Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিপুল কর্মকান্ড কি বেকারত্ব ঘুচাতে পারছে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

বিগত এক দশকে দেশে ব্যাপকহারে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকান্ড চলছে। বড় বড় মেগা প্রজেক্টসহ অসংখ্য প্রজেক্টের কাজ এগিয়ে চলছে। পদ্মা সেতু, পায়রা সমুদ্র বন্দর, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে সহ আরও অনেক প্রকল্পের কাজ চলছে। এগুলো পরিপূর্ণভাবে চালু হলে অর্থনীতির গতি যে বৃদ্ধি পাবে, তাতে সন্দেহ নেই। পাশাপাশি অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যে প্রকল্পগুলো সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখবে, সেগুলো হলো সরকারের গৃহিত একশ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির উদ্যোগ। এগুলোর কাজ ধীরে হলেও এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম-সীতাকুন্ড ও এর সংলগ্ন ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় ৩০ হাজার একর জমি নিয়ে তৈরি হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরী। এর অবকাঠামোর কাজ দ্রæত গতিতে এগিয়ে চলেছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি এখানে বিনিয়োগ করছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ চীনা কোম্পানির উৎপাদন কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে এর প্রাথমিক যাত্রা শুরু হচ্ছে। এই শিল্পাঞ্চল পুরোপুরি চালু হলে রপ্তানি বাণিজ্য গতিশীল হওয়ার পাশাপাশি বড় ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সমস্যা হচ্ছে, যেসব শিল্পনগরী গড়ে উঠছে, সেগুলোর বেশিরভাগই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ। বলা যায়, দেশে যে নতুন শিল্পায়ন হতে যাচ্ছে, সেগুলোতে অটোমেশন পদ্ধতি বা যন্ত্রচালিত মেশিন সংযোজিত হচ্ছে। এতে কায়িক পরিশ্রমের শ্রমিক খুব একটা প্রয়োজন পড়বে না। পণ্য আনা-নেয়া, প্রক্রিয়াজাত, প্যাকেজিং করা থেকে শুরু করে লোডিংÑএসবই অটোমেটিক মেশিনের মাধ্যমে করা হবে। এক্ষেত্রে শুধু মেশিন চালানোর দক্ষ অপারেটর প্রয়োজন পড়বে। অর্থাৎ টেকনিক্যাল কাজ জানা লোকজনেরই কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। আমাদের দেশে এই অটোমেশন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হওয়ার মতো দক্ষ জনবলের তীব্র অভাব রয়েছে। যে গার্মেন্টস শিল্পে এতদিন অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় একটি খাত ছিল, সেই গার্মেন্টস শিল্পেও ইতোমধ্যে অটোমেশন যুক্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। কাটিং, পেস্টিং, স্যুইং, প্যাকেজিং, কোয়ালিটি কন্ট্রোলিং, লোডিং থেকে শুরু করে আয়রণ করার ক্ষেত্রে যে শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ত, অটোমেশনের ফলে সেসব শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা এখন ফুরিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ মেশিনে কাপড় তুলে দিলেই তা মাপমতো দ্রæত সময়ে একটি শার্ট, গেঞ্জি বা প্যান্ট তৈরি হয়ে প্যাকেট হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কাটিং, সেলাই, আয়রণ কিংবা অন্যান্য কাজ করার জন্য শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ছে না। ফলে বড় বড় অনেক গার্মেন্টস কারখানা থেকে শ্রমিক ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে। কারণ হচ্ছে, যে কাজ করতে দশ জন শ্রমিক প্রয়োজন পড়ছে, সে কাজ এখন এক মেশিনেই হয়ে যাচ্ছে। এতে লোকবল যেমন একজন-দুইজনে নেমে আসছে, তেমনি উৎপাদন সময় কম লাগার পাশাপাশি খরচও কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই কারখানাগুলো শ্রমিক ছাঁটাই করবে। এখন কারখানাগুলোর প্রয়োজন শুধু মেশিন অপারেট করার মতো দক্ষ জনবল। সমস্যাটা এখানেই। দেশে আধুনিক প্রযুক্তির মেশিন চালানোর মতো লোকবলের অভাব রয়েছে। ফলে কর্মজীবী শ্রমিক যেমন বেকার হচ্ছে, তেমনি অদক্ষ কর্মপোযোগীদেরও কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে আসছে। এই পরিস্থিতি যদি সরকারি-বেসরকারিভাবে মোকাবেলা করা না যায়, তবে দ্রæতই বেকারত্ব নিয়ে দেশ এক মহাসংকটে পড়বে। কোটি কোটি মানুষ বেকার হয়ে বসে থাকবে।

দুই.
