Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বন্দুকের ছায়ায় অবরুদ্ধ কাশ্মীরের জীবনযাত্রা

ইনকিলাব ডেস্ক : | প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

ভারত-অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে (জে অ্যান্ড কে) প্রায় পুরো আগস্ট মাস ধরেই নজিরবিহীন অবরুদ্ধ অবস্থা চলছে। ৫ আগস্ট কোন রকম পূর্বঘোষণা ছাড়াই কঠোর হস্তে সংবিধান পরিবর্তন করা হয় এবং কাশ্মীরের জনগণ যাতে এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করার জন্যই কাশ্মীরকে এভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
১ আগস্ট। জ্বালানি স্টেশান, ওষুধের দোকান এবং ব্যাংকের এটিএমগুলোর সামনে সাপের মতে দীর্ঘ সারিতে লাইন ধরছিল কাশ্মীরের মানুষ। ছবির মতো সাজানো কাশ্মীর উপত্যকার নিত্যদিনের শীতল ও চোখ ধাঁধাঁনো বাতাস হঠাৎ করেই যেন হয়ে অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ ও আতঙ্কে ভারি হয়ে উঠেছিল।
সংবিধান থেকে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের প্রায় এক সপ্তাহ আগে সরকার অমরনাথ গুহার উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী হিন্দু তীর্থযাত্রীসহ সকল পর্যটকদের উদ্দেশ্যে নোটিশ জারি করেছিলো যাতে ‘যত দ্রুত সম্ভব’ তারা কাশ্মীর ছেড়ে যায়।
সে সময় সরকার বলেছিল যে, পাকিস্তান থেকে পরিচালিত সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার হুমকির প্রেক্ষিতে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি বিমানবন্দরগুলোতে সতর্কাবস্থা জারি করা হয়। সরকারী কর্মকর্তা এবং পুলিশের মধ্যে স্যাটেলাইট ফোন বিতরণ করা হয়।
এই ধরনের পদক্ষেপ বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা তৈরি করে কাশ্মীরের নাগরিকদের মধ্যে যারা আগে থেকেই অবরোধের মধ্যে রয়েছে। সরকারের সৃষ্ট এই আতঙ্কের জবাবে তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেয় এবং জরুরি খাবার, ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত অর্থ, ওষুধ কেনা, শিশুখাদ্য সংগ্রহ এবং জ্বালানি কিনে গাড়িগুলো ভর্তি করে রাখতে শুরু করে।
৫ আগস্ট যখন ভোরে ফজরের আজান শুরু হচ্ছিল মসজিদগুলো থেকে, তখন আজানের মাঝখানেই পুলিশের যানবাহনগুলো থেকে লাউডস্পিকারে সতর্ক করা হয় যে, শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে।

কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ করে রাখা
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় কাশ্মীরের শাসক ছিলেন ধর্মপরায়ণ হিন্দু মহারাজা হারি সিং। সে সময় তিনি সিদ্ধান্ত নেন ভারতের সাথে ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশানে স্বাক্ষর করবেন তিনি। এর পরপরই পাকিস্তানের পাঠান উপজাতিরা বড় ধরনের অভিযান চালায়।
১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবর মহারাজা হারি সিং সিদ্ধান্ত নেন যে, তার রাজ্যকে ভারতের সাথে যুক্ত করবেন তিনি। তবে এই সংযুক্তির জন্য কিছু শর্ত দেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে: এই অঞ্চল নিজেদের ব্যাপারে অবশ্যই স্বায়ত্তশাসন পাবে, তাদের স্বতন্ত্র পতাকা এবং আলাদা সংবিধান থাকবে। তিনি একই সাথে বহিরাগতদের জন্য কাশ্মীরে জমি কেনার উপরও নিষেধাজ্ঞা দেন এবং এর মাধ্যমে কোন অ-কাশ্মীরী এ অঞ্চলের নাগরিক হতে পারবে না।
বাহাত্তর বছর পর ৫ আগস্ট ভারত সরকার ঘোষণা দিলো যে, কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং এখন থেকে এই অঞ্চল কোন বিশেষ মর্যাদা বা সুবিধা পাবে না। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মানুষ এখন কাশ্মীরে জমি কিনতে পারবে এবং এখানকার স্থায়ী নাগরিক হতে পারবে।
স্থানীয় মুসলিম – যারা কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ – তারা আশঙ্কা করছেন যে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারত সরকার কাশ্মীরের জনমিতি বদলে দেয়ার চেষ্টা করছে যাতে মুসলিমরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ট মর্যাদা হারায়।
বড় ধরনের বিক্ষোভের আশঙ্কা থেকে সরকার দ্রুত পুরো কাশ্মীর জুড়ে কারফিউ জারি করে। অধিকাংশ এলাকায় এখনও বিধিনিষেধ চলছে। মোবাইল, ল্যান্ড ফোন এবং ইন্টারনেট সেবা এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
বিরোধী গ্রুপগুলোর রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকর্মীসহ ৪০০০ এর বেশি মানুষকে বন্দী করে রাখা হয়েছে।
স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, সরকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবকিছু বন্ধ রয়েছে। স্কুলগুলো খোলার সরকারী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে কারণ বাবামায়েরা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে রাজি হচ্ছে না, কারণ পুরো উপত্যকা জুড়ে এখনও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
৪ আগস্ট সন্ধ্যায় আমার এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে ফোন করেন, যিনি কাজ করছেন নয়াদিল্লীতে। তিনি আমাকে দিল্লীতে চলে আসতে বলেন এবং কাশ্মীরে না থাকতে বলেন। তিনি বলেন, “কোন ইন্টারনেট, কোন ফোন, কোন যোগাযোগ থাকবে না। কিভাবে তুমি কাজ করবে আর কিভাবে রোজগার করবে?”
আমার জন্য কাশ্মীর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ ছিল না। আমার ছোট বোন তখন সন্তান সম্ভবা এবং আমার মাথায় একমাত্র যে চিন্তাটা তখন ঘুরছিল, সেটা হলো হাসপাতালের কাছাকাছি কোথাও আমার পরিবারকে সরিয়ে নিতে হবে।
৫ আগস্ট কারফিউ জারির পর পুরো জনগোষ্ঠি তাদের ঘরে আটকা পড়ে যায়। ১৮ আগস্ট মধ্যরাতে আমি আমার বোনকে বাড়ি থেকে প্রায় আট মাইল দূরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সশস্ত্র বাহিনীর লোকজনকে আমার অনুনয় করতে হয়েছে যাতে আমাদেরকে যেতে দেয়া হয়। তাদের দায়িত্ব হলো সড়কগুলো বন্ধ করে রাখা। তারা আমাদের গাড়ির জানালা দিয়ে দেখলো আমি ঠিক বলছি কি না, আর এরপর কঠোরভাবে বললো ‘নিকলো’ বা যাও।
১৯ আগস্ট ভোর ৪টার দিকে আমরা হাসপাতালে পৌঁছি। তার একটি ছেলে শিশুর জন্ম হয়। দুই দিন পর, আমার বোন আর তার নতুন শিশুকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেয়ার পথেও একই ধরনের সেনা ব্যারিকেডের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে।
কাশ্মীরে অবরুদ্ধ অবস্থার এটা ছিল ২৩তম দিন। এত সময়ের মধ্যেও আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং আমার এক ছোট ভাই, যে উত্তর ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের একটি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, তাদের কোন খবর জানি না। এমন কোন দিন যায়নি যেদিন আমি আমার ফোন চেক করিনি যে, এটা হয়তো কাজ করতে শুরু করেছে। প্রতিদিন সকালে স্রষ্টাকে স্মরণ করে আমি আমার ল্যান্ডফোনটা উঠাই এবং এর ভেতরের শব্দটা শুনার অপেক্ষা করি। প্রায় প্রতিদিনই আমি স্বপ্ন দেখি যে, ওয়াইফাইয়ের লাল বাতিটা সবুজ হয়ে গেছে এবং আমি উত্তেজনার সাথে আমার হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ও ইমেইল চেক করছি।
বিগত ২৩ দিনে, এখানকার মানুষ যেন ভুলে গেছে একবিংশ শতকে বাস করার অর্থ কি। ইন্টারনেট আর মোবাইল টেলিফোনের কথা বাদ দিন, ঊনবিংশ শতকের স্মৃতি-যেটা এ অঞ্চলের এক শতাংশের বেশি মানুষ ব্যবহার করে না-সেই ল্যান্ডফোনও বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
একটা স্টোরি পাঠানোর জন্য আমাকে ৫ মাইলেরও বেশি দূরত্ব পাড়ি দিয়ে একটি প্রাইভেট হোটেলের বেজমেন্টে যেতে হয়, যেটাকে সাংবাদিকদের যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে। ওখানে চারটি ডেস্কটপ কম্পিউটার রয়েছে, যেগুলোতে সীমিত ইন্টারনেটের ব্যবস্থা রয়েছে।
কারোরই কোন ধারণা নেই যে এই অবরুদ্ধ অবস্থা কতদিন চলবে, তবে শিগগিরই সেটা বন্ধের সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে কাশ্মীরের জনগণ উর্দু কবি গালিবের এই শের দিয়ে নিজেদের ক্ষতবিক্ষত হৃদয়কে সান্ত¡না দিচ্ছে:
আহল-ই-বিনিশ কো হ্যায় তুফান-ই-হাওয়াদিস মাকতাব;
লুতমা-ই-মউজ কামাজসিলি-ই-উস্তাদ নাহি
(দুর্ভাগ্যের ঝড় বিচক্ষণদের জন্য স্কুল মাত্র:
ঝঞ্ঝার আঘাত শিক্ষকের চপেটাঘাত মাত্র)।
সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কাশ্মীর


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