পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মুসলিম বিশ্বের বিশিষ্ট নেতা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ স্পষ্ট ভাষায় মিয়ানমারের উদ্দেশে বলেছেন, এখন হয় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে, না হয় সেখানে তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন করে দিতে হবে। তুরষ্কে চার দিনের সফরকালে তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলুকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। তিনি মিয়ানমারের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, মিয়ানমার অনেকগুলো রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত। ব্রিটিশরা চেয়েছিল মিয়ানমারকে একসঙ্গে শাসন করতে। এ কারণেই অনেকগুলো রাজ্যকে এক করে বার্মা রাষ্ট্র গঠন করা হয়। তিনি বলেছেন, মালয়েশিয়া কোনো দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। তবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘটিত মিয়ানমারের গণহত্যায় মালয়েশিয়া চুপ করে বসে থাকতে পারে না। এছাড়া তিনি ফিলিস্তিন সমস্যা এবং চীনে উইঘুর মুসলমানদের পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ সফররত মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট খোয়ের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যর একটি প্রতিনিধি দল উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে। পরিদর্শন শেষে মিন্ট খোয়ে বলেছেন, শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে রাজি। সেখানে তারা ৪০ সদস্যের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করে। রোহিঙ্গারা তাদের বিভিন্ন দাবির কথা জানায়। তারা বলেছে, নাগরিকত্ব ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার নিরাপত্তা দিলে তারা স্বদেশ ফিরে যাবে। জবাবে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল বলেছে, ফিরে গেলে তাদের দাবিগুলো বিবেচনা করা হবে। মিয়ানমার প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা হিন্দু, খ্রিস্টানদের সঙ্গেও কথা বলেন। হিন্দু রোহিঙ্গারা কোনো দাবি বা শর্ত ছাড়া মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হয়েছে। তবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মতো খ্রিস্টান রোহিঙ্গারাও বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিয়েছে। আমরা মনে করি, মিয়ানমারের উচিত রোহিঙ্গাদের মৌলিক দাবির ভিত্তিতে প্রকৃত নাগরিকত্বের সুবিধা নিশ্চিত করে ফিরিয়ে নেয়া।
২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন চালায় তা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার এসব রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়। এতে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের অসভ্য ও বর্বর আচরণে জাতিসংঘসহ সারাবিশ্বে তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানসহ অনেক বিশিষ্টজনরা বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের করুণদশা দেখতে ছুটে আসেন। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে সহমর্মিতা প্রকাশ এবং মিয়ানমারকে ভৎর্সনা করে তাদের ফিরিয়ে নেয়ার আহŸান জানান। তাদের এসব নিন্দা ও আহŸান মিয়ানমার থোড়াই কেয়ার করে রোহিঙ্গা নির্যাতন অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর অনেকে মিয়ানমারকে মুখে মুখে ধমক দিলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাদের উদ্যোগ বক্তব্য ও মন্তব্য সর্বস্ব হিসেবে পরিগণিত হয়। মিয়ানমারের এই তোয়াক্কা না করার কারণ যে চীন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশটির আচরণ হয়ে পড়ে ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো। ‘এটা ঠিক হচ্ছে না’, ‘উচিত হচ্ছে না’র মতো কূটনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে তার দায়িত্ব সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। মিয়ানমার এই চীনের প্রশ্রয়েই জাতিসংঘসহ বিশ্বের কাউকে তোয়াক্কা করছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে মিয়ানমারের প্রতি চীনের প্রশ্রয় ও নিস্পৃহ থাকার কারণ তার বিশাল বিনিয়োগ ও ব্যবসা। অথচ বাংলাদেশেও তার ব্যাপক বিনিয়োগ এবং বাজার রয়েছে। দুইটি দেশ তার ঘনিষ্ট হওয়া সত্তে¡ও এক্ষেত্রে সে অনেকটা একচোখা নীতি অবলম্বন করে চলেছে। এ কথা বহুবার বলা হয়েছে, একমাত্র চীন উদ্যোগ নিলেই রোহিঙ্গা সমস্যা দ্রæত নিষ্পত্তি করা সম্ভব। চীন এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মহাসমস্যায় চীনের পাশে না থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক। চীনের আচরণে এটাই প্রতীয়মাণ হয়, মুসলমানদের প্রতি তার চরম বিদ্বেষ রয়েছে। সে যেমন তার দেশে উইঘুর মুসলমানদের প্রতি অমানবিক আচরণ করছে, তেমনি বিশ্বের অন্যান্য দেশে মুসলমানদের হত্যা, নীপিড়ন-নির্যাতনে নিশ্চুপ থাকছে। যেখানে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তার উদ্যোগই যথেষ্ট সেখানে সে উদাসীন হয়ে রয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে ওআইসিসহ মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা প্রত্যাশানুরূপ না হলেও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম নেতা হিসেবে ড. মাহাথির মোহাম্মদ রোহিঙ্গাদের পক্ষ হয়ে বলিষ্ঠ বক্তব্য দিয়েছেন। তার এ বক্তব্য অভিনন্দনযোগ্য। অন্যদিকে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্যাক ইন মাইন্ড’-এ যে উদ্দেশ্য থাকুক না কেন, কিছুদিন আগে দেশটির এক কংগ্রেসম্যান রাখাইনকে বাংলাদেশের অংশ করার প্রস্তাব করায় কিছুটা হলেও মিয়ানমারের টনক নড়েছে। সে এখন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ কখনোই অন্য কোনো দেশের ভূমি দখল বা আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায় না। সবার সাথে বন্ধুত্বই বাংলাদেশের নীতি। তবে এই বন্ধুত্বের নীতিকে প্রাধান্য দিয়ে অন্য দেশগুলোরও উচিত বাংলাদেশের ওপর আরেকটি দেশের চাপিয়ে দেয়া সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা। এক্ষেত্রে পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে চীনের কাছেই প্রত্যাশা বেশি। একমাত্র চীনই পারে রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রæত সমাধান করতে। চীন যদি বাংলাদেশকে প্রকৃতই বন্ধু মনে করে তবে তার উচিত হবে এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখা। দেশটিকে বুঝতে হবে, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বা নিজস্ব সৃষ্ট সমস্যা নয়। এটি অন্যদেশের অমানবিক আচরণে সৃষ্ট, যা আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছে। এই সমস্যা সমাধানে তার এগিয়ে আসা উচিত। তাকে এ কথাও উপলব্ধি করতে হবে, বাংলাদেশে শুধু বিনিয়োগ করলেই হবে না, বাংলাদেশের মানুষের সেন্টিমেন্টও বুঝতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।