মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
বিভেদমূলক ও মেরুকরণ নির্বাচনী প্রচারণার পর বৃহস্পতিবার ফলাফল ঘোষিত হতে থাকার সাথে সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার যখন ভূমিধস বিজয়ের দিকে এগোতে থাকল, আমি তাতে বিস্মিত হইনি। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময় থেকেই একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি মোদির সংবাদ কভার করে আসছি। আমি তার কৌশল সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত।
নির্বাচনের ফলাফলে বিজয় নিশ্চিত হওয়ার দিল্লিতে মোদি নন, বিজয়ী বক্তৃতা করেন গেরুয়া পোশাক পরিহিত প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, সমবেত বিরাট জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান তিনি। উত্তর ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের এ হিন্দু নারী পুরোহিত ২০০৮ সালে মহারাষ্ট্রের এক মুসলিম প্রধান শহরে বোমা হামলার ষড়যন্ত্র করা ও বোমা বিস্ফোরণের জন্য সন্ত্রাসী আইনে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এতে ১০ জন নিহত হন। তিনি অভিনব ভারত নামের এক উগ্রপন্থী হিন্দু সংগঠনের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন যাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং শুধু ভারতেই হিন্দু প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা নয়, প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও নেপালেও হিন্দু প্রাধান্য সম্প্রসারণ। তার আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার এক সপ্তাহ আগে প্রজ্ঞা ঠাকুর মহাত্মা গান্ধীর খুনী নাথুরাম গডসেকে দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রশংসা করেন (হিন্দু কট্টরপন্থীরা গান্ধীকে মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে দেখে)।
নিয়তির পরিহাস যে, এ বছর ভারত মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী পালন করবে, আর এ বছরই বিজেপি ও তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা তাদের বিজয়কে গরিষ্ঠতা নীতির প্রতি ম্যান্ডেট হিসেবে দেখে প্রজ্ঞা ঠাকুরকে (সাধ্বী প্রজ্ঞা নামে পরিচিত) ভারতীয় পার্লামেন্টে অভিষিক্ত করবে।
বিষয়টি বিস্ময়করভাবে প্রায় ১০ বছর আগে আমি যা দেখেছিলাম, ঠিক সে রকমই। ২০১০ সালে আমি ২০০২ সালে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গায় রাজ্যের সংশ্লিষ্টতা এবং সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত মুসলমানদের বিচার বহির্ভূত হত্যা অনুসন্ধানের জন্য ৮ মাস গোপনে কাজ করি। এই আট মাস আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট কনজারভেটরির একজন ছাত্রের বেশে আমি মোদির অধীনে কর্মরত প্রায় সকল আমলা ও কর্মকর্তার সাথে কথা বলি। আমি জানতে পারি যে, মোদি মুসলিমদের সমালোচনার সম্মুখীন একজন হিন্দু নেতা হিসেবে নিজেকে দেখতে চান। গুজরাটে তার ১২ বছরের শাসনকে ‘গুজরাটি অস্মিতা’ (গুজরাটের গৌরব) হিসেবে দেখা হয়। নির্বাচনী সমাবেশে জনতা তাকে স্বাগত জানাত। জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘দেখ দেখ কৌন আয়া, গুজরাট কা শের আয়া (দেখ দেখ, গুজরাটের সিংহ এসেছে)।’
মোদির ওপর এটাই আমার প্রথম রিপোর্টিং নয়। ২০০৭ সালে একজন রিপোর্টার হিসেবে তার প্রাদেশিক নির্বাচন কভার করার সময়ের কথা। গুজরাট দাঙ্গার পর তার প্রথম বিধানসভা নির্বাচনী সমাবেশে আমি প্রথম সারিতে বসেছিলাম। মোদি বসেছিলেন তার রাজ্যের তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অমিত শাহর পরে। তিনি মঞ্চে মাইক্রোফোন হাতে নিলেন এবং প্রধানত নারী ও গুজরাটের উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সমন্বিত জনতাকে জিজ্ঞেস করলেন, সোহরাব উদ্দিনের মত লোকের ব্যাপারে আপনারা আমার কাছ থেকে কী চান?
জনতা সমস্বরে দ্ব্যর্থহীন জবাব দিল, তাকে হত্যা করুন।
মোদি ২০০৫ সালে তার সরকার কর্তৃক সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত পাতি অপরাধী সোহরাব উদ্দিন শেখের হত্যার কথা বলছিলেন। ধারণা করা হচ্ছিল যে, শেখ ও তার স্ত্রীকে গুজরাট পুলিশ খুন করেছে। তবে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার পর ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (সিবিআই) আবিষ্কার করে যে, এ হত্যাকান্ড ছিল এক ভুয়া বন্দুকযুদ্ধ। আসলে রাজ্য পুলিশের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা। সিবিআই’র তদন্তের ফলাফলের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিবর্তে মোদি তার বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলেন। তিনি প্রচার করতে শুরু করলেন যে, দিল্লীতে কংগ্রস সরকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের তুষ্ট করতে তাকে বলি করতে চাইছে। তারপর থেকে প্রতিটি প্রচারণায় তিনি জনতাকে বলতে থাকলেন যে, দিল্লি সালতানাত (কংগ্রেস সরকার) গুজরাটে ঢুকে পড়া এক মুসলিম সন্ত্রাসীর কবল থেকে তাকে রক্ষা করার অপরাধে তার মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের শাস্তি দিতে চাইছে। এক হাস্যকর বিচার মোদির ট্রাম্পকার্ড হয়ে ওঠে, আরেকজন মুসলমান রাষ্ট্রের শত্রু হয়ে ওঠে এবং সেই গ্রীষ্মে মোদি পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল মোদির চেষ্টাকৃত ও পরীক্ষিত সেই রাজনৈতিক সূত্রের রূপায়ন যা মোদি তার বিগত দু দশকের রাজনৈতিক জীবনে অধিগত করেছেন। এটা হচ্ছে একটি কৌশল যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি আশু হুমকিকে ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘উই পোকা’, ‘বহিরাগত’ বলে রঙ লাগিয়ে দেয়- যেগুলো হচ্ছে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি বাঁকা মন্তব্য।
২০১৯ সালে নির্বাচনে আমি মহারাষ্ট্র থেকে উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত সংবাদ সংগ্রহ করেছি। মোদির বক্তৃতার বার্তার চাইতে মাঠে জনগণের মনোভাব ছিল কম সূক্ষ্ন। মুম্বাইর ট্যাক্সিচালক থেকে লালগঞ্জে সরকারি ক্যান্টিনের পরিচালক পর্যন্ত সবাই খুশি ছিল যে, ‘টুুপওয়ালা’দের (মুসলমানদের) তাদের জায়গা দেখিয়ে দেয়া হয়েছে।
প্রচারণা ফল দিয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম অধ্যুষিত আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের মত জায়গায় বিজেপি তার প্রবেশের জায়গা করে নেয়ার জন্য লড়াই করছিল, এক ঐতিহাসিক রায়ে সেগুলোতে দলটি ডবল ডিজিটে জয়ী হয়েছে।
এ দুটি রাজ্যেই বিজেপির নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে কেন্দ্র করে প্রচারণা কেন্দ্রীভূত ছিল যাতে প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে মুসলমানদের ছাড়া। প্রতিবেশী রাজ্যগুলো থেকে অভিবাসী আগমনের কারণে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক দৃশ্যপট ঐতিহাসিক ভাবে উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। এটাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে এবং মুসলমান উদ্বাস্তুদের রাজ্যে বসবাস না করতে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি অসন্তুষ্ট হিন্দু ভোটারদের ভোট সংহত করেছে।
বিজেপি অনুপ্রবেশকারীদের (এ কথা দিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি মুসলমান উদ্বাস্তুকে বোঝানো হয়) বিতাড়িত করতে আসামে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) প্রবর্তন করেছে। এটি দলটির জন্য সহায়ক হয়েছে। আসামে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।
উত্তর প্রদেশেও এই ঘটনা। সেখানে বিতর্কিত ডানপন্থী হিন্দু পুরোহিত যোগী আদিত্যনাথ নির্বাচনী প্রচারণাকালে তার সাম্প্রদায়িক কথাবার্তার কারণে সমালোচিত হন। অন্যদিকে পাকিস্তানে সামরিক অভিযান নিয়ে মোদির চরম জাতীয়তাবাদী বক্তব্য বিতর্কের সৃষ্টি করে। এবার বিজেপি উত্তরপ্রদেশের ৮০টি আসনের মধ্যে ৬০টিরও বেশি পেয়েছে।
যখন প্রতিটি বাড়িতে একটি করে পায়খানার ব্যবস্থাসহ মোদির কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী অঙ্গীকার উত্তর প্রদেশে বাস্তবায়িত হয়েছে, বিজেপির বিভিন্ন সমাবেশে লোক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সে সবের অতিরঞ্জিত প্রচার করা হয়েছে। একটি বিশেষ লোকসঙ্গীতে দেখা যায়, প্রধান গায়ক মোদিকে একমাত্র নেতা বলে বর্ণনা করছেন যিনি পবিত্র হিন্দু মাটি থেকে বিশ্বাস ঘাতক ও জাতীয়তাবাদ বিরোধীদের বিনাশ করতে পারেন।
জনতা কর্তৃক পিটিয়ে হত্যা, ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক অপরাধের শাস্তি না হওয়া এবং হিন্দু গৌরবকে আবাহনের মাধ্যমে ভারতের সংখ্যালঘুদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টার মধ্য দিয়ে গত পাঁচ বছরে ভীতি ও মেরুকরণের ঘটনা মুসলমানদের ভোটদান পদ্ধতিতে প্রভাব ফেলেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম অধ্যুষিত আসনগুলোতে মুসলিম ভোট বিজেপির শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বীর ঝুলিতে পড়েছে, একইভাবে তারা ঐতিহ্যগতভাবে কংগ্রেসকেও ভোট না দিয়ে তাদের বিরোধীদের দিয়েছে। তা সত্তে¡ও এবারের নির্বাচনে মাত্র ১৯ কোটি মুসলমানের মধ্যে মাত্র ২৬ জন ভারতের পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, শাসক দলে কোনো মুসলিম জনপ্রতিনিধি নেই।
মোদির বিজেপি কংগ্রেসকে শুধু তার শক্তিশালী দুর্গগুলোতেই পরাজিত করেনি, কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধীকে আমেথিতে তার পারিবারিক আসনেও পরাজিত করেছে। মোদির শক্তমানব ইমেজের সামনে রাফাল দুর্নীতি বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে কংগ্রেস সুবিধা করতে পারেনি।
নরেন্দ্র মোদি একজন আগ্রাসী নেতা হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৯ সালে তার ভূমিধস বিজয়ের মূলে রয়েছে হিন্দুত্ব, এ মতাদর্শ ভারতীয় সংস্কৃতির সংজ্ঞায়ন করে হিন্দু মূল্যবোধের ভিত্তিতে। লাগাম টানা না যায় তাহলে তা আগামী পাঁচ বছরে ভারতকে এক বিপজ্জনক পরিণতির দিকে ধাবিত করতে পারে।
নিবন্ধকার রানা আইয়ুব ভারতীয় সাংবাদিক এবং ‘গুজরাট ফাইলস: এনাটমি অফ এ কভার আপ’ গ্রন্থের লেখক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।