পবিত্র লাইলাতুল বরাত
![img_img-1719610983](https://old.dailyinqilab.com/resources/images/cache/169x169x3_1678112525_editorial-inq.jpg)
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমরা আজ এমন একটি সময়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন একটি অতি গুরুত্বপ‚র্ণ ইস্যু হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং যে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনার আগেই আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যাগুলো বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। সারা বিশ্ব জুড়েই অতীতের যে কোন সময়ের থেকে বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
পৃথিবীর যে দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে একেবারে সামনের সারিতে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের ভ‚মিকা খুবই সামান্য। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতির দিক থেকে আমাদের অবস্থান সামনের দিকে। ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি স‚চক-২০১৮’ প্রতিবেদন অনুসারে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপ‚র্ণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। ঐবধফষু ঈবহঃবৎ ভড়ৎ ঈষরসধঃব চৎবফরপঃরড়হ ধহফ জবংবধৎপয (ঐঈঈচজ) এর দেয়া তথ্যমতে ২০৮০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে ৪০ সেন্টিমিটার। গবেষকরা সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের সামগ্রিক ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে পোস্টার চাইল্ড হিসেবে অবহিত করেছেন।
জলবায়ু হল কোন নির্দিষ্ট একটি স্থানের দীর্ঘ সময়ের (সাধারণত ৩০ বছর) প্রতিদিনের আবহাওয়ার গড়। জলবায়ু পরিবর্তন বলতে কোন নির্দিষ্ট এলাকার আবহাওয়ার পরিবর্তনকে বুঝায়। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি বলতে আমরা সাধারণত মানুষের বিভিন্ন কর্মকাÐের ফলে পৃথিবীজুড়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন বা বৈশ্বিক উষ্ণতাকেই বুঝি। জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন এন্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ এর মতে, ‘জলবায়ু পরিবর্তন হল প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে মানুষের কাজের ফলে সৃষ্ট এমন এক ধরনের পরিবর্তন যা বায়ুমÐলের গঠনকে পরিবর্তিত করে এবং দীর্ঘকালে প্রাকৃতিক উপাদানের তারতম্য ঘটায়।’
অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন হল যে উন্নয়নের ফলে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা নিশ্চিত হয় কিন্তু প্রকৃতি বা বাস্তুসংস্থানে কোন বিরূপ প্রভাব পড়ে না। বিগত কয়েক দশক ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলো উন্নয়নের তাগিদে যেসব কর্মকাÐ করেছে তার ফলে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, বাস্তুসংস্থান নষ্ট হয়েছে, কিছু কিছু প্রজাতির প্রাণী পৃথিবী থেকে হারিয়েও গেছে। এ ক্ষেত্রে তারা টেকসই উন্নয়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে নি।
জলবায়ু ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। টেকসই উন্নয়নের কথা না ভেবে শুধু মাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা ভেবে গৃহীত উন্নয়নম‚লক কর্মকাÐ পরিবেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। জলবায়ুর পরিবর্তনে মুখে টেকসই উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের যে ১৭ টি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তার প্রায় প্রতিটিই ব্যহত হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।
টেকসই উন্নয়নের প্রথমেই বলা হয়েছে দারিদ্র্য বিমোচনের কথা। কিন্তু বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যে ঝুঁকির মুখে রয়েছে সেখান থেকে দারিদ্র্য বিমোচন নিশ্চিত করা বেশ কঠিন। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে ১ মিটার। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুসারে প্রতি ৩-৫ বছরে বাংলাদেশের দুই তৃতীয়াংশ এলাকা বন্যায় ডুবে যাবে। ক্রমাগত সমুদ্র উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের দক্ষিণ প‚র্বাঞ্চলে মিঠা পানির পরিমাণ কমে যাবে। লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাবার পানির সংকট দেখা দিবে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে কৃষি কাজ ব্যাহত হবে। ফলশ্রুতিতে ঐ অঞ্চলের মানুষদের জীবন মান হ্রাস পাবে। কৃষি কাজ ব্যাহত হওয়ার দরুন ঐ এলাকায় কৃষি কাজের সাথে যারা জড়িত তারা তাদের কাজ হারাবে। দেশে বেকারত্বের পালা ভারী হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় ফসল উৎপাদন হ্রাস পাবে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য খাদ্য উৎপাদন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। টেকসই উন্নয়নের ২য় লক্ষ্যমাত্রা ক্ষুধা মুক্তি অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আবহাওয়ায় তারতম্য দেখা দিবে। বিগত কয়েক বছরে আমারা দেখেছি পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে গরমে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিবে। টেকসই উন্নয়নের ৩য় লক্ষ্যমাত্রা সুস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে।
