Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

২১০০ সালে ভেসে যাবে উপকূল

জাতিসংঘের গবেষণা প্রতিবেদন : জলবায়ুর অপ্রত্যাশিত ও অপরিবর্তনীয় পরিবর্তন প্রতিবেদন মানবতার জন্য একটি লাল কোড : জাতিসংঘ মহাসচিব

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১০ আগস্ট, ২০২১, ১২:০০ এএম

বৈশ্বিক জলবায়ু নিয়ে নতুন প্রতিবেদনে জাতিসংঘ বলেছে, মানুষের কর্মকান্ডের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে অপ্রত্যাশিত এবং অপরিবর্তনীয় উপায়ে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে ঝুঁকিতে পড়বে কোটি কোটি মানুষ। ২১০০ সালের মধ্যে ভেসে যাবে উপকূল।
জাতিসংঘের এই গবেষণা প্রতিবেদল্যান্ডমার্ক বা মাইলফলক হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এতে ক্রমবর্ধমান চরম তাপদাহ, খরা এবং বন্যার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তাপমাত্রা হলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাপমাত্রার যে সীমা, তা এক দশকের মধ্যে ভঙ্গ হতে পারে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এই প্রতিবেদনকে মানবতার জন্য একটি লাল কোড হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্ব দ্রæততার সঙ্গে পদক্ষেপ নিলে এই বিপর্যয় এখনও কাটিয়ে উঠা সম্ভব। গ্রিনহাউজ গ্যাসকে যদি খুব বেশি কর্তন করা সম্ভব হয় তাহলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি স্থিতিশীল রাখা যেতে পারে।
ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) ‘সামারি ফর পলিসি মেকার্স’ শীর্ষক ৪২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে গতকাল এসব নিরপেক্ষ মূল্যায়ন হাজির করেছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। বিজ্ঞানীদের এই গবেষণার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে জাতিসংঘ মহাসচিবের কণ্ঠে। তিনি বলেছেন, যদি আমরা এখনই সব শক্তি একসঙ্গে যুক্ত করি, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিপর্যয়কে এড়াতে পারব। কিন্তু এই রিপোর্টে এটা পরিষ্কার করা হয়েছে যে, বিলম্ব করার মতো কোনো সময় নেই। কোনো অজুহাত দাঁড় করানোর কোনো স্থান নেই। তাই আমি সরকারগুলোর নেতাদের এবং সব অংশীদারদের প্রতি আহŸান জানাচ্ছি, সিওপি-২৬’কে সফল করার জন্য। আইপিসিসি এসব নিয়ে ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশ করবে সামনের মাসগুলোতে। ২০১৩ সালের পর এটাই প্রথম জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বড় বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট। গøাসগোতে তিন মাসেরও কম সময় আগে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন হয়েছে, যা সিওপি-২৬ নামে পরিচিত।
১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করে আইপিসিসি। এর উদ্দেশ্য জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন হাজির করা। সরকারগুলোকে বৈজ্ঞানিক তথ্য সরবরাহ করা। তারা রিপোর্টে আস্থার সঙ্গে দৃঢ়তায় বলেছে, দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, মানুষের প্রভাবে আবহাওয়া, সমুদ্র ও স্থলভাগ উষ্ণ হয়ে উঠেছে। বৃটেনের ইউনিভার্সিটি অব রিডিং-এর প্রফেসর এবং এই রিপোর্টের অন্যতম লেখক এড হকিন্স বলেছেন, এই রিপোর্টে যেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তা সত্য। এর চেয়ে বেশি সুনির্দিষ্ট আমরা হতে পারি না। এতে যেসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা দ্ব্যর্থহীন এবং অনাপত্তিকর যে, এই গ্রহকে উষ্ণ করে তুলছে মানুষজাতি। ওয়ার্ল্ড মেটেওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের মহাসচিব পেত্তেরি তালাস বলেছেন, খেলাধুলার টার্ম ব্যবহার করে কেউ বলতে পারেন, আবহাওয়ায় ‘ডোপের’ প্রকাশ ঘটেছে। এর অর্থ হলো, আমরা আগের চেয়ে অধিক চরম প্রতিক‚লতা দেখতে শুরু করেছি।
