Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাণিজ্যিক কারণেই আমাজনে আগুন লাগানোর মহোৎসব

রয়টার্সের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০১৯, ১২:২৮ এএম

প্রতিদিন পুড়ে ছাই হচ্ছে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ খ্যাত আমাজন। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্স (আইএনপিই) বলছে, এ বছর জুন পর্যন্ত ব্রাজিলে ৭২ হাজার ৮৪৩টি অগ্নিকান্ড হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি আগুনের ঘটনা আমাজন জঙ্গলে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮৮ শতাংশ বেশি। এসব অগ্নিকান্ডের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দায়ী করা হচ্ছে পশুপালক ও কৃষকদের।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট অভিযোগ করেছেন, এনজিও সংগঠনের পক্ষ থেকে লাগানো হচ্ছে এসব আগুন। আদিবাসী পরিবেশবাদীরা বলছেন, আমাজনকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার সরকারি নীতির কারণেই আগুন লাগানোর মহোৎসব শুরু হয়েছে। এই বক্তব্যের সমর্থন মিলেছে রয়টার্স প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।
ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সে দেশের বন সুরক্ষায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় সংস্থা ইবামাকে ‘অকার্যকর’ করার মধ্য দিয়েই আমাজনকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। ইবামার বর্তমান ও সাবেক ১০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে, সরকারি নথি ও অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য সামনে এনেছে রয়টার্স।
২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলে বন উজাড়ের ঘটনা ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পেরেছিল সে দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটিউট অব দ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড রিনিউবেল ন্যাচারাল রিসোর্স’-ইবামা। বন সংরক্ষণে দৃষ্টান্তমূলক ভ‚মিকার কারণে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। স্যাটেলাইট ছবি ও মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নিতো তারা। তবে বামপন্থী প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ ২০১১ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর ইবামার ১৬৮টি স্থানীয় দফতরের ৯১টিই বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০১৫-১৬ সালে এই সংস্থার বাজেটও সঙ্কোচন করা হয়।
আর বর্তমান ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই সংস্থাটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময়ই ইবামার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন তিনি। তার অভিযোগ এটা ‘জরিমানার কারখানা’। বোলসোনারো দায়িত্ব নেয়ার পর পাল্টে যায় পরিবেশ নীতিও। রয়টার্স জানায়, সংস্থাটিতে এখন মোটামুটি ৭৮০ জন এজেন্ট রয়েছেন; যাদের সংখ্যা ১১ হাজার বর্গকিলোমিটারে একজন। এর ২৫ শতাংশ কর্মী যেকোনও সময় অবসরে যেতে পারেন।
এদিকে, প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা জানিয়েছেন, তারা নিজেরাও নতুন বিধিনিষেধে অস্বস্তিতে রয়েছেন। অবৈধ এলাকায় পাওয়া গাছ কাটা ও খননের জিনিসপত্র ধ্বংস করতে পারেন না তারা। আগের প্রশাসনে এই কাজটা করতে পারতেন মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা। গত এপ্রিলে আমাজনের রোনডনিয়ায় এমন কিছু জিনিসপত্র পুড়িয়ে দেয়ার পর প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো এই নিয়ম বাতিল করেন। তিনি বলেন, কোনও কিছুই পোড়ানো ঠিক নয়। এটা নিয়ম না। এরপর থেকে ইবামায় নিয়োগ দেয়া বোলসোনারোর নতুন প্রধান অলিভাদি অজেভেদো আর কোনো যন্ত্র পোড়ানোর অনুমতি দেননি। এ বছর আরেকটি পরিবর্তন ছিলো পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করা বিশেষ বাহিনীকে অকার্যকর করে দেয়া। বিষয়টির সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট চারজন রয়টার্সকে বলেন, ইবামা বিপজ্জনক ও দুর্গম এলাকায় অভিযানের জন্য এই বিশেষ বাহিনীর ওপর নির্ভর করতো। কিন্তু বোলসোনারো প্রশাসনের কর্মকর্তারা তা পরিবর্তন করে ফেলেছে।
এই বিশেষ বাহিনীর নাম জিইএফ। তাদের সদস্য সংখ্যা ১৩। তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর মতো পরীক্ষা হয়। ইবামা তাদের পরিকল্পনা জিইএফ-কে জানালে তারা তা বাস্তবায়ন করে। তবে চলতি বছর বড়জোর ১০ বার তাদের মাঠে নামানো হয়েছে। আমাজনের যেসব স্থানে বেশি অবৈধ কাজ হয় সেখানে জিইএফ-এর অভিযান চালাতে চলতি বছর অন্তত দুইবার অনুরোধ করেছিলো ইবামা কর্মীরা। তবে পরিচালক আজেভোদো রাজি হননি।
ইবামা নামের এই সরকারি সংস্থাটিকে প্রায়ই উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা বলে উল্লেখ করেন দেশটির কনজারভেটিভ প্রেসিডেন্ট জেয়ার বোলসোনারো। ১ জানুয়ারি তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর ইবামার বার্ষিক বাজেট ২৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। বিরোধী দলের সংগ্রহ করা একটি অভ্যন্তরীণ নথি থেকে এই তথ্য পায় রয়টার্স। এই বাজেট কমানোর মধ্যে বনের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থায়নই কমে ২৩ শতাংশ।
সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানান, অবৈধ গাছকাটা, কৃষিকাজ ও খননের কারণে চলতি বছর আমাজনের ১২ হাজার বর্গকিলোমটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংস্থাটির মাঠ-পর্যায়ের কর্মীরা আগের মতো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। পরিবেশ অপরাধ সংঘটিত স্থানে প্রাপ্ত ভারী জিনিসপত্র ধ্বংসের এখতিয়ার নেই তাদের। সংস্থার পাঁচজন সাবেক ও বর্তমান কর্মী বলেন, এতে করে ভ‚মি দখলকারীদের ধরা কঠিন ও ধীরগতির হয়ে যায়। এছাড়া ইবামার বন পুলিশের বিশেষ বাহিনীকে চলতি বছর আমাজনে কোনো দায়িত্বপালন করতে দেখা যায়নি। তাদেরকে উল্টো ডেস্কে কাজ করতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মীরা। আর ডেস্কে কাজ না থাকলে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এমন স্থান থেকে অনেক দ‚রে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদের। বোলসোনারো দায়িত্ব নেয়ার পর পরিবেশ অপরাধীদের শাস্তিও কমে গেছে। ২৩ আগস্ট পর্যন্ত এমন অপরাধীদের দেয়া জরিমানার অঙ্ক গতবছরের তুলনায় ২৯ শতাংশ কম। সরকারি হিসেব মতে, ওই শাস্তির সামষ্টিক মূল্য ৪৩ শতাংশ।
গত সোমবার ৫৪ জন ইবামা কর্মী সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট এডুয়ার্ডো বিমের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে ব্রাজিলে পরিচালিত পরিবেশ নীতির ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। চিঠিতে তারা ইবামাসহ আরও কয়েকটি পরিবেশ সংস্থায় ছয়টি পরিবর্তন প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। এরমধ্যে নতুন নিয়োগ, কার্যকরী স্বায়ত্বশাসন এবং পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহের কথা বলা হয়।
ব্রাজিলের পরিবেশ মন্ত্রণালয় ইবামার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। সংস্থাটির বাজেট কমানো এবং অন্যান্য অভিযোগ নিয়ে বারবার তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও রয়টার্সের অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছে তারা। মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, ইবামার এই পরিবর্তন পূর্ববর্তী সরকারের কারণে হয়েছে। এরমধ্যে প্রয়োজনীয় বস্তুর অপ্রতুলতা এবং মাঠপর্যায়ের দফতরে অদক্ষ ব্যবস্থাপনাও দায়ী। তিনি দাবি করেন, আমাজনের আগুন নিয়ন্ত্রণে ইবামা এখনও প্রশাসনিক পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে। এর আগেও মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছিলো যে, তারা বন রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখে এবং অবৈধ বন উজাড়কে অপরাধ কার্যক্রম বিবেচনা করে।
স¤প্রতি আমাজনের অগ্নিকান্ডের ছবি ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার মুখে পরে বোলসোনারো সরকারের পরিবেশ নীতি। দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্পেস রিসার্চ (আইএনপিই) এর তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে ব্রাজিলজুড়ে গত বছরের তুলনায় ৬৭ শতাংশ বেশি বন উজাড় করা হয়েছে। ২৪ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে, ২০১৩ সালের পর থেকে যা সর্বোচ্চ।
ব্রাজিলের গ্রিন পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ব্রাজিল ক্লাইমেট সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক অ্যালফ্রেডো সিরকিস বলেন, ‘উষ্কানি দেয়া ছাড়াও বোলসোনারো কৌশলে পরিবেশ সুরক্ষায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় অঙ্গকে অকার্যকর করে ফেলেছেন।’
পরিবেশবাদীরা বলছেন, ব্রাজিলীয় খামার মালিক ও কৃষকরাই ইচ্ছা করে আগুন লাগাচ্ছে যেন তারা তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়াতে পারে। বোলসোনারোর সরকারের নীতিও এমন হওয়ার কারণে তারা সুযোগ পাচ্ছেন। তবে রয়টার্স এই দাবি নিশ্চিত করতে পারেনি। সূত্র : রয়টার্স



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মহোৎসব

৫ ডিসেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