Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মোবাইল আসক্তি শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর

ইছমত হানিফা চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৬ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

স্মার্ট ফোন এখন নিত্য প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। করোনা মহামারির লকডাউনের সময়ে এর ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণ। প্রায়ই দেখা যায়, অভিভাবকরা বাচ্চাকে শান্ত রাখার জন্য তার হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব দেন। গান, কার্টুন বা মজার ভিডিও চালিয়ে দিয়ে তাকে শান্ত রাখা হয়। আবার স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অনলাইন ক্লাসের কারণে বাধ্য হয়েই অনেকে শিশুর হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্টফোন। দিনের অনেকটা সময় শিশুদের হাতে স্মার্টফোন থাকার কারণে এক ধরনের আসক্তি জন্মাচ্ছে তাদের মধ্যে। এই আসক্তি থেকে সহজে ফিরে আসা সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুদের বয়স আট নয় মাস, তখনও মায়েরা শিশুকে শান্ত করতে হাতে মোবাইল অথবা ট্যাব দিয়ে, কোন কার্টুন কিংবা অন্য কিছু দেখিয়ে শান্ত করতে চান। এ বিষয়ে বলতে গিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান সাহিদা আনোয়ার বলেন, মোবাইলের প্রতি আসক্তি শিশুদের সামাজিক দক্ষতা নষ্ট করেছে, যার জন্য শিশুদের নানান ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া এ আসক্তির ফলে শিশুদের নানা শারীরিক সমস্য হচ্ছে। মোবাইল বা ট্যাবের দিকের দৃষ্টি দিয়ে দীর্র্ঘ সময় বসে থাকার ফলে শিশুদের স্থূলতা বেড়ে যাচ্ছে। শিশুরা সামজিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। তাই মায়া মমতার জায়গা অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। শিশুদের এইভাবে বেড়ে ওঠা ভবিষতের জান্য অশনিসংকেত। কাছের মানুষের আদর-ভালবাসায় বেড়ে ওঠা শিশুরা বড় হয় মানবিক গুণাবলীর অধিকারী হয়ে। কিন্তু এই প্রযুক্তির অপব্যবহার শিশুদের অমানবিক করে তুলছে। দুই বছর করোনার কারণে অনলাইন ক্লাসের জন্য এই ফোন আমাদের সবার খুব প্রয়োজনে হাতের নাগালে ছিল। আগে বড়রা ফোন তত বেশি ছোটদের হাতে দিতেন না। এখন সবাই অনায়সে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু অনেকে ক্লাসের বা পড়ার কথা বলে, সেই স্মার্ট ফোনে, পাবজি কিংবা ফ্রি-ফায়ার গেইম খেলতে লেগে যায়। যে গেইমগুলো শিশুদের মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তা কখনো খেলা উচিত নয়। কিন্তু যারা এইসব গেইমে আসক্ত হয়ে যায়, তারা অনেকেই বুঝতে পারে না।

স্মার্টফোন খুব দরকারি একটা জিনিস। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই যে, আজকে বৃষ্টি হবে কিনা তা খুব সহজে এ থেকে জানা যায়। কোথায় কী হচ্ছে, আমরা স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে তা জানতে পারি। কিন্তু সব ব্যাপারে, মানে যে কোন বিষয়ে অপরিমিত কিছু ভালো না। যা যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু হওয়া উচিত। এখন আসা যাক আসক্তি প্রসঙ্গে। আসক্তি হচ্ছে যে কোনো বিষয়কে নেশার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। স্মার্টফোন আসক্তি হচ্ছে সেই অবস্থা বা পরিস্থিতি প্রয়োজন ছাড়া অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে কেউ মোবাইল ব্যবহার করছে। মোবাইল ছাড়া ৫ মিনিট থাকতে না পারাই আসক্তি। এই ব্যাপারটা শুধু যে অল্প বয়সীদের হয় তা কিন্তু না, অনেক সময় বড়রাও এমন আসক্তিতে পড়ে যায়, যা কারো জন্য ভালো নয়। শিশুরা দেশের সম্পদ। তাদের সুন্দরভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পরিবার ও স্কুলের শিক্ষকদের। দিন দিন যেমন মানুষ স্মার্টফোননির্ভর হয়ে যাচ্ছে, তেমনি শিশুদের মোবাইল আসক্তি দিন দিন বাড়ছে, যা অভিভাবক তথা সমাজের জন্য বিরাট বড় চিন্তার কারণ হয়ে যাচ্ছে। আবার দীর্ঘ সময় মোবাইল ট্যাব অথবা কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে শিশুর চোখ কিংবা মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তাই এটা যখন প্রয়োজনে তখন ব্যবহার করতে দিতে হবে। এই যে, জায়গা স¦ল্পতার কারণে ছোট বাসায় আমরা বাস করি, সেখানে খেলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। অনেক সময় এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে শিশুদের স্মার্ট ফোনে খেলাধুলা করতে দিতে হয়, যা তাদের জন্য ক্ষতিকর। পরিবারে মা-বাবা, বড় ভাই-বোন, ঘরের কনিষ্ঠজনের জন্য বেশি সময় দিতে পারেন। ঘরের ভিতরে চাইলে কিছু খেলা করা যায়। আবার সুন্দর সুন্দর বই হতে পারে শিশুর বিনোদনের উৎকৃষ্ট মাধ্যম। বইয়ের চেয়ে ভালো বন্ধু আর নাই। প্রযুক্তির এই গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কল্যাণে আমাদের জীবন যাপন অনেক সহজ হয়েছে। তবে এর ক্ষতিকর দিকও ইদানিং উন্মুচিত হচ্ছে বড় আকারে। শিশুদের মোবাইলের প্রতি আসক্তির অবশ্য অনেক কারণে হচ্ছে। সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের সময় না দেওয়া এর মধ্যে অন্যতম। বেশিরভাগ বাবা-মা ব্যাস্ত থাকেন চাকরি বা ব্যবসার কাজে। অগত্যা মোবাইল দিয়ে বসিয়ে দেন। আবার এমনো হয়, অনেক মা সন্তান খেতে না চাওয়ায়, মোবাইল ফোন হাতে দেন। তারা ইউটিউবে গান শুনতে শুনতে বা কার্টুন দেখতে দেখতে খায়, এইভাবে ভুলের শুরু। এরপর দেখা যাচ্ছে, এই বিষয়গুলো আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, শিশুদের হাতে মোবাইল ফোনসহ কোনো ইলেকট্রক্সি গেজেট দেওয়া উচিত নয়। এতে শিশুদের দেহে নানান রোগের জন্ম হয়। নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ ডা. প্রাণগোপাল দত্ত বলেন, মোবাইল ফোন শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টি শক্তির ভীষণ ক্ষতি করে। যেসব শিশু দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘণ্টা মোবাইল ফোনে ভিডিও গেম খেলে, খুব অল্প বয়সে তারা চোখের সমস্যায় পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা যায়, ১১ বছর বয়সী শিশুদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭০ জন মোবাইল ফোন নিয়মিত ব্যবহার করে। আরেক গবেষণায় উঠে এসেছে, মোবাইলের প্রতি আসক্তি শিশুদের সামাজিক দক্ষতা নষ্ট করছে। শিশু নিজ পরিবারের সাথে গল্প-গুজব করা, প্রয়োজনে এগিয়ে যাওয়া, সবার সঙ্গে মিশতে পারা ইত্যাদি দক্ষতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে। সে ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা শিশুদের এই আসক্তি থেকে সরিয়ে আনতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে পারেন। বড়রা সৃজনশীল নানা ধরনের খেলার মাধ্যমে তাদের খেলার সঙ্গী হতে পারেন। শ্রেণিভিত্তিক পাঠ্য বই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অর্থাৎ খুব ছোট ক্লাস থেকে যদি প্রতি ক্লাসের পাঠ্য বইয়ে গল্প-প্রবন্ধ থাকে, তবে শিশুরা খুব সহজে এ আসক্তি থেকে দূরে সরে আসতে পারে।

লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মোবাইল আসক্তি শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর
আরও পড়ুন