টেকসই উন্নয়নের ৪র্থ লক্ষ্যমাত্রা হল মানসম্মত শিক্ষা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে যারা অভিবাসী হতে বাধ্য হচ্ছেন তারা তাদের সন্তানদের জন্য কতটুকু মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারবেন সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সব থকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন নারী ও শিশুরা। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে লিঙ্গ সমতা রক্ষা করা একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। কিন্তু ১৭ টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৫ নম্বরটি হল লিঙ্গ সমতা অর্জন।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৬ নম্বরে বলা হয়েছে সুপেয় পানি এবং পয় নিষ্কাশন সম্পর্কে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবথেকে ক্ষতিকর দিকটি হচ্ছে লবনাক্ততা বৃদ্ধি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপক‚লে লবনাক্ততার মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় নদ নদীর পানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অনেক নদী খাল বছরের বেশির ভাগ সময় জুড়েই শুকনো থাকে। ফলে সমুদ্রের পানি উপরের দিকে উঠে আসায় লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুপেয় পানির সংকট দেখা দিচ্ছে।
টেকসই উন্নয়নের একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তরাষ্ট্রীয় বৈষম্য হ্রাস। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সেটি অর্জন করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে দেশের একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী যখন ক্ষতিগ্রস্থ হবেন স্বাভাবিক ভাবেই অন্যদের সাথে তাদের বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে।
সম্পদের দায়িত্বপ‚র্ণ ব্যবহারের বিষয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১২ নম্বরে বলা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের সম্পদের অনেক অপচয় হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এর মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে সম্পদের দায়িত্বপ‚র্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা কঠিন পড়বে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৫ নম্বরটি হল ভ‚মির টেকসই ব্যবহার। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশ ক্রমাগত মরুভ‚মিতে পরিণত হয়ে যাবে । ভ‚ পৃষ্ঠের পানির স্তর ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে যাবে। অনেক ভ‚মি চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়বে। দিন দিন সেগুলো বিরানভ‚মিতে পরিণত হবে। ফলে ভ‚মির টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের এক অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হবে। দেখা যাবে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার দরুন সেখানে শান্তি বজায় রাখা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। ঝুঁকির মুখে পড়বে টেকসই উন্নয়নের ১৬ নম্বর লক্ষ্যমাত্রাটি। দেখা যাচ্ছে টেকসই উন্নয়নের বেশির ভাগ লক্ষ্য মাত্রাই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অর্জন করা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।
টেকসই উন্নয়ন আর জলবায়ু পরিবর্তন একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। অতীতে আমারা দেখেছি, নানা ধরনের উন্নয়নম‚লক কর্মকাÐ পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে। সেই প্রেক্ষিতে টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফল আমরা ভোগ করতে শুরু করেছি এবং তা নানাভাবে আমাদের টেকসই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থও করছে। তাই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে আগে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবক গুলোকে কমিয়ে আনতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনটি ঘটে ম‚লত পৃথিবীব্যাপী অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের কারণে। এর ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশটি হলেও, জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ভ‚মিকা খুবই অল্প। শিল্প উন্নত দেশগুলো (আমেরিকা, চীন, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ভারত) শিল্পায়নের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার করে যা অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী। সে অর্থে তারাই ম‚লত জলবায়ু পরিবর্তনটি ঘটাচ্ছে। কিন্তু তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের মত দরিদ্র দেশগুলোকে। উষ্ণায়নের ফলে আর্কটিক অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে। এর ফলে একুশ শতকের শেষে বাংলাদেশ উপক‚লে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ ফুট বেড়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারনা করছেন। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা অনুসারে, প্রতি ৩-৫ বছর পর পর বাংলাদেশের দুই তৃতীয়াংশ অঞ্চল বন্যাপ্লাবিত হয়। এর ফলে অবকাঠমো, বাসস্থান, কৃষি এবং জীবন জীবিকার ব্যাপক ক্ষয় সাধিত হয়। ইন্টার গর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইজিপিসিসি) এর প্রতিবেদন অনুসারে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ভ‚মির ১৭% এবং খাদ্য উৎপাদনের ৩০% হারাবে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে এবং দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পাবে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোকে ক্ষতিপ‚রণ দেয়ার কথা বলা হলেও সেটি কোন স্থায়ী সমাধান নয়। বিশ্বের দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে কোন সুষ্ঠু সমাধানে আসতে না পারলে তা অদ‚র ভবিষ্যতে সকলের জন্যই হুমকি হয়ে উঠবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, কৃষিতত্ত¡ বিভাগ
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।