পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
টেলিভিশনের পর্দায় তাকালে বা পত্র-পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে দুই যুবক নিহত, তিন গরু ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, দুই দিন পরে তাদের লাশ ফেরত পাঠায়। এই হচ্ছে আমাদের সাথে প্রতিবেশী ভারতের আচরণ। প্রতিবেশী দেশের আচরণ কি এটা হওয়া উচিত? ভারতের উচ্চ পর্যায় থেকে বারবার প্রতিশ্রæতি দেওয়ার পরও সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা বন্ধ হয়নি। এমনকি সীমান্ত হত্যা বন্ধে কোনও দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারেনি ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। দুই দেশের মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতিশ্রæতি রক্ষা না করার এ ধরনের উদাহরণ খুব কম। ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়ায় কোথাও কোনও দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যদি প্রতিবেশির সঙ্গে সমস্যার সমাধান না করা যায়, তাহলে জাতিসংঘে যাওয়ার বিকল্প নেই। ২০০৮ সালে ভারত সরকার ও বিএসএফ বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল যে, সীমান্তে প্রাণঘাতী কোনও অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। পরবর্তীতে ২০১১ সালে বিএসএফ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তিও করে। ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলা হয় বারবার। এরপরও চলছে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা। আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা। এদের মধ্যে ১২ জনকে গুলি করে এবং ১৪ জনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে। ২০১৫ সালে হত্যা করা হয় ৪২ জনকে, সে বছর তাদের নির্যাতনে আহত হয়েছে ৬৮ জন, ২০১৬ সালে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। আর ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিএসএফ ১৮ জনকে হত্যা করে। বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকদের হাতে মারা গেছে ৯৩৬ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে বিএসএফের হাতে ৭৬৭ জন ও ভারতীয়দের হাতে ১৬৯ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে।
বিজিবির দেওয়া তথ্য মতে, ২০০৯ সালে ৬৭ জন, ২০১০ সালে ৬০ জন, ২০১১ সালে ৩৯ জন, ২০১২ সালে ৩৪ জন, ২০১৩ সালে ২৮ জন, ২০১৪ সালে ৪০ জন, ২০১৫ সালে ৪৫ জন, ২০১৬ সালে ৩১ জন এবং ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১ জন নিহত হয়েছে। পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গেও তো ভারতের সীমান্ত আছে, সেখানে তো এসব হচ্ছে না। বাংলাদেশ সীমান্তে হচ্ছে কেন? ভারত বাংলাদেশের বন্ধু ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র। কিন্তু বহুল আলোচিত সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। দু’দেশের সীমান্তে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর মধ্যে ঘন ঘন পতাকা বৈঠক এবং বিজিবি ও বিএসএফ-এর নিয়মিত শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া সত্তে¡ও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বরং বাংলাদেশিদের হত্যাকান্ড ঘটেই চলেছে। বাংলাদেশের নাগরিকরা অপহরণেরও শিকার হচ্ছে।
ফেলানী হত্যা ঘটনার পরেও বিএসএফ দায়মুক্তির সুযোগ পেয়েছে। বিচার এমনভাবে হয়েছে যে, দায়মুক্তি প্রতিষ্ঠিত করেছে। একদিকে ফেলানীর মামলা নষ্ট হয়েছে, আরেকদিকে রিটটিও সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে আছে। এ ধরনের হত্যা বন্ধের জন্য যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হচ্ছে না। দু’দেশের মধ্যে সমঝোতা এবং এ সম্পর্কিত চুক্তি অনুযায়ী যদি কোনো দেশের নাগরিক অনুমতি ছাড়া সীমান্ত অতিক্রম করে, তবে তা অনুপ্রবেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কথা এবং সেই মোতাবেক ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের নিয়ম। গুলি করে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করা কেন? যেখানে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, মানুষ পাচার এবং চোরাচালান বন্ধে যৌথ উদ্যোগ ও দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা ও আস্থা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে দুই দেশ কাজ করছে, সেখানে সীমান্তে গুলি-হত্যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। কষ্টে বুকটা ফেটে যায় যখন দেখি আমার বোন ফেলানীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখে বিএসএফ, যখন দেখি গরু ব্যবসায়ীকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে ঐ ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। আফসোস তাদের বিচার হয়না। দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে সীমান্ত বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা, তবুও দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি দু’দেশের সরকারের।
আর কত দিন চলবে এভাবে সীমান্তে হত্যাকান্ড? আর কত মায়ের বুক খালি হবে? এই বর্বরতার একটা শেষ চাই, এই নৃশংসতার অবসান চাই। সম্প্রতি এ হত্যাকান্ড আরও বেড়ে গেছে। সকলের এখন একটাই প্রশ্ন সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হবে কবে? এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে একমাত্র ভারত সরকার। আর এ হত্যাকান্ড বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে যেতে হবে জাতিসংঘে।
সীমান্তে যে কোনো অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিদ্যমান আইনে বিচার হবে এবং এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে সীমান্তে হত্যা বন্ধের ব্যাপারে ভারতের কাছে কঠোর ও দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করা। আমরা আর সীমান্তে হত্যার বর্বরতা দেখতে চাই না।
লেখক: প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।