পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি মানুষের পাসপোর্টে এই ক’টি শব্দ উৎকীর্ণ হয়ে আছে, This passport is valid for all countries of the world except Israel. অর্থাৎ এই পাসপোর্ট ইসরাইল ব্যতীত পৃথিবীর সব দেশে বৈধ। এর আগে, অনেক বছর আগে, ইসরাইলের সাথে আরো দুটি দেশের নাম ছিল। সেগুলো হলো তাইওয়ান ও দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদী নীতি পরিত্যাগ করায় Except তালিকা থেকে দেশটির নাম কাটা হয়। এরপর কোনো এক সময় কোনো এক অজানা কারণে অবশিষ্ট দুটি দেশের নাম থেকে তাইওয়ানও বাদ পড়ে যায়। তাই বলে তাইওয়ানে গমন বা ভ্রমণ বা ঐ দেশটির সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য কি বৈধ? আমি জানি না। বাংলাদেশে তাইওয়ানের কোনো দূতাবাস নাই। বিএনপি আমলে একবার ঢাকায় তাইওয়ানের ট্রেড সেন্টার খোলার কথাবার্তা ওঠে। সেই নিয়ে বিএনপি সরকারের সাথে গণচীন সরকারের একটা ঝামেলা হয়। এ কারণে চীন বহুদিন বিএনপির ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। ২০১৬ সালে চীনের প্রবল প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ঢাকা সফরে এসে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম জিয়ার সাথে দেখা করার পর বিএনপির ওপর চায়নিজ ক্ষোভ প্রশমিত হয় বলে জানা যায়। তবে এ বিষয়টি এখনও পরিস্কার নয় যে, তৃতীয় কোনো দেশ থেকে ভিসা নিয়ে কোনো বাংলাদেশি যদি তাইওয়ান সফর করেন তাহলে সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে কিনা।
এই পটভূমিতে গত ২৩ মে জানা গেল যে বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে Except Israel শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি এতই আকস্মিক যে শিক্ষিত সচেতন মানুষ খবরটি শুনে স্তম্ভিত হয়েছে। এমন সময় খবরটি প্রকাশিত হলো যখন ফিলিস্তিনের গাজা নগরী ইসরাইলী বোমায় বিধ্বস্ত, এই নগরী ইসরাইলের রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত এবং ইসরাইলের হামলায় ৬৬ শিশুসহ ২৫৪ জন সিভিলিয়ান ফিলিস্তিনের জীবন প্রদীপ নির্বাপিত। এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্য এই সময় কেন বেছে নেওয়া হলো সেটা কারো বোধগম্য নয়।
যদিও সিদ্ধান্তটি প্রকাশিত হয়েছে ২৩ মে, কিন্তু পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে জানা যাচ্ছে যে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়েছে ৬ মাসের বেশি সময় আগে। জার্মান টেলিভিশন ‘ডয়চে ভেলের’ বাংলা প্রোগ্রামে এক সাক্ষাৎকারে জার্মানিস্থ বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত বলেন যে, এই সিদ্ধান্ত তো নেওয়া হয়েছে অনেক আগে। ইতোমধ্যেই লাখ খানেক পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে, যেখানে Except Israel শব্দ দুটি নাই। মানুষ আরো হতবাক হয়েছে এ কারণে যে, সিদ্ধান্তটি গ্রহণের আগে জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। এটি মন্ত্রিসভায় আলোচিত হয়েছে কিনা সেটিও পরিষ্কার নয়। কারণ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছেন যে, তিনি এটা জানতেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন যে, এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে ৬ মাস আগে। কেন নেওয়া হয়েছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন যে, আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে এটি করা হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই জবাবের পর আনুসঙ্গিক অনেক প্রশ্ন এসে গেছে। তাহলে এতদিন ধরে, অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্মের পর, এই ৫০ বছর ধরে কি আমাদের পাসপোর্ট আন্তর্জাতিক মানের ছিল না?
দুই
ইসরাইল বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য একটি স্পর্শকাতর বিষয়। বাংলাদেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল পাসপোর্টের এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ইসলামি দলসমূহ থেকে শুরু করে মধ্যপন্থী বিএনপি এবং বামপন্থী দলসমূহ এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই ইস্যুতে দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের মিডিয়ায় কম বেশি লেখালেখি হয়েছে।
সরকারের তরফ থেকে বলা হয় যে, হাতের লেখা পাসপোর্ট আন্তর্জাতিক মানের হয় না। কিন্তু হাতের লেখা পাসপোর্টের যুগের অবসান হয়েছে ১০ বছর আগে। চালু হয়েছে মেশিন রিডাবল পাসপোর্ট বা এমআরপি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদিও বলেছেন যে, এই সিদ্ধান্তটি তিনি জানতেন না, তারপরেও তিনি এই সিদ্ধান্তকে ডিফেন্ড করেছেন। তবে তাঁর ডিফেন্স তেমন জোরাদার হয়নি। তিনি বলেছেন, শব্দ দুটি বাদ দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। কেউ যদি সরকারের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ইসরাইলে যায় এবং সেটি যদি সরকারের নজরে আসে তাহলে শাস্তি দেওয়া হবে। প্রশ্ন হলো, কোন আইনে শাস্তি দেবেন? কারো মুখের কথা তো আইন হতে পারে না। এজন্য সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। এর সাথেই অনুসঙ্গ হিসাবে প্রশ্ন ওঠে, তৃতীয় কোনো দেশ থেকে কোনো বাংলাদেশি যদি ভিসা নেয় এবং ইসরাইল যায় এবং সেটা ধরা পড়ে তাহলে শাস্তি দেবেন কোন আইনে? ইসরাইলে যাওয়া এখনও যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয় তাহলে পাসপোর্ট থেকে Except Israel এই শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হলো কেন? কী প্রয়োজন পড়েছিল বাদ দেওয়ার?
বাংলাদেশে ইসরাইল বিরোধী সেন্টিমেন্ট এত প্রবল যে, ২০১৬ সালে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে ইসরাইলি কানেকশন থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। ঐ সময় দিল্লিতে ইসরাইলি পলিটিশিয়ান মেন্দি এন সাফাদির সাথে আসলাম চৌধুরীর সাক্ষাৎ ঘটে। আসলাম বলেন যে, তিনি ব্যবসার জন্য দিল্লি সফর করছিলেন। সেখানে কাকতালীয়ভাবে তাঁর সাথে মেন্দি এন সাফাদির সাক্ষাৎ ঘটে। দীর্ঘ ৬ বছর পর গত ৩০ মে হাইকোর্ট ৬ মাসের জন্য আসলাম চৌধুরীকে অস্থায়ী জামিন দেয়। এই জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে ৬ জুন জামিনে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের সাংবাদিক সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী তেলআবিব যাওয়ার প্রচেষ্টা নিলে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তার ৭ বছর কারাদন্ড হয়। সালাউদ্দিন শোয়েব গ্রেফতার হন বিএনপির শাসনকালে, আর আসলাম চৌধুরী আওয়ামী লীগের শাসনামলে। ইসরাইলের ব্যাপারে বাংলাদেশের সেই কঠোরতা এবং আপোসহীনতা থেকে বাংলাদেশ কি সামান্য পরিমাণে হলেও সরে আসছে?
তিন
আমরা জানি না, Except Israel শব্দ দুটি বাদ দেওয়ার ব্যাপারে আব্রাহাম অ্যাকর্ডের (Abraham Accord) কোনো ভূমিকা আছে কিনা। আব্রাহাম অ্যাকর্ড হলো আমেরিকা, ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে স্বাক্ষরিত যৌথ ইশতেহার। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট এটি স্বাক্ষরিত হয়। এই যৌথ ইশতেহারের মাধ্যমে আরব আমিরাত ইসরাইলের সথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, অর্থাৎ ইসরাইলকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়। আব্রাহাম অ্যাকর্ড স্বাক্ষরিত হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির শেষ দিকে। পরবর্তীতে একই কাতারে শামিল হয় বাহরাইন, সুদান ও মরোক্কো। এর আগে ১৯৭৯ সালে মিশর এবং ১৯৯৪ সালে জর্ডান ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমসমূহে এই মর্মে ফলাও করে খবর প্রচারিত হয় যে, হাজার হাজার কোটি ডলারের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যের টোপ এই সব দেশকে, বিশেষ করে আরব আমিরাতকে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, আব্রাহাম অ্যাকর্ডে পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে শামিল করার উদ্দেশ্যে এই দুটি দেশের ওপর আমেরিকার তরফ থেকে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টির দায়িত্ব দেওয়া হয় আরব আমিরাতকে। কয়েকদিন আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য তিনি প্রচন্ড চাপের মধ্যে আছেন। তবে যত চাপই আসুক, পাকিস্তান কোনো অবস্থাতেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবে না। বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরাইল ছাড়া’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়ার ব্যাপারে আব্রাহাম অ্যাকর্ডের কোনো ভ‚মিকা আছে কিনা সেটা জানা সম্ভব হয়নি।
চার
২ জুন, ‘দৈনিক নিউ এজের’ প্রথম পৃষ্ঠার খবরে প্রকাশ, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট গত ২৭ মে লিখিত এক চিঠিতে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশের সমর্থনের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি। আপনি বাংলাদেশের পাসপোর্টে বাদ দেওয়া ঐ চযৎধংব পুনর্বহাল করবেন, সেদিকে আমরা তাকিয়ে আছি।
আসলে এই খবরটি বাংলাদেশ সূত্রে জানা যায়নি। জানা গেছে ইরাইলের উল্লাসে। ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপ মহা পরিচালক গিলাড্ কোহেন সোল্লাসে বলেন, Great news! Bangladesh has removed the travel ban to Israel. This is a welcome step and called on the Bangladesh government to move forward and establish diplomatic ties with Israel, so both our peoples could benefit and prosper. বাংলা অনুবাদ: ‘দারুণ খবর! ইসরাইলের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশ উঠিয়ে নিয়েছে। এটি একটি অভিনন্দনযোগ্য পদক্ষেপ। আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানাবো, আরও এগিয়ে যেতে এবং ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে। এর ফলে উভয় দেশের জনগণ উপকৃত হবে এবং সমৃদ্ধি লাভ করবে।’
শেষ কথা। স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশ নয় মাস যুদ্ধ করেছে এবং লক্ষ লক্ষ প্রাণ ঝরেছে। অন্যদিকে স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনিরা ৭০ বছর ধরে যুদ্ধ করছেন এবং হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছেন। ফিলিস্তিনি রক্তকে আমরা যেন ভুলে না যাই।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।