শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
কবি আহসান হাবীব বাংলাদেশের বিশিষ্ট আধুনিক কবি যিনি দেশ বিভাগের আগেই সমকালীন কবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবন যন্ত্রণা আহসান হাবীবের কবিতার মূখ্য বিষয়। সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রামী চেতনা ও সমকালীন যুগ যন্ত্রণা তাঁর কবিতায় শিল্প সম্মতভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। তাঁর ভাষা ও প্রকাশ ভঙ্গিতে নাগরিক মননের ছাপ আছে।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ একাদশ শ্রেণীর ছাত্র থাকার সময় কলেজের পাট শেষ না করেই জীবনের সন্ধানে কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হন। আর আহসান হাবীব উচ্চমাধ্যমিকের পর আর পড়তে না পেরে একই কারণে কলকাতায় এসে হাজির হন। এই উভয় কবি ও লেখক মহানগরে এসে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন। এই মহানগরে প্রথমে পড়তে ও পরে কর্মে যোগ দিতে আসেন আরেকজন লেখক শওকত ওসমান। তাঁর কাছে কলকাতা অবশ্য তেমন পরও দূরের নয়। কারণ, তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। অবশ্য ভারত ও বঙ্গ বিভক্তির পর আহসান হাবীব ও শওকত ওসমান দুজনই পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। একই তারিখে জন্ম হলেও আহসান হাবীব মারা যান ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই। আর শওকত ওসমানের মৃত্যু হয় ১৯৯৮ সালের ১৪ মে।
আহসান হাবীব নিজেই তাঁর কবি হওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে নিজের কবিতার পঙ্ক্তিতে লিখেছেন:
শহর পিরোজপুর
সরকারি স্কুলের খেলার মাঠ
পশ্চিমে প্রশাসকদের বাড়িঘর
পূর্বে স্কুল-বাড়ি, সামনে বাগান,
তার সামনে পুকুর,
উত্তরে আদালত কাছারি,
দক্ষিণে উকিল মোক্তার ইত্যাদি,
মাঠে রাত নয়টার অন্ধকার,
দু-হাটুতে জোড়া হাত
তার ওপর কপাল
আমি একদিন কেঁদেছিলাম।
তখনকার সাম্প্রদায়িক বাস্তবতার তাঁর শিক্ষক বরদা চক্রবর্তীও কোনো মুসলমান ছেলের ‘কবি’ হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেন নি। শ্লেষে ঝলসে উঠে শ্রেণিকক্ষে সবার সামনে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুই কপি হয়েছিস, কপি?
কিন্তু বৈরী ও বন্ধুর পথ মাড়িয়ে ও তা পেরিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। উত্তরকালে পূর্বকালের কথা মনে রেখে ‘দুই হাতে দুই আদম পাথর’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:
সেই যে সময়, জীবনের একমাত্র সময়,
যখন হঠাৎ একজন পথে উৎসাহে
তর্জনী তুলে সঙ্গীকে বলেন,
ওই যে ছেলেটি, ওই শাদা শার্ট, বই হাতে
এ নাকি এখনই সুন্দর কবিতা লেখে
মাঝে মাঝে শহরের পত্রিকায় ছাপা হয়, ‘তুমি দেখে নিও, ও একদিন বড় হবে’।
জীবনের নানা দর্পিত সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন বলে শেষ পর্বে তাঁর কবিতার বইয়ের নাম হয়েছে ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’। কিন্তু প্রথম পর্বে যখন তার কবিতার বইয়ের নাম হয় ‘আশায় বসতি’, তখন বোঝা যায়, এই কবির প্রসন্ন মুখ ও স্মিত হাসি তাঁকে জীবনের দিকে ডাকে। পরে যে তিনি তাঁর কবিতার বইয়ের নাম রাখেন মেঘ বলে চৈত্রে যাবো, তখন সুন্দর ও অসুন্দর দ্বন্দের যে দ্বৈরথ চলে, তা তাঁকে অগ্রসর জীবনের আহ্বান জানায়।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুরের শংকর পাশা গ্রামে কবি আহসান হাবীব জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিরোজপুর থেকে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উর্ত্তীন হন। এরপর কিছুদিন বরিশালের বি.এম কলেজে আই, এ ক্লাসে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে লেখাপড়া ত্যাগ করে কলকতায় গিয়ে সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করেন এবং আজীবনই এই পেশায়ই নিয়োজিত ছিলেন। কলকাতায় তিনি তকবির (১৯৩৯-১৯৪৩ খ্রি.), বুলবুল (১৯৩৭-১৯৩৮ খ্রি.) ও সওগাত (১৯৩৯-১৯৪৩ খ্রি.) পত্রিকায় কাজ করেন। তিনি অধূনালুপ্ত ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বাংলা’র সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। সমকালীন জীবন ও সমাজের বাস্তবরূপ তাঁর কবিতায় সহজ সরল ভাষায় রূপ লাভ করেছে। তিনি বাংলাদেশের একজন অগ্রগণ্য কবি।