আমাদের দেশে কর্মপোযোগী মানুষের সংখ্যার অভাব নেই। এমন মানুষ বিশ্বের খুব কম দেশেই রয়েছে। একটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। ‘শেপিং দ্য ফিউচার: হাউ চেঞ্জিং ডেমোগ্রাফিকস ক্যান পাওয়ার হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক জাতিসংঘের ইউএনডিপি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন তরুণদের দেশ। তারুণ্যে ভরপুর। দেশের ৪৯ শাতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। কর্মক্ষম মানুষ আছে ১০ কোটি ৫৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ। প্রতিবেদনে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৮ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। আর দেশে বয়স্ক বা ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। ২০৩০ ও ২০৫০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১২ ও ২২ শতাংশে। তার অর্থ হচ্ছে, তরুণের সংখ্যা দুর্বার গতিতে বৃদ্ধি পাবে, আর প্রকৃতির নিয়মে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা কমতে থাকবে। বলা যায়, বাংলাদেশ এখন তারুণ্যে ঝলমল একটি দেশ। প্রশ্ন হচ্ছে, তারুণ্যের এই ঔজ্জ্বল্য কতদিন টিকে থাকবে, যদি না তরুণদের এই তারুণ্য যথাসময়ে যথাযথভাবে কাজে লাগানো না যায়? আর কাজে লাগাতে পারলে দেশ অর্থনৈতিক উন্নতির পথে দ্রæত গতিতে এগিয়ে যাবে, সোনার বাংলায় পরিণত হবে। বিশ্লেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যদি দেশের বিপুল এই তরুণদের কাজে লাগানো না গেলে তাদের তারুণ্য আগামী ৩০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকবে। তারপর বুড়িয়ে দেশের বোঝায় পরিণত হবে। বিপুল সংখ্যক এই তরুণদের আমরা কীভাবে কাজে লাগাব? সেই সুযোগ কি আছে? এসব প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, এই তরুণদের কাজে লাগানোর মতো সুযোগ খুব কম। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যেখানে বছরে ১৩ লাখ কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, সেখানে হচ্ছে গড়ে ৬ লাখ। অর্থাৎ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি দূরে থাক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। বিবিএস এ কথাও বলেছে, গত দেড় দশকের মধ্যে বেকারের সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি। আর বেকারের মধ্যে ৭৪ শতাংশই তরুণ-তরুণী। অন্যদিকে দেশে যে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে, তাতেও এখন খুব একটা কর্মসংস্থান হচ্ছে না। অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ অন্যান্য প্রকল্পের কাজ শেষ হলে যে তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়ে যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিছু যে হবে না, তাও নয়। তবে যে হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বেকারত্বের হার কমাতে সহযোগিতা করবে, সে হারে করবে না। কারণ সেই অটোমেশন বা প্রযুক্তি। আমাদের দেশে তরুণ সমাজের মধ্যে কর্মক্ষেত্রের প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ নেই বললেই চলে। এখনই দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি এবং যেসব প্রকল্প তাদের অর্থায়নে হচ্ছে, সেগুলোতে তাদেরই টেকনিশিয়ান ও দক্ষ শ্রমিক বেশি কাজ করছে। অথচ এসব খাতে আমাদের দেশের শ্রমিকদেরই কাজ করার কথা। বিদেশি কোম্পানিগুলো চালু হলে দেখা যাবে, সেগুলোতেও স্থায়ীভাবে তাদের লোকজন সুযোগ পাবে। শঙ্কার বিষয়টিও এখানেই। সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাÐ জোরেসোরে চালাচ্ছে, শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলছে অথচ এসব খাতে দেশের বেকারদের কর্মসংস্থানে খুব একটা ভূমিকা রাখবে না। এর ফলে দেখা যাবে, এসব কিছুই হবে, এগিয়ে যাবে, পেছনে পড়ে থাকবে শুধু দেশের কোটি কোটি বেকার। এই বেকারদের মাঝে দেশ হয়ে উঠবে বিদেশিদের রেমিট্যান্সের বড় ক্ষেত্র। এ দেশ থেকে ভারতীয় কর্মজীবীরা বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি নিয়ে যাচ্ছে। রেমিট্যান্সের দিক থেকে বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের পঞ্চম দেশ। এভাবে চীনসহ অন্যান্য দেশের কর্মজীবীরাও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাবে। অন্যদিকে আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে দাসগিরি করে বেড়াতে হবে। এই বিপরীত চিত্রের মধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাÐ এগিয়ে চলছে। আবার যে স্বল্পসংখ্যক মেধাবী এবং উদ্ভাবনী শক্তি সম্পন্ন তরুণ রয়েছে, তাদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র দেশে অত্যন্ত সীমিত। এদের মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, প্রযুক্তিবিদ, বিশেষজ্ঞ। বুয়েটের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির কম্পিউটার ও প্রকৌশল বিভাগের ১৯৮৬ সালের ব্যাচে মোট শিক্ষার্থী ছিল ৩১ জন। তাদের ২৫ জনই এখন বিদেশে। একই বিভাগের ১৯৯৪ সালের ব্যাচের ৪৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ জন এবং ১৯৯৮ সালের ব্যাচের ৬৫ জনের মধ্যে ৩০ জন বিদেশে। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়েছেন। শুধু বুয়েট নয়, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের মেধাবীরাও দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যাচ্ছে। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে। এসব মেধাবীদের অভিমত হচ্ছে, দেশে তাদের জন্য ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। দেশের বাইরে দারুণ সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সুযোগ-সুবিধার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে দেশ ছাড়ছে মেধাবীরা। এছাড়া সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বহাল থাকায় প্রকৃত মেধাবীদের সুযোগ কমে যাচ্ছে। বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা থাকায় প্রকৃত মেধাবীদের মূল্যায়ণ না হওয়ায় তারা হতাশ হয়ে দেশ ছাড়ে চলে যাচ্ছে। অথচ দেশে যেসব অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মকাÐ চলছে, তাতে এসব মেধাবীদের খুবই প্রয়োজন। সরকার এ দিকটি বিবেচনা করছে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তির অভাবের সুযোগ নিচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মকাÐে জড়িত বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা তাদের দেশের শ্রমিক থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে। একটা সময় দেখা যাবে, এদেশের কর্মসংস্থানের বিরাট একটা অংশজুড়ে বিদেশিরাই থাকবে। অর্থাৎ আমাদের দেশের জমি চাষ করে বিদেশিরা ফসল নিয়ে যাবে। উপর দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঝলমল করবে, ভেতরে দেশের কোটি কোটি শিক্ষিত তরুণ বেকার হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে থাকবে। এ পরিস্থিতিতে যেসব মেধাবীদের সামর্থ্য রয়েছে তারা বিদেশ পাড়ি জমাবে। সেখানে গিয়ে সেসব দেশের উন্নতিতে কাজ করবে।

তিন.
