শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
সাজ্জাক হোসেন শিহাব
পূর্ব আকাশে আলোর অঙ্কুরোদগম হওয়ার আগেই ইদানীং অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আবুল কালাম সাহেবের ঘুম ভেঙে যায়। তিনমাস ধরে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই প্রাতঃভ্রমণের নামে তিনি যে কোথায় যান কেউ জানে না। না তার স্ত্রী, না ছেলে অনিক। তিনি ভোরবেলা বের হয়ে ঘরে ফিরেন ঠিক তখন, যখন দুপুরের সূর্যটা মাথার ওপরে এসে চোখ রাঙ্গায়। এ সময়টুকু কোথায় তিনি ফরফর করে ঘুরে বেড়ান, কী করেন, কোথায় যান তা শুধু তিনি নিজেই জানেন। এ নিয়ে স্ত্রীর আর ছেলে অনিকের সাথে তার রাগারাগিও হয়। মাঝেমাঝে স্ত্রী মুখ বেজার করে থাকেন। সকালের নাস্তা না করে তিনি কিভাবে এতক্ষণ বাইরে থাকতে পারেন কিছুতেই তাদের মাথায় ঢোকে না। তারা এ নিয়ে বেশ চিন্তায় থাকে। তিনি যে ডায়াবেটিসের রোগী! চোখেও কম দেখেন। যা দেখেন তা আবার ঘোলাটে। ডাক্তার বলেছে চশমা ব্যবহার করতে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তিনি চশমাও কিনছেন না। তিনি তার ভাবগতি মতই চলছেন।
একমাত্র ছেলে অনিক একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কম্পিউটার সায়েন্সে। অবসরের টাকা থেকে অনিকের সব একাডেমিক ফি একবারেই জমা দিয়ে দিয়েছেন তিনি। আর পেনশনের যে টাকা পান তা দিয়ে চালান সংসার। এরপরও তার কাছে অনিক যখন যা চায়, সামর্থ্য অনুযায়ী দেয়ার চেষ্টা করেন। পেনশনের টাকায় তো আর সবকিছু দেয়া যায় না। তবুও তিনি চেষ্টা করেন ছেলের যৌক্তিক ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে। কিন্তু অযৌক্তিক কিছু চেয়ে বসলেই চেঁচিয়ে ওঠেন, বকাবকি করেন। মাঝেমাঝে ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। অনিক সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। বিশেষ করে এই মফস্বল শহরের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে। ছেলের গতিবিধি দেখে তিনি মাঝেমাঝে ছেলেকে বোঝানোরও চেষ্টা করেন। প্রায়ই বলেন বাউলা হাওয়ার মতো ওড়াউড়ি না করে পড়াশুনা করতে।
অনিকের মা আবার ঠিক উল্টো। আদরের একমাত্র ছেলে বলে তিনি শাসনের সুতোটা একটু ঢিল করে রাখেন। আর ছেলেও সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে নানান বায়না ধরে। আজ নতুন শার্টের জন্য টাকা তো কাল জুতোর জন্য। পরশু আবার গিটারের জন্য। তার পরেরদিন একটা ভালো মোবাইলের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হবার পর থেকেই দিনকে দিন তার বায়না বেড়েই চলেছে। ছেলের মনের ভেতর জেগে ওঠা এসব খামখেয়ালিতে বাবা যেন দিশেহারা। এই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ সংযোজন হল একটা ল্যাপটপের বায়না।
একদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘরে ফিরে খাবার টেবিলে মাকে ফিসফিস করে অনিক বলে, আমি কম্পিউটারে পড়ি, ভালো ল্যাপটপ ছাড়া কী চলে! তুমি জলদি বাবাকে একটা দামি ল্যাপটপ কিনে দিতে বলো।
কালাম সাহেব খাবার টেবিলেই ছিলেন। মা-ছেলের মাঝে কী কথা হয় শোনার জন্য নিজের কানদুটো খাড়া করে রেখে ছিলেন।
ছেলের কথাশুনে কালাম সাহেব বললেন, কত টাকা লাগবে ল্যাপটপ কিনতে?
-ষাট হাজার টাকা।
-ষাট হাজার টাকা! একটা পুরাতন ল্যাপটপ কিনে দিই, বাবা? আমার তো এতো টাকা নাই।
-হবে না।
বাবার কথা শুনেই অনিক কর্কশ ভাষায় উত্তর দেয়। ছেলের এমন কথা শুনে কালাম সাহেব যেন আসমান থেকে জমিনে পড়েন। তার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে থাকে। ছেলে বড় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ভেবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে ছেলেকে বলেন,
-তোমার বাবা কী চাকরি করতো তা কি তুমি জানো। জানো না?
একটু থেমে তাচ্ছিলের সুরে আবার বলেন, স্কুল-মাস্টারি।
বাবার এমন মুখ ভ্যাংচানো ত্যাড়া কথাশুনে খাবার টেবিল থেকে রেগে উঠে যায় অনিক। অন্যদিকে ছেলের এমন মুখ দেখে মায়ের মন আশ্বিনের কালোমেঘ হয়ে যায়। কালাম সাহেবের ওপর ভীষণ চটে গিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলতে শুরু করেন অনিকের মা।
-খাবার টেবিলেই এসব বলতে হবে? পরে বলতে পারতে না?
কালাম সাহেব বিষণœ মনে তার স্ত্রীকে বলেন, ওকে বলো কয়েক মাস ধৈর্য ধরতে। ওকে আমি নতুন ল্যাপটপই কিনে দেব।
শুনে তার স্ত্রী মুচকে হাসেন।
এ ঘটনার দু দিন পর থেকেই কালাম সাহেব ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগেই বাড়ি থেকে বের হতে শুরু করেছেন। ফেরেন ভরদুপুরে। অন্যদিকে অনিক সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় আর ফেরে বিকেলে। সে এতো কিছু জানে না। মায়ের মুখে মাঝে মাঝে বাবার অনিয়ন্ত্রিত জীবনের কথা শুনে রেগে যায়। মাঝে মাঝে বাবার সাথে তর্কেও জড়িয়ে পড়ে। সেই সাথে অবিরাম তাগাদা দেয় নতুন ল্যাপটপের। ওদিকে অনিকের বন্ধুর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। সুমন আর সাজিদ নামে তার নতুন বন্ধু জোগাড় হয়। কালাম সাহেব যখন বাড়িতে থাকেন না তখন তারা বাড়িতে এসে হাজির হয়। আড্ডা দেয়। অনিকের মা সাধ্যমতো তাদের আপ্যায়ন করেন। অনিক যে দিন দিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে তা তিনিও বুঝতে পারেন। ছেলেকে খরচের হাতটা কমাতে বলেন। সাথে বন্ধুর সংখ্যাটাও। কিন্তু কে শোনে কার কথা! অনিক দিব্ব্যি চলতে থাকে তার মত। এরই মধ্যে শিলা নামের এক মেয়ের সাথে তার ভাব জমে যায়। তার সাথে ঘুরে বেড়ায় এখানে-সেখানে। তার মায়ের কানে আসে সে কথা। ছেলে বড়ো হয়েছে, তার জীবনে তো এখন ভালো লাগার মানুষ আসবেই- ভেবে নিজেই নিজেকে সান্ত¦না দেন। হাসিও পায় তার। এই তো কয়েকদিন হলো তার নাড়ি ছিঁড়ে বের হয়েছে তার ছেলে। সে আজ কতো বড়ো হয়ে গেছে! এসব ভেবে মায়ের ভালো লাগে। আগামীর স্বপ্ন বুকে নিয়ে মাঝে মাঝে ছেলের সাথে খুনসুটিতে মেতে ওঠেন।
-আচ্ছা, অনিক, শিলা মেয়েটা কেমন রে?
মায়ের মুখে শিলার নাম শুনে অনিক অবাক হয়ে যায়। লজ্জা আর ভয়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণে তার মুখ লাল হয়ে যায়। আস্তে আস্তে মায়ের সাথে অনেকটা ফ্রি হয়ে যায়। এরই মধ্যে একদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরেই সে তার মাকে সোজাসাপ্টা বলে দেয় যে ল্যাপটপ না পেলে সে আর বিশ্ববিদ্যালয়েই যাবে না। ছেলের মুখে এমন কথা শুনে মায়ের মন খারাপ হয়ে যায়। মা এটা বলে ওটা বলে ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু অনিক কথাগুলো কানেই তোলে না। পরের দিন থেকে সত্যি সত্যি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় না। ঘরের কোণে চুপটি করে বসে থাকে। কারো সাথে কথা বলে না। কালাম সাহেব ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে না যাওয়ার কথা জেনে যান। কিন্তু ছেলের এমন আচরণে তিনি মোটেও মর্মাহত হন না। ঠিকই তো, ছেলের একটা ভালো ল্যাপটপ দরকার- এই বলে নিজেই নিজেকে সান্ত¦না দেন।
এ ঘটনার কয়েকদিন পর থেকেই তিনি ভোরবেলা বের হয়ে দুপুরের পরিবর্তে ফেরেন সন্ধ্যায়। সকালে নাস্তা করেন না, দুপুরে খাবার খান না। অনিয়মিত জীবন-যাপনের ফলে দ্রুতই তার চোখের নিচে কালি পড়ে যায়। তিনি কোথায় যান, কী করেন- এ-নিয়ে বেশ চিন্তায় থাকেন তার স্ত্রী। কালাম সাহেবকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই তিনি রেগে যান। তাই ভয়ে তার স্ত্রী চুপচাপ থাকেন। এভাবেই চলতে থাকে দিন।
একদিন আচমকা কালাম সাহেব রাতে এসে তার স্ত্রীকে বলেন, এতোদিন আমি একটা দোকানে পার্ট টাইম চাকরি করেছি। তুমি কষ্ট পাবে বলে বলিনি। আগামীকাল সব টাকা পাবো। অনিকের ল্যাপটপ কেনার পরই আমার চশমা কিনবো বলে আমি মনে মনে পণ করেছিলাম। কালই অনিকের ল্যাপটপ আর টাকা বেঁচে গেলে আমার চশমাটাও কিনে আনবো। আর পরশুদিন থেকে আর এরকম অনিয়মিত জীবন-যাপন করবো না। অনিক পরশুদিন থেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে ভাবতেই ভালো লাগছে! যাও, যাও অনিককে এখনই বলে আসো।
নিজের চশমা না কিনে ছেলের জন্য এ বয়সে এভাবে টাকা জমানোর কথাশুনে কেঁদে ফেলেন তার স্ত্রী। তার গলায় কথা জমে যেন বরফ হয়ে যায়। তিনি কিছু না বলে সোজা ছেলের ঘরে যান। ছেলেকে ল্যাপটপের কথা বলতেই সে আনন্দে হো হো করে হেসে ওঠে। ছেলের হাসি শুনে বৃদ্ধ আবুল কালামও পাশের ঘর থেকে হেসে ওঠেন ।
পরের দিন বিকেলবেলা আবুল কালাম সাহেব ছেলের পছন্দমত ল্যাপটপ কিনতে বাজারে গেছেন। অনিক আর তার মা বাসায় অপেক্ষায় আছে ল্যাপটপের জন্য। হঠাৎ অনিকের মোবাইল ফোনে একটা অজানা নাম্বার থেকে কল আসে। তার বাবা বাড়ির কাছের রাস্তার মোড়ে দুর্ঘটনায় পড়েছেন বলে জানানো হয় তাকে । অনিকের মা চিৎকার করে কেঁদে উঠে ছেলেকে নিয়ে ঝড়ের গতিতে বাসা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে মোড়ে চলে আসেন।
জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের সামনে রাস্তায় পড়ে আছে আবুল কালাম সাহেবের রক্তাক্ত নিথরদেহ। পাশেই পড়ে আছে নতুন ল্যাপটপের চকচকে ব্যাগ। আবুল কালাম সাহেবের চোখে রক্তে ভেজা নতুন একটা চশমাও দেখা যাচ্ছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।