এই রিপোর্টে লেখকরা বলেছেন, ১৯৭০ সাল থেকে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা গত ২০০০ বছরের মধ্যে যেকোনো ৫০ বছরের তুলনায় অনেক দ্রæত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উষ্ণতা এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রতিটি অঞ্চলের আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। সম্প্রতি চরম তাপদাহ প্রত্যক্ষ করেছে গ্রিস এবং উত্তর আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চল। বন্যা হয়েছে জার্মানি ও চীনে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যা ছিল তার চেয়ে ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এক দশকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.০৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৮৫০ সালের পর গত পাঁচ বছর সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত ছিল পৃথিবী। ১৯০১ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যেটুকু বৃদ্ধি পেয়েছিল তার তিনগুণ হয়েছে সম্প্রতি। ১৯৯০ এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত হিমবাহ গলার জন্য প্রধানত দায়ী হলো মানুষ। এ জন্য তারা শতকরা ৯০ ভাগ দায়ী। এর ফলে আর্কটিক সাগরের বরফ কমে যাচ্ছে। ফলে এটা এখন কার্যত নির্দিষ্ট যে, তাপদাহসহ উত্তপ্ত চরম অবস্থা ঘন ঘন আঘাত হানছে। ১৯৫০ এর দশকের পর তা অনেক বেশি তীব্র হয়েছে। অন্যদিকে শীত সংক্রান্ত ইভেন্ট অনেকটা কমে গেছে এবং তার ভয়াবহতা অনেক কম।
এতে আরো বলা হয়েছে, সমুদ্র আরো উষ্ণ হবে। ফলে সমুদ্র আরো এসিটিক হয়ে উঠবে। দশকের পর দশক অথবা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাহাড় ও মেরু অঞ্চলের হিমবাহ বা বরফ গলা অব্যাহত থাকবে। প্রফেসর হকিন্স বলেন, এর পরিণতিতে উষ্ণতার কারণে প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপ হতে থাকবে। এর মধ্যে এমন কিছু পরিণতি আছে, যা থেকে পিছন দিকে অর্থাৎ আগের অবস্থায় আর যাওয়া যাবে না। যখন বিষয়টি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আসে, তখন বিজ্ঞানীরা কার্বন নির্গমণের বিভিন্ন লেভেলের মডেল সামনে আনেন। ফলে এই শতাব্দীর শেষের দিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি হওয়ার বিষয় উপেক্ষা করা যায় না। এই ধারা অব্যাহত থাকলে তা ২১৫০ সালে ৫ সেন্টিমিটারে দাঁড়াতে পারে। এমন হলে তাতে উপক‚লীয় অঞ্চলে বসবাস করা কোটি কোটি মানুষের জীবন হুমকিতে পড়বে। ২১০০ সালের মধ্যে বন্যায় ভেসে যাবে উপক‚লীয় অঞ্চল।
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ ২০১৫ সালের মধ্যে প্যারিস জলবায়ু বিষয়ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল এই শতাব্দীতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়ামের নিচে ধরে রাখা এবং বিশেষ করে একে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করা। কিন্তু নতুন রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা যেসব বৈজ্ঞানিক তথ্য বিবেচনা করেছেন কার্বন নির্গমনের ক্ষেত্রে, তাতে যদি কার্বন নির্গমণ ব্যাপক আকারে কমিয়ে রাখা না যায়, তাহলে এই শতাব্দীতেই উভয় টার্গেট ভেঙে পড়বে। রিপোর্টের লেখকরা মনে করেন, সব কিছুর বিবেচনায় ২০৪০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পৌঁছে যাবে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদি দুই তিন বছরের মধ্যে কার্বন নির্মাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা না যায়, তাহলে এই ঘটনা আরো আগে ঘটতে পারে। বৃটেনের ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের ড. ফ্রেডেরিক ওটো বলেছেন, আমাদেরকে আরো তীব্র, আরো ঘন ঘন তাপদাহ দেখতে হবে। সারাবিশ্বে আমাদেরকে ভারী বর্ষণের বৃদ্ধি দেখতে হবে। দেখতে হবে আরো ভয়াবহ খরা।
প্রতিবেদনের ডকুমেন্ট তৈরি করেছে যে ওয়ার্কিং গ্রæপ তার ভাইসচেয়ার প্রফেসর ক্যারোলাইনা ভেরা বলেছেন, এই রিপোর্টে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, আমরা এরই মধ্যে প্রতিটি স্থানে জলবায়ুর পরিবর্তনের যে পরিণতি তার মধ্যে বসবাস করছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জলবায়ু পরিবর্তন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