দেশের অর্থনীতির উন্নতির বড় মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয় জিডিপির প্রবৃদ্ধি। এর উর্ধগতিই উন্নতির স্মারক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিগত এক দশক ধরে এই দেশের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে ৬-এর মধ্যে রয়েছে। সরকারি হিসেবে গত দুই বছর ধরে তা ৭-এর উপরে এবং আগামী অর্থবছরে তা ৮-এর কাছাকাছি বা উপরে হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জিডিপির এই হিসাবটি নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার সাথে গড়মিল হতে দেখা যায়। দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো সরকারের হিসাবের সাথে কখনোই একমত হয় না। সরকার যা বলে, সংস্থাগুলো তার চেয়ে কম বলে। অবশ্য সাধারণ মানুষের কাছে এসব জিডিপির হিসাব নিকাষ অর্থহীন। তারা এসব বোঝেও না বুঝতেও চায় না। কারণ তারা তাদের নিজেদের জিডিপি নিয়েই ব্যস্ত। তাদের অর্থিক এবং জীবনমানের উন্নতি কতটা হচ্ছে, তা দিয়েই উন্নতির বিচার করে। তারা তাদের ন্যূনতম সন্তুষ্টির মাধ্যমে সংসার চালাতে পারছে কিনা, সংসারের বেকার ছেলে বা মেয়ের কর্মসংস্থান হচ্ছে কিনা, পড়াশোনা চালাতে পারছে কিনা ইত্যাদিই তাদের জিডিপির উন্নতি-অবনতির মাপকাঠি। দেশের জিডিপি বাড়ল না কমল, তার হিসাব তাদের কাছে অর্থহীন। এ হিসাব করবে সরকার এবং বড় বড় অর্থনীতিবিদরা। গত বছর সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) জিডিপি নিয়ে বেশ তাৎপর্য্যপূর্ণ বিশ্লেষণ দিয়েছে। তাদের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হচ্ছে। সরকার জিডিপি বৃদ্ধি নিয়ে যে গর্ব করে, তা সুষমভাবে সব মানুষের উপকারে আসছে না। জিডিপির ধারাবাহিকতা থাকলেও যে হারে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, সে হারে হচ্ছে না বরং কমেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের হার কমেছে। জিডিপি যে পরিমাণ মানুষকে উপরে তোলার কথা সে পরিমাণে তুলতে পারছে না। এর অর্থ, জিডিপি অনেকটা একপেশে হয়ে পড়েছে। এটাতো একজন সাধারণ মানুষও বোঝে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি যদি সুষমভাবে হতো তবে দেশে কোটি কোটি কর্মক্ষম তরুণ বেকার বসে থাকত না। জিডিপি যেভাবে বাড়ছে তাতে একদিকের উন্নতি নির্দেশ করছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের পঞ্চাশ ভাগের বেশি সম্পদ রয়েছে মাত্র ৫ ভাগ মানুষের কাছে। সরল অংকের মতো হিসাব করলে দাঁড়ায়, দেশের জনসংখ্যা যদি ১৭ কোটি হয়, তাহলে ৮৫ লাখ মানুষের হাতে দেশের অর্ধেকের বেশি সম্পদ। এখন এই ৮৫ লাখ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতিই জিডিপি প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে রয়েছে। অর্থাৎ দেশের উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, তবে তা সুষমভাবে নয়। ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। উভয় শ্রেণীর আয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। আর যে বেকার তার তো কোনো আয়ই নেই। সে চাতক পাখির মতো একটি চাকরির অপেক্ষায় রয়েছে। দেশে এখন সরকারি-বেসরকারিভাবে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাÐ চলছে, তা দেশের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রভূত ভূমিকা রাখার আশা জাগালেও দেখা যাচ্ছে, এ আশা পূরণ কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ এসব কর্মকাÐের সাথে সংগতি রাখার মতো দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। দেখা যাবে, উন্নয়ন কর্মকাÐ বিনিয়োগে জড়িত বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এ অভাব পূরণ করতে তাদের দেশের শ্রমিক ও কর্মকর্তা আমদানি করে নিয়ে আসবে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়াবে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাÐ কর্মসংস্থান এবং বেকারত্ব ঘুচাতে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারবে না, যদি না এসব খাতে পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করা না হয়। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হবে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে তাদের প্রতিষ্ঠানের অধীনে প্রযুক্তি নির্ভর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা। অন্যদিকে প্রযুক্তি ও অন্যান্য বিশেষায়িত বিষয়ে যেসব মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে, তারা যাতে বিদেশে না গিয়ে দেশের প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়, এমন উৎসাহমূলক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা। এতে একদিকে যেমন দেশ থেকে মেধাপাচার রোধ হবে, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশের সন্তানদের ভূমিকা সারাবিশ্বে গৌরবজ্জ্বোল হয়ে উঠবে এবং দেশের অর্থ দেশেই থেকে যাবে। এখন যেমন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ দক্ষ শ্রমিক নিয়োজিত এবং আরও অসংখ্য শ্রমিক দক্ষতা অর্জন করে সেসব দেশে যাচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাÐে সুযোগ সৃষ্টি করে দিলে দেখা যাবে, বিদেশ থেকে তাদের অনেকেই দেশে চলে আসবে। তখন আর দক্ষ শ্রমিক বা কর্মকর্তার অভাব হবে না। যারা বিদেশ যেতে ইচ্ছুক, তারাও আর বিদেশ যেতে চাইবে না। দেশই তাদের কাছে বিদেশ হয়ে উঠবে। জিডিপিতে প্রবাসী শ্রমিক ও অন্যান্যদের রেমিট্যান্সের অবদান যে ১২ শতাংশ, তা এদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাÐ থেকেই যুক্ত হবে।

চার.
এ কথা অনস্বীকার্য, ভারসাম্যহীনভাবে হলেও দেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে। বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাজেটের আকার ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেছেন। এটা দেশের অর্থনীতির দ্রæত অগ্রগামিতা এবং বিপুলতারই নিদর্শন। এই বিপুল অর্থনীতি এগিয়ে নিতে বিপুল লোকবলের প্রয়োজন। আমাদের সেই লোকবল রয়েছে। শুধু প্রয়োজন, পরিকল্পিতভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাÐের সাথে দেশের তরুণদের সুযোগ করে দেয়া। আমাদের তরুণদের যে মেধা, মনন, উদ্যাম এবং উদ্ভাবনী শক্তি রয়েছে, তা অর্থনৈতিক কর্মকাÐে যুক্ত হলে বিদেশ থেকে বিদেশি শ্রমিক ও কর্মকর্তা আনার প্রয়োজন পড়বে না। যদি তা না করা হয়, তবে অর্থনীতির একদিক ভারসাম্যহীনভাবে উঠতে উঠতে একসময় তা নি¤œমুখী হয়ে পড়বে। কারণ এক পায়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। অর্থনীতির সুদৃঢ় পা হচ্ছে কর্মসংস্থান। লাখ লাখ বা কোটি কোটি তরুণকে বেকার রেখে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তখন দেখা যাবে বিশাল বেকারত্বের বোঝা অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার উদ্যোগ ও প্রকল্পগুলোর ওপর কালো ছায়া হয়ে থাকবে। যেমনটি দেখা যাচ্ছে, ভারতের অর্থনীতির ক্ষেত্রে। দেশটি উপর দিয়ে জ্বলজ্বল করলেও ভেতর দিয়ে ক্ষয়ে গেছে। গত ৭০ বছরের মধ্যে দেশটির অর্থনীতি এখন সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। আমরা এ ধরনের ফাঁপা অর্থনৈতিক ভিত্তি ও উন্নয়ন চাই না। আমরা চাই, সুষম ও টেকসই উন্নয়ন। এজন্য দেশের মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা অর্থনীতিকে দুই পায়ের সুদৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হবে।
[email protected]

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থনৈতিক


আরও
আরও পড়ুন