Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বৈশ্বিক হ্যাপিনেস রিপোর্টে বাংলাদেশের অবনমন

| প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০১৯, ১২:০৯ এএম

বিশ্বে সুখী দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছরই জাতিসংঘসহ বিশ্বের যেসব স্বীকৃত সংস্থা কোন দেশের মানুষ কতটা সুখী এবং শান্তিতে বসবাস করে তার তালিকা প্রকাশ করে থাকে। গত বছর জাতিসংঘ প্রকাশ করে ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০১৮’। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৫। ২০১৭ সালে ছিল ১১০। এ হিসেবে বাংলাদেশ ৫ ধাপ নিচে নেমে গিয়েছিল। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড পিস (আইইপি) বিশ্ব শান্তি সূচক-২০১৯ প্রকাশ করেছে। গত বছর বিশ্ব শান্তির এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৩। এ বছর এ অবস্থান ১০১। ৯ ধাপ পিছিয়ে গেছে। জাতিসংঘসহ এসব প্রতিষ্ঠানের জরিপে থেকে প্রতীয়মাণ হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের সুখ-শান্তি দিন দিন কমে যাচ্ছে। তারা সুখে নেই। আইইপি ১৬৩টি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন, অর্থনৈতিক মূল্য, ট্র্যান্ড এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে দেশগুলোর নেয়া পদক্ষেপরে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই সূচক তৈরি করেছে। বাংলাদেশ সান্ত¦না পেতে পারে এই ভেবে যে ভারত (১৪১) ও পাকিস্তানের (১৫৩ চেয়ে) আমরা এগিয়ে আছি। তবে বিস্মিত হতে পারে ছোট্ট দেশ ভূটান শান্তির শীর্ষ ২০ তালিকায় ঢুকে পড়েছে। দেশটির অবস্থান গত বছরের ১৯তম থেকে ১২তম স্থানে চলে এসেছে। গত একযুগে দেশটি ৪৩ ধাপ এগিয়েছে। দেশটির এই অগ্রগতি চমকে দেয়ার মতো। অন্যদিকে বাংলাদেশ কেবল দিন দিন পিছিয়েই যাচ্ছে।

