পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারতের উত্তর পূর্বের সব থেকে বড় রাজ্য আসাম। অসমিয়ারা আসামের প্রধান জনগোষ্ঠী হলেও সেখানে অসংখ্য বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর বাস। আর এই ভাষার ভিত্তিতে তৈরি জাতিগত বিভেদের জেরে আসামে দাঙ্গা হয়েছে বহু বার।
১৮৭৪ সালে ব্রিটিশরা বরাক উপত্যকা, তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সিলেট জেলা, উত্তরের রংপুরের গোয়ালপাড়া মহকুমাকে আসামের সাথে যোগ করে আসাম প্রদেশ গঠন করে। আসামকে প্রদেশ গঠনের পর ব্রিটিশরা এর উন্নয়নের প্রতি নজর দেয়। কিন্তু তখন আসামের বেশির ভাগ এলাকা ছিল জঙ্গলে আবৃত। বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। এমনকি সেখানে কোন আদিবাসীরাও বসবাস করত না। আসাম কৃষি পণ্য উৎপাদনেও তখন পিছিয়ে ছিল। ব্রিটিশরা তখন পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট জেলা থেকে লাখ লাখ ভূমিহীন কৃষককে আসামে স্থানান্তরিত করে তাদেরকে কৃষি কাজে নিয়োজিত করে এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেয়। পূর্ববঙ্গের কৃষকদের পরিশ্রম এবং অনেক শ্রমিকের জীবনের বিনিময়ে আসামের গোয়ালপাড়া, কামরূপ, তেজপুর ইত্যাদি জেলা চাষাবাদের উপযোগী হয়ে উঠে।
আসামের উন্নতিতে অবদান রাখার কারণে প্রথম দিকে আসামের জনগণ বাঙালিদের মেনে নিলেও পরবর্তীতে শিক্ষা, সংস্কৃতিতে বাঙালিরা উন্নতি করতে থাকলে স্থানীয় জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। এছাড়া ব্রিটিশরা বাংলা ভাষাকে স্থানীয় মূল ভাষা আর শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল যেখানে আসামের মাত্র ১৯% মানুষ ছিল বাঙালি। এর ফলে অসমীয়াদের মধ্যে ধীরে ধীরে ক্ষোভের সঞ্চয় হয়। পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ব্রিটিশ শাসন শেষ হবার পর পরই। ১৯৫০ সালে গোয়ালপাড়ায় শুরু হয় “বাঙালী খেদা আন্দোলন”। তখন থেকে অসমিয়াকে রাজ্য ভাষা বানানোর জোর দাবি উঠে। আসামে বাঙালি কৃষকদের কোণঠাসা করার জন্য তখন চালু করা হয় লাইন প্রথা। এ সময় বাঙালি কৃষকদের ভূমির সীমারেখা বরাবর লাইন টেনে দেয়া হয় এবং প্রথা অনুযায়ী বাঙালি কৃষকরা লাইনের বাইরে আর কোন জমির বন্দোবস্ত করতে পারত না। এই অন্যায় অন্যায্য প্রথার বিরুদ্ধে জোড়াল প্রতিবাদ করেন তৎকালীন আসামের পার্লামেন্টের সদস্য ও আসামের মুসলিম লীগের সভাপতি মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি। এর ১০ বছর পর ১৯৬০ সালের এপ্রিলে অসমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্য ভাষা করার সিধান্ত গ্রহন করা হয়। আসামের কাছার জেলার শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে হাজার হাজার বাঙালি বাস করত। কিন্তু বাঙালিদের জন্য আলাদা রাজ্য থাকা স্বত্বেও তাদের রাজ্যে বাঙালিদের ব্যাপক উপস্থিতি তারা মেনে নিতে পারে নি। সে বছর জাতিগত দাঙ্গায় হাজার হাজার বাঙালি পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়। দাঙ্গা রূপ নেয় গণহত্যায়। এর পর ১৯৭২ সালেও আসামে বড় ধরনের জাতিগত দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ১৯৮৩ সালের গোহপুরে গণহত্যার শিকার হয় বাঙালিরা যা আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপক নিন্দিত হয়েছিল। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারত থেকে আসামের বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হলে ১৯৮৫ সালে ভারত ও আসাম সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। যা আসাম অ্যাকর্ড নামে পরিচিত। দেশের অন্যত্র নাগরিকত্বের নিয়ম হল যারা ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে ভারতে এসেছেন তারা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন। তবে আসামের ক্ষেত্রে বৈধ নাগরিক হিসেবে শুধুমাত্র তারাই বিবেচিত হবেন যারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত সেখানে গিয়েছিলেন।