গভীর জীবন বোধ ও আশাবাদ তাঁর কবিতাকে বিশিষ্ট ব্যঞ্জনা দান করেছে। তাঁর কবিতার স্নিগ্ধতা পাঠক চিত্তে এক মধুর আবেশ সৃষ্টি করে। তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং আর্ত মানবতার স্বপক্ষে বক্তব্য রেখেছেন।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি আকাশ বাণী কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর ঢাকায় এসে তিনি বিভিন্ন সময়ে আজাদ, মোহাম্মদী, কৃষক, ইত্তেহাদ প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন।
আহসান হাবীব আধুনিক কাব্য ধারার কবি ছিলেন। তাঁর কাব্য চর্চার শুরু বাল্যকাল থেকেই। সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়ন কালে ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম লেখা একটি প্রবন্ধ “ধর্ম” প্রকাশিত হয়। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম কবিতা “মায়ের কবর পাড়ে কিশোর” ছাপা হয় পিরোজপুর গর্ভনমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে।
আহসান হাবীবের প্রথম কবিতার বই “রাত্রি শেষ” প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হলো, ছায়া হরিণ (১৯৬২ খ্রি.), সারা দুপুর (১৯৬৪ খ্রি.), আশার বসতি (১৯৭৪ খ্রি.), মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬ খ্রি.), দুইহাতে দুই আদিম পাথর (১৯৮০ খ্রি.), প্রেমের কবিতা (১৯৮১ খ্রি.), বিদীর্ন দর্পনে মুখ (১৯৮৫ খ্রি.) ইত্যাদি।
আহসান হাবীবের কবি জীবন রোমান্টিকতার অনুসারী। তবে তা সমাজ ভাবনা বিচ্ছিন্ন নয়। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল প্রায় প্রবাদতুল্য। এ দেশের বহু লেখক ও কবির জীবনের প্রথম রচনা তাঁর হাত দিয়েই প্রকাশিত হয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে তাঁর প্রচেষ্ঠা ছিল অগ্রগণ্য।
প্রধানতঃ কবি হলেও তাঁর লেখা কিছু উপন্যাস ও অনুবাদ গ্রন্থ ও রয়েছে। তাঁর দুইটি বিশিষ্ট উপন্যাস হলো অরণ্য নীলিমা (১৯৬০ খ্রি.), রানী খালের সাঁকো (১৯৬৫ খ্রি.)। তাঁর অনুবাদ গ্রন্থ- প্রবাল দ্বীপে তিন বন্ধু (১৯৫৮ খ্রি.), অভিযাত্রিক কলম্বাস (১৯৫৯ খ্রি.) ইন্দোনেশিয়া (১৯৬৬ খ্রি.) এবং তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ দুটি হলো, বিদেশের সেবা গল্প (১৯৬৬ খ্রি.) ও কাব্যলোক (১৯৬৮ খ্রি.)।
শিশু কিশোরদের জন্য তিনি প্রচুর ছড়া ও কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতায় ছন্দ ও শব্দ সহজেই পাঠকের মন কাড়ে। কাঁর কয়েকটি উল্লেখ যোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ হলো- জোৎনা রাতের গল্প (১৯৬৭ খ্রি.), বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর (১৯৭৭ খ্রি.), ছুটির দিন দুপুরে (১৯৭৮ খ্রি.) ইত্যাদি।
মানুষের জীবনে চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে নানা বৈচিত্র ও আনন্দ। এ আনন্দময় বিচিত্র জীবন থেেেক বেচেঁ থাকার সুখ ও সার্থকতা খুজঁতে হবে। কবি আহসান হাবীবের “আনন্দ” কবিতায় আনন্দের নানা উৎসের কথা বলা হয়েছে-
আনন্দ রে আনন্দ বল, কোথায় রে তোর বাসা,
তুই কি আমার মা, নাকি তুই মায়ের ভালবাসা?
বাবার হাতে তুই কি উথাল মাটিতে ধান বোনা?
মায়ের হাতে কুলোয় ভরা ধানের মত সোনা?
তুই কি আমার ঘরের চালে ফুরিয়ে যাওয়া রাত?
তুই কি আমার সান্কি ভরা ফুলের মত ভাত
আহসান হাবীবের কবিতায় একদিকে রয়েছে গভীর সংবেদনশীলতার স্নিগ্ধ সুর, অন্যদিকে রয়েছে বিনয়ী প্রতিবাদময় সমাজ মনস্কতা। এক পর্যায়ে কবি বেশ কিছু সাড়া জাগানো ব্যাঙ্গ কবিতা লিখেছেন। সব মিলিয়ে তাঁর কবিতায় রয়েছে শান্ত, নিরু প্রদব জীবনের জন্য মমতা ও আর্তি।
যশস্বী কবি, সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত দৈনিক পাকিস্তান থেকে দৈনিক বাংলায় রূপান্তরিত পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি ইউনোস্কা সাহিত্য পুরষ্কার (১৯৬৬ খ্রি.) বাংলা একাডেমী পুরষ্কার (১৯৬১ খ্রি.), নাসির উদ্দীন স্বর্ণ পদক (১৯৭৭ খ্রি.) একুশে পদক (১৯৭৮ খ্রি.), আবুল কালাম স্মৃতি পুরষ্কার (১৯৮৪ খ্রি.)। এছাড়াও তিনি কবিতালাপ সাহিত্য পুরষ্কার, লেখিকা সংঘ পদক, অলক্ত সাহিত্য পুরষ্কার, পদাবলী পুরষ্কার, কবি আবুল হাসান স্মৃতি পুরষ্কারে ও ভূষিত হন।
“দৈনিক বাংলা” পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক থাকা কালে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই ঢাকায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। আজ তাঁর মৃত্যুবাষির্কীতে জানাই হৃদয়ের অফুরন্ত শুভেচ্ছা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।