। চীন মুখে মুখে বাংলাদেশকে বন্ধু বললেও বন্ধুর সমস্যায় পাশে দাঁড়াচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশে তার বিপুল ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকই আদায় করে নিচ্ছে। আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না, বাংলাদেশের পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সরকার কেন চীনকে এ ব্যাপারে কার্যকরভাবে পাশে পাচ্ছে না। এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো মুখে মুখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা বললেও চীনকে যদি এক্ষেত্রে পুরোপুরি কনভিন্স করে তাকে উদ্যোগী করা না গেলে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে।

এ কথা অনস্বীকার্য, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বড় ও প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশকে মুখে মুখে সহমর্মিতা এবং মাথায় হাত বুলানোর মতো সান্ত¦না দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে। তাদের আচরণে নিজ থেকে উদ্যোগ নেয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাজ হবে, নিজের সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সর্বাত্মক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের কী নিদারুণ সমস্যায় পরিণত হচ্ছে, তা ধারাবাহিকভাবে দেশগুলোকে বোঝাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সরকারকে নিরলস পরিশ্রম ও উদ্যোগ নিতে হবে। কথার চেয়ে কাজ বেশি করতে হবে। যেহেতু এটা স্পষ্ট, একমাত্র চীনের কার্যকর উদ্যোগই পারে এ সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে, তাই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরতে হবে। পাশাপাশি অন্যদেশগুলোকেও কনভিন্স করতে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে বা একপাশে রেখে উদ্যোগ সফল হবে না। মিয়ানমার যেভাবে ঘোষণা দেয়, তাদের অনেক শক্তিশালী বন্ধু রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশকেও তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে আমাদেরও অনেক শক্তিশালী বন্ধু আছে। এর জন্য প্রয়োজন, জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং তা হতে হবে ধারাবাহিক। কিছু দিন দৌড়ঝাপ করে বসে থাকলে হবে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন