পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইসরাইলের জায়নবাদীরা সমগ্র আরব ভূখন্ড নিয়ে গ্রেটার ইসরাইল গঠনের স্বপ্ন দেখে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট অংশে হাজার হাজার নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক একইভাবে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা ঔপনিবেশিক আমলের বৃটিশ-ভারতভুক্ত সমগ্র অঞ্চল নিয়ে অখন্ড ভারতের স্বপ্ন দেখে। গত ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনে এবং কাশ্মিরে এই প্রক্রিয়া চলছে। ভারতে বিজেপি এবং ওয়াশিংটনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গত কয়েক বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ফিলিস্তিনে এবং ভারতে মুসলিম বিদ্বেষী অবস্থা ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করতে শুরু করে। রাষ্ট্রশক্তি এবং সাম্রাজ্যবাদের কুশীলবদের মুখোশ খুলে যাওয়ার সাথে সাথে সর্বত্রই পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে শুরু করেছে। আরব-ইসরাইল শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতাকারীর ছদ্মবেশ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ট্রাম্প যখন টু-স্টেট সলিউশনের পথ থেকে সরে জায়নবাদীদের পক্ষাবলম্বন করে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়ে মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুসালেমে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই তা বাস্তবায়ন করেছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও বিশ্বসম্প্রদায়ের অভিপ্রায়ের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখিয়ে জেরুসালেমে দূতাবাস স্থাপন করে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলিম বিদ্বেষী চরমপন্থা গ্রহণের বিষয়টি খোলাসা করেছে। তবে গত রমজান মাসে একটি ইসরাইলী পত্রিকায় ফাঁস হওয়া এক রিপোর্টে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি নামের এক মার্কিন পরিকল্পনার কথা জানা যায়। যেখানে অর্থের বিনিময়ে ফিলিস্তিনে একটি নামমাত্র স্বাধীন অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব রয়েছে। ফিলিস্তিন কোনো সামরিক বাহিনী গঠন করতে পারবে না, নিরাপত্তার ভার ইসরাইলের উপর ছেড়ে দিতে হবে- এমন শর্তে একটি স্বায়ত্বশাসিত রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব মেনে নেয়া হলে ফিলিস্তিনের উন্নয়নে বেশ কিছু আর্থিক সুবিধা দেয়ার ঘোষণাই হচ্ছে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির মূল প্রতিপাদ্য। ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি না মানলে পরোক্ষভাবে যে হুমকি দেয়া হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন প্রকারান্তরে জায়নবাদীদের অভীষ্ট সেই গ্রেটার ইসরাইল গঠনের পথে অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। ট্রাম্পের জামাতা কুশনার ইসরাইলের বিশ্বস্ত লবিস্ট হিসেবে পরিচিত। তার পরিকল্পনা ও প্রস্তাবেই এই ডিলের খসড়া চালাচালি চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে ৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের মূলা ঝুলানো ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্ব প্রত্যাখ্যান করেছে। সউদি আরবসহ পশ্চিমা বশংবদ শাসকদের ভূমিকাকে এখন আর বড় করে দেখা হয় না। সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ ও মিথ্যা প্রচারণা নির্ভর ভূমিকা পেন্টাগনের যুদ্ধঅর্থনীতি ভিত্তিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে হাজার হাজার কোটি ডলারে নিজেদের সশস্ত্রকরণের মধ্য দিয়ে তারা স্বকীয়তা বিকিয়ে দিয়েছে। ইরান, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, কাতার নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চিমা বশংবদ শাসকদের অবস্থান ও ভূমিকা তারা নিজেদেরকে পশ্চিমাদের কাছে খেলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইমানদার মুসলমানদের কাছে অস্থাহীন করে তুলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নিরসন করে সেখানে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জায়নবাদীদের ক্রীড়নক ও ইঙ্গ-মার্কিন বশংবদ শাসকরাই মূল প্রতিবন্ধক। ভয়কে জয় করে তারা যদি আল কুদস ও ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য এক নীতিতে অটল, ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে পারত তাহলে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সমাধান সম্ভব।
জনসমর্থনহীন, ক্ষমতা লোলুপ শাসকদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার শর্তে এদেরকে ক্রীড়নক বানিয়ে রাখার নানাবিধ মেশিনারিজ ও কলাকৌশল সদা সক্রিয় রয়েছে। আরব স্প্রিং, আলকায়েদা- আইএস জুজু, ফল্স ফ্লাগ সন্ত্রাসী হামলা, ইরানের পরমাণু প্রকল্প সম্পর্কে অতিরঞ্জিত ও উস্কানিমূলক রিপোর্ট ইত্যাদি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চিমা অনুগত শাসকদের চাপে রাখার অপকৌশল মাত্র। হঠাৎ করেই এই ধারাটি শুরু হয়নি। প্রথম মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরিকল্পিত ও পরিবর্তিত মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র, বালফোরের ঘোষণা, সাইকস-পাইকট চুক্তি এবং উসমানিয় খেলাফতের ভগ্নাংশের উপর গঠিত রাজপরিবার ও নতুন রাজতন্ত্রের উত্থানের মধ্যেই আজকের মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার বীজ প্রোথিত হয়েছিল। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আরবলীগ ও ওআইসিভুক্ত অর্ধশতাধিক রাষ্ট্রের প্রায় দুইশ কোটি মুসলমানের কেবলা, বায়তুল্লাহ ও হারামাইন শরিফের খাতিরে বিশেষ মর্যাদা ও দুর্বলতার পবিত্রতম ভূমির শাসকরা মুসলমানদের সমর্থন হারিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার মাসুল দিতে হচ্ছে মুসলিম উম্মাহকে। ইমানি শক্তিতে বলিয়ান হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকলে যে কোনো জাতি যে কোনো পরাশক্তিকে মোকাবেলা করতে পারে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান সে উদাহরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট পাহলভি রাজবংশকে হটিয়ে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব সফল করার পর থেকে গত ৪০ বছর ধরে পশ্চিমা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ এবং অব্যাহত হুমকির পরও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ইরানের উত্থান ঠেকানো যায়নি। বিশ্বের এক নম্বর সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল ও পশ্চিমা মিত্রদের ক্রমবর্ধমান হুমকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আত্মমর্যাদার সাথে টিকে থাকার বাস্তব উদাহরণ থেকে সউদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অনেক কিছুই শিক্ষনীয় ও অনুকরণীয় আছে। বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ইরানের সাথে ইরাকের যুদ্ধ বাঁধিয়ে ৮ বছর ধরে ইরাককে অস্ত্র ও অর্থসহায়তা দিয়েও বিজয় লাভ করা সম্ভব হয়নি। ইরান ও ইরাকের ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষতি ও হাজার হাজার মানুষ হত্যা করার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দুটি মুসলিম রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক উত্থান কিছুদিনের জন্য ঠেকিয়ে রাখা গেছে মাত্র। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নে ইরান-সউদি আরব, সিরিয়া, মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে আপসহীন ভূমিকা পালন করলে তা ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য কোনো পরাশক্তির নেই। নিজেদের মধ্যে বিরোধ জিইয়ে রেখে একপক্ষ নিয়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে পরস্পরের প্রতি হুমকি হিসেবে দাঁড় করানোর পুরনো কৌশল ক্রমেই অকেজো হয়ে পড়লেও মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চিমা বশংবদ শাসকদের হাত পা যেন কোনো অদৃশ্য শেকলে বাঁধা। গল্পের সেই রাজার পোশাকের মত আজকের অবোধ বালকেরাও সেই পরাধীনতার শেকলটি দেখে ভেংচি কাটলেও নির্বোধ রাজাদের যেন ঘুম ভাঙ্গে না। তারা আজো নিজেদের নিরাপত্তার ভয় ও ক্ষমতার আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে নিজেদের অজান্তেই ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে আছে।
