পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশে নিষিদ্ধ কিন্তু নিষিদ্ধ নয় এমন একটি দ্রব্যের নাম জানতে চাইলে অনেকেই অকপটে বলবেন সেই নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন ব্যাগের কথা। ২০০২ সালে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতিকারক দিক বিবেচনা করে রফতানিমুখী শিল্প ব্যতিত সকল ধরনের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনকারী শিল্পের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিনের ব্যাপক আকারে ব্যবহার আগের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মুদি দোকান থেকে শুরু করে কাঁচাবাজার, মাছের বাজার, কিচেন মার্কেট সর্বত্রই নিষিদ্ধ পলিথিনের ছোট-বড় ব্যাগে ছড়াছড়ি। ফলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে। তরকারির বাজারে একশ গ্রাম কাঁচামরিচ ক্রয় করলেও বিক্রেতা ছোট একটি পলিথিন ব্যাগে ভরে তা ক্রেতাকে দেয়। বর্তমানে দেশে কতগুলো পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে ও এগুলোর উৎপাদন পরিমাণ কত তার কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কাছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেই। পরিবেশ অধিদফতরের এক প‚র্ববর্তী পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ১৯৯৩ সালে সারাদেশে ৪.৫ মিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হতো প্রতিদিন। ২০০০ সালে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯.৩ মিলিয়নে। বর্তমানে সর্বনাশা এই পলিথিনের ব্যবহার বেড়েছে ও বেড়ে চলছে লাগামহীনভাবে। প্রাথমিক এক হিসাবে এর পরিমাণ ১১.৭৫ মিলিয়ন।
বাংলাদেশ পলিপ্রপাইলিন প্লাস্টিক রোল এন্ড প্যাকেজিং এসোসিয়েশন নামে বৃহৎ একটি পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে সারাদেশে ১০০০টি পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনকারী ছোট-বড় অবৈধ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ৭০০টি ঢাকাসহ পুরাতন ঢাকার কোতয়ালী, চকবাজার, স‚ত্রাপুর, বেগমগঞ্জ ও মৌলভিবাজারে। এছাড়া ঢাকা শহরের মিরপুর, কাওরান বাজার, তেজগাঁও, কামরাঙ্গিরচর ও টঙ্গীতেও প্রচুর কারখানা রয়েছে। বাকি কারখানাগুলো চিটাগাং ও দেশের অন্যান্য জেলায় অবস্থিত। বিদেশ থেকে প্লাস্টিকের দানা ও পাউডার এনে কারখানাগুলোতে প্রতিদিন অগণিত ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের ব্যাগ তৈরি হচ্ছে ও তা সকল আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপণন ও দেদারছে ব্যবহার হচ্ছে। ২০০২ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর বাজার থেকে কিছু পলিথিন ব্যাগ আটক করার পর সরকারের সকল কার্যক্রম রহস্যজনকভাবে থেমে যায়। এরপর আইন ভঙ্গ করে যারা পলিথিন উৎপাদন, বিক্রয় ও ব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কোনো আইনগত প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না।
সরকার ২০০০ সালে পরিবেশ রক্ষা আইন-১৯৯৫ পরিবর্তন করে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে পলিথিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও ছয় মাসের কারা প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করে। কিন্তু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি আটক ও কারখানা সীল করার ক্ষমতা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রদান করা হয়নি। এদিকে পরিবেশ আদালতকে দোষী ব্যক্তিকে ১০ লাখ টাকা অর্থ দন্ড অথবা ১০ বছরের কারাদÐে দÐিত করার ক্ষমতা অথবা উভয় দÐে দÐিত করার ক্ষমতাও প্রদান করা হয়। পরিবেশ আদালতকে কারখানার যন্ত্রপাতি আটক করে তা বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতাও প্রদান করা হয়, যা অন্যকোনো আদালতের নেই। যে পলিথিন আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই পলিথিন কিভাবে প্রতিদিনই নদী-পানি-কৃষিজমি ইত্যাদি নষ্ট করছে, শহরাঞ্চলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে ও মানবজীবনকে বিপর্যস্ত করছে তা ভাবতেও অবাক লাগে।
প্রকাশ্যেই আইন ভঙ্গ করে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের রহস্যজনক নিরবতা বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। এরই ধারাবাহিকতায় বৃদ্ধি পাচ্ছে পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিথিনের ব্যাপকতা। এর ভয়াবহতা দেশের লোকজনকে আর কতকাল দেখতে হবে তা বুঝা যাচ্ছে না। পরিবেশবাদী ও সুশীল সমাজের কথা পৌঁছে না প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ লোকদের কানে। জাতীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও বিপণনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের আর্থিক লেনদেনের কারণে দীর্ঘ সাত থেকে আট বছর যাবৎ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে। তেজগাঁওস্থ বাংলাদেশ সিরামিক এন্ড টেকনিকাল কলেজের প্রিন্সিপাল রফিকুল ইসলাম বলেন, বিপন্ন পরিবেশকে দ্রæত রক্ষার জন্য আজই সারাদেশ থেকে পলিথিনের ম‚লোৎপাটন করা জরুরি। পলিথিনের স্থলে পাট, কাগজ ও চটের ব্যাগ যা সহজে মাটিতে পচনশীল সেগুলো ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। এগুলো পচলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। পলিথিন ব্যাগ মাটিতে পচে না বলে তা মাটির ঊর্বরতা নষ্ট করে। মাটিকে উত্তপ্ত করা ও গাছের ম‚ল মাটির গভীরে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে পলিথিন। পুকুরের তলদেশে জমে থাকা পলিথিন মাছ ও জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব সঙ্কট সৃষ্টি করে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর তলদেশে জমে থাকা কয়েক ফুট পলিথিনের স্তর নদীর তলদেশের পলি আটকিয়ে শুধু নদীর নাব্যতাই নষ্ট করছে না বরং মাছ ও জীববৈচিত্র ধ্বংস করে পানিতে স্বাভাবিক অক্সিজেনের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস করছে। কৃষি পলিথিন ব্যাগ জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।
ঢাকা শহরের পয়ঃনিঙ্কাশনের ৮০ভাগ ড্রেন পলিথিন ব্যাগ কর্তৃক জমাট বেঁধে আছে। যার দরুন সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরে দেখা দেয় অসহনীয় জলাবদ্ধতা। বৃষ্টির সময় অনেক মেনহোল থেকে শত শত পলিথিন ভেসে বের হতে দেখা যায়। ড্রেনেজ সিস্টেমকে সর্বদাই অচল করে রাখে। স¤প্রতি ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার তলদেশ থেকে বর্জ্য অপসারণের যে কর্মস‚চি নেয়া হয়েছিল তাতে দেখা যায় যে, উত্তোলনকৃত বর্জ্যের অধিকাংশই পলিথিন ব্যাগ। আগে থেকে সর্বনাশা পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হলে নদীর তলদেশ থেকে বর্জ্য উত্তোলনের জন্য ২০৬ কোটি টাকা বাজেট করতে হতো না। বেঁচে যেত সরকারের ২০৬ কোটি টাকা, যা একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিরাট ব্যাপার। শুধু বুড়িগঙ্গাই নয়, ঢাকার চারদিক দিয়ে প্রবাহিত সকল নদীর তলদেশেই পলিথিনের দ‚ষণ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চলছে লাগামহীনভাবে। নদী থেকে শুরু করে শাখা নদী ও ছোট ছোট খাল বিল জলাশয়ের তলদেশেও রয়েছে পলিথিন ব্যাগের মোটা স্তর। নষ্ট হচ্ছে পানির প্রাকৃতিক