১৯৫১ সালে আসামে শুরু হয়েছিল ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স বা এনআরসি। প্রতি দশ বছর পর পর এনআরসি হওয়ার নিয়ম থাকলেও ১৯৫১ সালের পর আবার ২০১৫ সাল এনআরসি এর হাল নাগাদ শুরু হয়। এখানে নাগরিকদের কাছে যে তথ্যগুলো চাওয়া হয়েছে সেগুলো হল- ১৯৫১ সালের জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণের নথি অথবা ২৪ মার্চ ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত ভোটার তালিকার নথি, জমি ও প্রজাস্বত্ব নথি, নাগরিকত্বের প্রশংসাপত্র, স্থায়ী আবাসিক প্রশংসাপত্র, পাসপোর্ট, এলআইসি, কোন সরকারি লাইসেন্স বা সার্টিফিকেট, সরকারি চাকরির নথি, ব্যাংক বা পোষ্ট অফিসের অ্যাকাউন্টের নথি, জন্মের প্রশংসাপত্র, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশংসাপত্র এবং আদালতের যেকোন নথি। আসামের দুর্গম প্রান্তিক শহরের অশিক্ষিত মানুষগুলো এই নথিগুলো দেখাতে ব্যর্থ হলে তার আর আসামের তথা ভারতের নাগরিক বলে বিবেচিত হবেন না। নিজ ভূমিতে শরণার্থী বা অবৈধ অনুপ্রবেশকারি হিসেবে বিবেচিত হবেন তারা।
তালিকায় নিজেদের নাম উঠানোর জন্য আবেদন করে ৩ কোটি ২৯ লক্ষ মানুষ। ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই নাগরিক পঞ্জির খসড়া প্রকাশিত হলে দেখা যায় ২ কোটি ৮৯ লক্ষ মানুষকে ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং ৪০ লক্ষ মানুষকে অনাগরিক হিসেবে চিনহিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় আরও ১ লক্ষ ব্যক্তিকে ভারতের অনাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ মাসের ৩১ তারিখ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা। যদিও আসামের বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির কারণে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের সময়সীমা এক মাস বাড়ানোর জন্য রাজ্য ও কেন্দ্র থেকে আবেদন করা হয়েছে । এর ফলে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হতে আরও কিছু সময় লাগবে। কিন্তু তালিকা যে দিনই প্রকাশিত হোক না কেন সেটি প্রকাশ হওয়ার পর তালিকায় না থাকা ব্যক্তিরা আর নিজেদেরকে ভারতের নাগরিক হিসেবে দাবি করতে পারবেন না। যদিও হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা বিশেষ আইনের সহায়তায় নাগরিকত্ব ফিরে পাবেন ।
আসামের জাতিগত দ›দ্ব ছিল বাংলা ভাষাভাষীদের কেন্দ্র করে। যেখানে হিন্দু বা মুসলমান নয় নির্যাতিত হয়েছিল বাঙালিরা। যেটি ২০১৪ সালে এসে নুতন রূপ ধারণ করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদী বলেন বিজেপি সরকার গঠন করলে আসামে অনুপ্রবেশকারি মুসলিমদের বের করে দেয়া হবে। এখানে লক্ষণীয় মোদী আসামের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি নুতন রূপ দিলেন। শুধু মাত্র মুসলমান বাঙালিদের টার্গেট করে উসকে দিলেন সা¤প্রদায়িকতা।
সে জন্য ২০১৬ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এনে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন বদলের প্রস্তাব করা হয়। নুতন আইনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে বলা হয়। কিন্তু এই ইস্যুটিতে মোদী তার সকল মিত্রদের সমর্থন লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আসামে বিজেপির জোটসঙ্গী অসম গণপরিষদ (অগপ) নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির শরিক দল শিবসেনা এই বিলের বিরোধিতা করেছে। তারা বাঙালি হিন্দু কিংবা মুসলমান উভয়কেই নাগরিকত্বের দেয়ার বিরোধী। তাদের আশংকা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ায় বাংলাদেশী হিন্দুদের মধ্যে ভারতে যাওয়ার প্রবনতা বৃদ্ধি পাবে । মোদী নিজের ভোট ব্যাংক বাড়ানোর জন্য এমনটি করেছেন বলে মনে করে বিরোধীরা। এখানে লক্ষণীয় আসামের রাজনীতিতে এখনও ভাষার ভিত্তিতে যে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল তাই বিদ্যমান আছে। কিন্তু মোদী সেখানে ধর্মীয় বিভাজন টেনে এনেছেন।
এখন আমাদের চুপ করে বসে থাকলে হবে না। কারণ ভারত যতই বলুক এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার আমরা পশ্চিম বঙ্গে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে যখন বলতে শুনছি- “গলা ধাক্কা দিয়ে সবকটাকে বাংলাদেশে পাঠাবো” তখন আমাদের দুশ্চিন্তা না হওয়াটা অস্বাভাবিক। অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতে বাস করা ভারতের নাগরিকদের কিছু কাগজপত্র বা উপযুক্ত প্রমানাদির অভাবে গলা ধাক্কা দিয়ে এ দেশে পাঠানোর মত একটি সিধান্ত মোদী সরকার নিবে বলে মনে হয় না। কারণ উপযুক্ত প্রমানের অভাব এটা প্রমাণ করে না যে তারা ভারতের নাগরিক নয়।
লেখক: কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।