মধ্যপ্রাচ্যের সাথে পশ্চিমাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতির স্বার্থের নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও সেই স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে ইসরাইলকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শত শত বছর ধরে ইউরোপ, রাশিয়া ও আমেরিকায় সঞ্চিত সম্পদের উত্তরাধিকারসূত্রে বিত্তশালী ইহুদি রাষ্ট্রটিকে বছরে শত শত কোটি ডলারের অর্থ ও সামরিক সহায়তা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে জায়নবাদীদের আগ্রাসনে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনী ও চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, সুদান ও সোমালিয়ার শিশুদের খাদ্য, ওষুধসহ বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ রক্ষায় তাদের কোনো বাজেট বা পরিকল্পনা থাকে না। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের উপর ভর করেই এখনো তাদের সভ্যতা ও অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। পড়ন্ত-ডুবস্ত ভোগবাদী অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের দেশগুলোতে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থের এক শতাংশ ব্যয় করার সদিচ্ছাও যেন তাদের নেই। মুসলমানদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাক, এটাই যেন তাদের গোপন অভিলাস। সউদি ও আমিরাতের শাসকরা অস্ত্রের পেছনে যে বেহুদা খরচ করছে তার সিকিভাগও যদি মুসলিম বিশ্বের দারিদ্র্য বিমোচন ও শিক্ষা উন্নয়নে খরচ করা গত তাহলে মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের চেহারাই বদলে যেত। একইভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যায় বিশ্বের এক নম্বর দেশ হওয়ার পরও সামরিক খাতে বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম বাজেট ব্যয় করছে ভারত। পরমাণু বোমা অর্জনের মধ্য দিয়ে অনেক আগেই পারমাণবিক ক্লাবে যোগ দিয়েছে ভারত। এর আগেই ভারতের বৈরী প্রতিদ্ব›দ্বী চীন পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়েছিল। ভারতের পরমাণু বোমার কারণে নিকটতম আরেক বৈরী প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানও পারমাণবিক বোমা বানাতে বাধ্য হয়েছে। সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে চীনের চাইতে বহু পিছিয়ে আছে ভারত। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও পারমাণবিক বোমার সংখ্যা এবং সামর্থ্যের ক্ষেত্রে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। অন্যদিকে বিশ্বের অতি দরিদ্র মানুষের প্রায় অর্ধেকের বাস ভারতে। একশ বিশ কোটি মানুষের দেশ ভারতের প্রায় অর্ধেক মানুষ এখনো টয়লেট ব্যবহার করতে শেখেনি। তারা জঙ্গলে বা নদীর পাড়ে সৌচকর্ম সম্পাদন করে থাকে। বিশ্বের অন্যতম ভূ-রাজনৈতিক পরাশক্তি রাষ্ট্রটির জন্য এটি অনেক বড় লজ্জা। দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর এ লজ্জা ঘোঁচাতে প্রতি বাড়িতে টয়লেট নির্মাণের একটি সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সে আন্দোলনের ফলে হয়তো লাখ লাখ পরিবার কাঁচা-পাকা টয়লেট নির্মাণে উৎসাহিত হয়েছে। তবে ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদের বেশিরভাগ মানুষ এখনো টয়লেট কী জিনিস তা বোঝে না। তারা ঝোঁপ-জঙ্গলে হাগু সেরেই তৃপ্ত। ভারতীয় গ্রামীণ সমাজ তাদের এই ট্যাবু ভাঙতে চায় না। একইভাবে ভারতের জাতীয় রাজনীতির আধুনিক কাপালিকরা হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে একটি অখন্ড ভারতের ধারণা ভারতীয়দের মগজে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে। এটি একটি ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক এজেন্ডা। যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব ভারতীয়কে হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসি হতে হতে হবে। সব ধর্মীয় ও ভাষাভাষি মানুষকে ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান দিতে হবে। এ দেশের মধ্যযুগের মরমিবাদী কবি বড়– চন্ডিদাস লিখেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই’। ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কবিতার এই লাইন শত বছর ধরে প্রেরণার মশাল হয়ে আছে। ভারতের সাম্প্রতিক বাস্তবতা হচ্ছে, সেখানে গরুর গোস্ত খাওয়ার অভিযোগ তুলে প্রকাশ্য পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। জয় শ্রীরাম শ্লোগান দিতে অস্বীকার করায় মুসলমানদের পিটিয়ে হতাহত করার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এটি সেই ভারত যেখানে কোনো একক রাষ্ট্রে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলমান জনগোষ্ঠির বাস। সুলতান ও মোঘলদের শত শত বছরের শাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই আধুনিক ভারতের সহাবস্থান ও পরমত সহিষ্ণুতার ভিত্তিভূমি গড়ে উঠেছিল। সাতচল্লিশের ভারতভাগের আগে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার মানুষের মৃত্যুর পর লাখ লাখ মুসলমান প্রাণভয়ে পাকিস্তানে মুহাজির হলেও হাজার বছর ধরে চলা রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বহুধর্মমতের সহাবস্থান ও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা মাল্টি কালচারালিজমের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতির উপর ভর করে কোটি কোটি মুসলমান ভারতে রয়ে গিয়েছিল। হাজার বছর ধরে ভারতে বসবাসকারী মুসলমানরা ভারতেরই মাটির সন্তান হয়েও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার সেই সময়টি উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক-মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের জন্য একটি ঐতিহাসিক লজ্জা হিসেবে পরিগণিত।
ভারতবিভাগের আগে দাঙ্গায় কলিকাতা শহরে নির্বিচার মুসলমান হত্যার জেরে সেখান থেকে বিহারি সম্প্রদায়ের লাখ লাখ মুসলমান পূর্ব বাংলায় চলে আসতে বাধ্য হয়। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের প্রভাব ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোতেও পড়েছিল। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাংলা ও পাঞ্জাবের বিভিন্ন অংশ থেকে হিন্দুরাও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তিকাল এবং চরম বাস্তবতা। যে বাস্তবতা বৃটিশ ভারতে দ্বি-জাতি ভিত্তিক দুটি রাষ্ট্রের উদ্ভবকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। একবিংশ শতকে এসে দেশে দেশে মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ধ্যান-ধারণায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। গ্লোবালাইজেশন ও তথ্যপ্রযুক্তির মহাসরণীতে প্রত্যেক মানুষের পদচারণা নতুন অভিজ্ঞতা ও চিন্তাশীলতার জন্ম দিয়েছে। পশ্চিমের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সাম্রাজ্যবাদী কলাকৌশলের ভেদবুদ্ধি সম্পর্কে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর সাধারণ মানুষও অবহিত হচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে বিশ্বে অনেক ভূ-রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হলেও ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোর শাসকরা শতকোটি মানুষকে যেন পিছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের সীমান্ত পরস্পরের জন্যই শুধু উন্মুক্ত করে দিয়ে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করতে সক্ষম হচ্ছে। তারা মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশগুলো থেকে আশ্রয়প্রার্থী লাখ লাখ মানুষকে অভিবাসী হিসেবে আত্মস্থ করে ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তনকে সময়ের বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিচ্ছে। সেখানে শত শত বছরের মুসলমান শাসনে গড়ে ওঠা ভারতে হাজার বছর ধরে যে ধর্মীয় সহাবস্থানমূলক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা অগ্রাহ্য করে মুসলমানসহ সব মানুষের উপর হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক খাড়া চাপিয়ে দেয়ার জবরদস্তি চালু করছে ভারতের বিজেপি সরকার। প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক মুক্ত বাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সামাজিক শান্তি-স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের বাইরে গিয়ে কোনো দেশ সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। ভারতের বেলায় এ কথা আরো বেশি দুর্লঙ্ঘ ও প্রাসঙ্গিক। কোনো সমাজের বেসিক স্পিরিট বা ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক চেতনা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক ক্ষমতায়িত শক্তি দিয়ে দাবিয়ে রাখা অসম্ভব। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদি শক্তির বিশেষ পরিকল্পনায় ও প্রত্যক্ষ সমর্থন নিয়ে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে গত ৭০ বছরেও ফিলিস্তিনি আরবদের একদিনের জন্য চুপ করিয়ে রাখতে পারেনি জায়নবাদী ইসরাইলিরা। বছরের পর বছর ধরে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক অবরোধ, একের পর এক সামরিক আগ্রাসন, ক্র্যাক-ডাউন ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেও ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের উত্থান ঠেকানো যাচ্ছে না। ইসরাইলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কাশ্মিরের উপর ভারতের রাজনৈতিক দখলদারিত্ব ও ক্র্যাক-ডাউনের লক্ষ্যও কখনো সফল হবে না। কাশ্মিরের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মুঘল সম্রাটরা ৪০০ বছরেও তাদের বশ্যতায় আনতে পারেনি। ঊনবিংশ শতকে পাঞ্জাবের সেনানায়ক রঞ্জিত সিং কাশ্মির দখল করার পর শিখরা ২৫ বছরের বেশি এর দখল রাখতে পারেনি। ১৮৪৬ সালে প্রথম অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধে শিখদের পরাজয়ের পর অমৃতসর চুক্তির আওতায় বিপুল অর্থের বিনিময়ে শিখ গোষ্টিপতি গুলাব সিংকে কাশ্মির শাসনের সুযোগ দেয়া হয়। বিশেষত ১৮৫৭ সালে ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহের সময় দোগরা রাজার বাহিনী ইংরেজের হয়ে যুদ্ধ করে কাশ্মিরের উপর নিজেদের অধিকার আদায় করে নেয়। কাশ্মির উপত্যকায় শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ নাগরিক মুসলমান হলেও প্রিন্সলি স্টেটের মর্যাদা দিয়ে এর শাসনভার অর্পণ করা হয় দোগরা রাজাদের হাতে। ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতাকালে মহারাজা হরি সিং কাশ্মিরের রাজা হওয়ার পেছনের ইতিহাস এটা। কথা ছিল রাজ্যগুলো ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিবে নাকি স্বাধীন থাকবে তা নির্ধারিত হবে গণভোট বা প্লেবিসাইটের মাধ্যমে। হরি সিং ও বৃটিশ গভর্নর মাউন্ট ব্যাটেনের চাতুর্যের কারণে কাশ্মিরিরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেও তারা কখনোই ভারতের বশ্যতা মেনে নেয়নি। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারত প্রিন্সলি স্টেটের ধারাবাহিকতায় কাশ্মিরের আলাদা বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়ে কাশ্মিরের মুসলমান রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ রাখার চেষ্টা করেছিল সংবিধানে ৩৭০ ধারার মাধ্যমে। শেখ আব্দুল্লাহ থেকে মেহবুবা মুফতি পর্যন্ত সব রাজনৈতিক নেতাই কাশ্মিরের স্বাধীন সত্তা ও বিশেষ মর্যাদার প্রশ্নে আপসহীন ভূমিকা পালন করেছেন। বিজেপি সরকার অবশেষে সে ধারাটি বিলুপ্ত করে কাশ্মিরের উপর দিল্লির হিন্দুত্ববাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। মুসলমানদের উপর হিন্দুদের অসহিষ্ণুতা, হিন্দুত্ববাদ ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের পাশাাপাশি পাকিস্তানের প্রতি বিজেপি সরকারের উস্কানিমূলক মনোভাবের কারণে কাশ্মিরিদেরকে দাবিয়ে রাখা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কঠিন হতে পারে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।