শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
দতুই ফেলে এসেছিস কারে মন, মনরে আমার।
তাই, জনম গেল শান্তি পেলি না রে মন,
মনরে আমার।।
যে পথ দিয়ে চলে এলি সে পথ এখন ভুলে গেলি রে।
কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন, মনরে আমার।
নদীর জলে থাকি রে কান পেতে কাঁপে রে প্রাণ
পাতার মর্মরেতে।
মনে হয় যে পাব খুঁজি ফুলের ভাষা যদি বুঝি রে
যে পথ গেছে সন্ধ্যা তারার পারে মন, মনরে আমার।।‘
মানুষের জীবন খুব বিচিত্র। বিচিত্র সম্ভারে ভরপুর সব। রহস্যের খনি। অনন্ত অন্তর জ্বালা ধারণ করে সে ক্লান্ত। ভীষণ ক্লান্ত। কোথায় যে আছে এতটুকু শান্তি, কেউ জানে না। বোঝে না মর্মপীড়ন। শুধু যন্ত্রণা ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে আসে তনু-মন। উদাস দৃষ্টি পড়ে থাকে পথের ওপর। মন উচাটন। চলে যেতে চায় দূর কোন দেশে। যে দেশের সন্ধান সে জানে না, মানে না, চেনে না, পারে না নিজেকে সাজাতে সজ্জিত আলোকে। কেবলই অষ্ফুট আলোতে দিগন্তের শেষ চিহ্ন ধারণ করে ফিরে চলা। কোথায় গন্তব্য? কোন সে আড়াল? কেন যে এত লুকোচুরি? ভয়ার্ত শিহরণ। মন জানে না মনের ঠিকানা। মন বোঝে না মনের মর্মজ্বালা। এ কেমন নিয়তি! জন্মের আগেই বা কী আর পরেই বা কী? কিন্তু কিছু ছিল, কিছু থাকবে এমনতো সহজাত ধারণা। ভাষা প্রকাশ করতে পারে না স্পর্শের অনুভূতি, দেখার আবেদন, অনুভবের আর্তনাদ। প্রকাশমান সত্য নিজেকে বা ধ্রুব কিছুকে ব্যক্ত করতে অনন্ত প্রচেষ্টায় ব্যর্থ শব্দ সমুজ্জ্বল। দিশাহারা এ হৃদয়। মন ময়ুরী পেখম তোলে। ডানা ঝাপটায়। বিভিন্ন রঙের বাহার প্রতি পলে ঝরে ঝরে পড়ে। মন অশান্ত। তীক্ষ্ণ কাঁচের ফলা শিহরিত আর্তনাদ। কোথায় ছিলাম? কে ছিল স্পর্শের অতীত? অনুভবে বিষণ্ন বালিয়াড়ি।
এ মন তবু পোড়ে। মনের গহীণে মন কাঁদে। ডুকরে ডুকরে কাঁদে। কোন এক অপূর্ণতা দিশাহারা করে এ জীবন। কাকে যেন খোঁজে, সন্ধান মেলে না। তাকে বোঝা যায়, অনুভব করা যায় কখনো কখনো। মনে হয়, এইতো এখানে। আবার যেন দূরে কোথাও। কেমন সন্ধিহান, ঘ্রাণে ব্যাকুল, উচাটন মন, সতর্ক সংকেত। কোথা থেকে আসা আর কোথায় চলে যাওয়া, কেউ তা নির্ধারিতভাবে বলতে অক্ষম। শান্তির আশা বৃথা। এ মন শান্তি অন্বেষায় ব্যস্ত প্রতিক্ষণ। হতাশা ও বিষণ্নতা ধোয়াটে আলো। অপূর্ণতাকে সঙ্গী করে বিরামহীন পথ চলা। পূর্ণতার সন্ধানে যাপিত জীবন চলন্ত চালিকা। কাকে যেন ফেলে আসা, তার সন্ধানে চাপা কষ্ট হৃদয় গহীণে ডুকরে কাঁদে। এ কান্না অনন্ত। অবিমিশ্র ধারায় প্রবহমান। অশান্তির আগুন মাথার ওপর বাজপাখি। যে পথ দিয়ে এ মৃত্তিকায় নিজেকে বুনন, সে পথ সহসা ভুলে যেতে চায় মন। চাপা পড়ে, শেষ হয় না, মুছে ফেলা যায় না অনির্বাণ শিখা। সে জেগে ওঠে প্রবল বিশ্বাসে, চক্রাকারে আবর্তিত হয়, প্রার্থিত সন্ধান মেলে না। আত্মবিশ্বাসও কমে না, যেন আলেয়া, মরীচিকায় রৌদ্র দহন। পাবো প্রেম অনন্ত অন্তরীক্ষে। আশা ওড়ে, স্বপ্ন জাগে, শান্তির পলেস্তরা। হৃদয়ের ব্যথা বিশ্ব জগৎময় ফুপিয়ে চলে। বাতাসের ঝড়ো গতিতে কাউকে খোঁজে। নিজের আত্মার আত্মীয়, নিজের ফেলে আসা অংশ। সে কোথায়? অতৃপ্ত আত্মদহন, পোড়ে মন, পোড়ে বাঁশি। নিজেকে পরিপূর্ণ প্রকাশে অক্ষম শরীরে আশ্রয় নেয়া আত্মা ব্যাকুল প্রতিক্ষণ, দিশেহারা এ হৃদয়। মন ব্যাকুল, চিত্ত চঞ্চল। কীভাবে ফিরে যেতে হবে, সে পথ অজানা। মৃত্যু নামক দরজা দিয়ে সে ঘরে ফেরা। মৃত্যুর ওপাশ অন্ধকার। ঘন অন্ধকারে নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়। সে আছে সূ²জাল বিস্তার করে। এইত এখানে আবার হারিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক। সত্য যে কঠিন, তাকে স্পর্শ করা কি সম্ভব? কোথায় তার সুদৃঢ় অবস্থান, বলতে পারেনা কেউ। তাকে ধরতে জন্ম-জন্মান্তরের প্রচেষ্টা। প্রতিবারই ফিরে আসার গ্লানি। সে একান্ত অসহায় অথচ অবিচল নিমগ্ন সন্ধানে পথ পরিক্রম করা। কখনো মনে হয়, যদি নদীর জলে থেকে স্রোতের ভাষা হওয়া যায়, যে পাতা বাতাসে কাঁপে, তার মর্মরে পৌঁছানো যায়, ফুলের ভাষা যদি বোঝা যায়, সন্ধ্যা তারার পথে যদি এগিয়ে যাওয়া যায়, যদি ধরা যায় তাকে! তবে এক প্রশান্তির অবিমিশ্র ধারা। শঙ্কা সেখানেই শেষ নয়। প্রকৃতির নেপথ্য স্পন্দনের সাথে যদি একাত্ম হয়ে মিশে যাওয়া যায়, হয়ত মুক্তির স্বাদ কিছুটা পাওয়া সম্ভব! অবচেতন মনে তার উপস্থিতি নিত্য। তাকে বাইরে এনে আগলে রাখা অসম্ভবকে সম্ভব করার মতই তীব্র কঠিন, মর্ম যাতনা চূড়ান্ত। অতৃপ্তির পথ ধরে এগিয়ে চলছি সে নিরেট অস্তিত্বের সন্ধানে।
ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সত্য মনের মর্মরে গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।