গুণ। কৃষিক্ষেত্রে পলিথিন ব্যাগ স‚র্যের আলোকে ফসলের গোড়ায় পৌঁছতে বাধা দেয়। ফলে মাটির ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া মরছে না বলে কৃষিজমিতে উৎপাদন কমে আসছে। কিছুদিন আগেও পরিবেশ অধিদফতর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়। দফতর থেকে আরও বলা হয় যে, ৩৫ মাইক্রোন পুরুত্বের পলিথিন এবং প্যাকেজিং ও রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যাবহৃত পলিথিন ব্যাগ ছাড়া সকল ধরনের পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধের বিরামহীন কর্মস‚চি নেয়া হচ্ছে। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে সরকারের এই মহৎ কর্মস‚চি উদ্যোগ বা বন্ধ হয়ে গেল। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্য আরামদায়ক বলে কেউ পরিবেশের কথা ভাবছে না। চুটিয়ে চলছে এর ব্যবসা ও ব্যবহার। আর এ অবস্থা কিছুতেই চলতে দেয়া যায় না। নিষিদ্ধ পলিথিন যেন নিষিদ্ধই থাকে এর সব রকম ব্যবস্থা সরকারের এখনই নেয়া উচিৎ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও নিয়মিত তদারকির অভাবে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের অবস্থায় চলে এসেছে। নিষিদ্ধ হওয়ার প্রথমদিকে এর বিরুদ্ধে ইতিবাচক সাড়া মিললেও ব্যবহার বন্ধে স্থায়ী ব্যবস্থা না নেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পলিথিনের যেসব বিকল্পের কথা বলা হচ্ছে, তা খুবই অপ্রতুল। এসব বিকল্প দিয়ে এত ব্যাপক চাহিদা প‚রণ সম্ভব নয়। ব্যাপক চাহিদার কারণেই ঠেকানো যাচ্ছে না পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন। সবকিছুতেই এর ব্যবহার এত ব্যাপক যে, বিকল্প কোন কিছুই এর চাহিদা প‚রণ করতে পারছে না। কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ থাকলেও পলিথিনই যেন বাস্তবতা। ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার এবং লাগাতার অভিযান চালিয়েও রোখা যায়নি পলিথিনের আগ্রাসন। মানুষের হাতে হাতে ফিরে এসেছে পলিথিন। সারাদেশে বিভিন্ন প্রকার শপিংব্যাগ ব্যবহারকারীর শতকরা ৮০ ভাগই পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছেন। খোদ রাজধানীতে প্রতিদিন ব্যবহার হচ্ছে এক কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ।
তাই পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযানের পাশাপাশি পলিথিন ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও ভাবতে হবে। উন্নত বিশ্বে নিষিদ্ধ না করেও শুধু পলিথিন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশকে মুক্ত রাখা হয়েছে। ক্ষতিকর পলিথিন থেকে বাঁচতে হলে বিকল্প ব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা এবং ব্যাপকভাবে জনসচেতনতাম‚লক কার্যক্রম গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এর উৎপাদন ও ব্যবহার না কমার বিষয়টি উদ্বেগজনক। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই পণ্য ব্যবহারে জনগণের মধ্যেও অনীহা লক্ষণীয় নয়। এ জন্য জনসচেতনতা খুব জরুরী। যারা পলিথিন উৎপাদন, বিক্রয় ও ব্যবহার করছেন তারা অনেকে হয়ত ভুলেই গেছেন বাংলাদেশে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে যারা আইন প্রয়োগ করে পলিথিন বন্ধ করবে সেই পরিবেশ অধিদফতরও। অধিদফতরটির কর্মকর্তারাও বুঝে উঠতে পারছে না কোন্ পলিথিন বন্ধ করবেন আর কোন্টা ব্যবহারে অনুমতি দেবেন। সরকারকেই এ ব্যাপাওে সচেষ্ট হতে হবে। তবেই হয়তো নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার কমে আসবে।
লেখক : সাংবাদিক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।