আমাদের সরকারের এখন একটাই লক্ষ্য দেশের উন্নয়ন এবং উন্নতিকে দৃশ্যমান করে তোলা। বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়নকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এদিক দিয়ে উন্নতি হচ্ছে, তা বলা যায়। তবে মানুষের মনে যে দিন দিন অশান্তি ও অসুখ বৃদ্ধি পাচ্ছে-এ দিকটির দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত পারিবারিক ও সামাজিক মানমর্যাদা, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় যে আশঙ্কাজনক হারে অবনমিত হচ্ছে, তা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যেসব অকল্পনীয় ঘটনা উঠে আসে, তাতে আমাদের নীতি-নৈতিকতা কোথায় গিয়ে নেমেছে, তার মাপকাঠি করা মুশকিল। জরিপ সবসময় সঠিক চিত্র দেবে এমন নিশ্চয়তা কখনোই দেয়া যায় না। জরিপ সাধারণত শ্রেণীভেদে কিছু মানুষের মতামতের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে কয়েকশ’ বা হাজার মানুষের মতামতের ওপর ভিত্তি করে জরিপ প্রকাশ এবং তা সঠিক বলে গণ্য করা মোটেই সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। বলা হচ্ছে, আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। গত বুধবার প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর ৩ মাস ১৮ দিন। পুরুষ ও নারী উভয়েরই গড় আয়ু বেড়েছে। এটা যেমন ইতিবাচক তেমনি এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। নেতিবাচক দিকটি হচ্ছে, এতে দেশে বুড়ো মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যেমনটি বৃদ্ধি পেয়েছে ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে। একটা সময় এমন হতে পারে, দেশে কাজ করার মতো তরুণ শ্রেণীর অভাব দেখা দেবে। তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত হয়ে বুড়ো মানুষ কর্মক্ষমতা হারিয়ে রাষ্ট্রের বোঝায় পরিণত হবে। আমরা বলছি না, গড় আয়ু বৃদ্ধি খারাপ। তবে জরিপে যেভাবে বছর, মাস, দিন উল্লেখ করে গড় আয়ু বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে, তা কতটা সঠিক এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, মানুষ যতদিনই বাঁচুক সে কতটা সুখ-শান্তিতে বেঁচে আছে, তা সবার আগে বিচার করা উচিত। বাংলাদেশের মানুষ যে সুখ-শান্তিতে নেই তা জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থাগুলো প্রতিবছরই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। যেখানে ভুটেনের মতো ছোট্ট এতটি রাষ্ট্র সুখ-শান্তির সূচকে প্রথম ২০টি দেশের তালিকায় চলে এসেছে এবং ক্রমাগত জনগণকে সুখ-শান্তিতে রাখার ব্যবস্থা করছে, সেখানে আমাদের দেশ কেবল পিছিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষের মধ্যে যদি সুখ-শান্তি না থাকে, তখন তাদের মনমেজাজ খারাপ থাকা স্বাভাবিক। দেশের মানুষের এই মনমেজাজ খারাপ নিয়ে কি প্রকৃত উন্নয়ন করা যায়?
দেশের মানুষকে অসুখে ও অশান্তিতে রেখে যতই উন্নতি করা হোক না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না। যে উন্নতি মানুষের জন্য তারাই যদি ভাল না থাকে, তবে এই উন্নতি দিয়ে কি হবে? অন্যদিকে লাখ লাখ কোটি টাকার বাজেট দিয়েই বা কি হবে? এ বাজেট কি মানুষের সুখ-শান্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে? অতীতেও তো লাখ লাখ কোটি টাকার বাজেট দেয়া হয়েছে। দেখা গেছে, তাতে মানুষের সুখ-শান্তিতো বাড়েইনি বরং আরও কমেছে। আমরা জিডিপি বৃদ্ধি নিয়ে কতই না তোড়জোড় এবং আশাবাদ ব্যক্ত করছি। অথচ ভুটান মানুষকে সুখে রাখার জন্য এই জিডিপি’র পরিবর্তে জিএনএইচ-কে (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) বেশি গুরুত্ব দিয়ে বাজেট করে। ভুটান সরকার তার জন্যগণের সামষ্টিক জীবনযাপনের মান, আয়, সম্পদ এবং বাড়ির প্রকৃত অবস্থা বিবেচনা করে এই জিএনএইচ নির্ধারণ করে। অর্থাৎ দেশটির সরকার তার প্রত্যেক জনগণের পারিবারিক, সামাজিক, আয়-ব্যয় এবং সম্পদের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রেখে তার বাজেট প্রণয়ন করে। দেশটির এই জিএনএইচ পদ্ধতি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ অন্যান্য দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর বিপরীত চিত্র দেখা যায় আমাদের দেশে। এখানে প্রত্যেক উপার্জনক্ষম ব্যক্তির আর্থিক, পারিবারিক, সম্পদের পরিস্থিতি কি তা কোনো দিনই যাচাই করা হয়নি। কেবল মোটের উপর সরকার তার উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে কলে দিচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়ন হচ্ছে। যে উন্নয়ন মানুষকে সুখে-শান্তিতে রাখতে পারে না কিংবা পারছে না, সে উন্নয়ন দিয়ে কি হবে? এসব উন্নয়ন কি অর্থহীন হয়ে পড়ছে না? সরকারকে এ বিষয়গুলো আমলে নিতে হবে। মানুষকে অসুখে ও অশান্তিতে রেখে কেবল উন্নয়নের দিকে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটলে এক সময় দেখা যাবে, যে মানুষের জন্য উন্নয়ন তারা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। উন্নয়ন তাদের সুখ-শান্তি এনে দিতে পারেনি। আমরা বলব, যেসব কারণে মানুষ অসুখী ও অশান্তিতে রয়েছে, সে কারণ ও সূচকগুলো শনাক্ত করে তা দূর করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সূচকে আর যেন অবনমন না হয়, এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিশ্ব

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন