পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
একই যাত্রায় দুই জনের জন্য দুই ফল দেখতে চাইলে তার উপযুক্ততম দেশ বাংলাদেশ। সরকারি দলের নেতা ওবায়দুল কাদের অসুস্থ হয়েছিলেন। সে কারণে দীর্ঘদিন সরকারি খরচে তাকে বিদেশে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। বিদেশে দীর্ঘকাল চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে তিনি তাঁর ভাষায় ‘জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস’ খেলা শুরু করেছেন। পক্ষান্তরে দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী, অতীতে যিনি তিন তিনবার নিরপেক্ষ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশ চালিয়েছিলেন, সেই নেত্রী খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হওয়া সত্তে¡ও শুধু বিরোধী দলের নেত্রী হওয়ার অপরাধে হাসপাতাল থেকে কারাগারে পাঠাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সরকার। গুরুতর অস্স্থু বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে গিয়েছিলেন সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন অনেকটা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। যে কোনো সময়ে তার সম্পর্কে কোনো চরম দুঃসংবাদ আসতে পারে।
খালেদা জিয়ার অপরাধ তিনি বিরোধী দলের নেত্রী। রাজনীতি বিশ্লেষকদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বর্তমান সরকার চায় না, বেগম খালেদা জিয়া সেরে উঠে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হোন। তিনি বিনা চিকিৎসায় এবং সরকারের পরিকল্পিত অবহেলায় মৃত্যু বরণ করুন এটাই যেন সরকারের কাম্য। অথচ অতীতে তিন তিনবার নিরপেক্ষ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশ চালিয়েছেন খালেদা জিয়া, তার সুচিকিৎসা চায় না যে সরকার সে সরকার প্রধান যে আদৌ গণতন্ত্রের বিশ্বাসী নন, এটা সুস্পষ্ট। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে সরকারের পক্ষ থেকে তার সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজনবোধে বিদেশে পাঠানো হতো।
কিন্তু বাস্তবে আমরা দেশে কী দেখছি? বিরোধী দলের প্রধান নেত্রী হওয়ার অপরাধে তাকে সুপরিকল্পিতভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। নইলে চিকিৎসকরা যেখানে তার সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতালে রাখার পক্ষপাতী, সেখানে তাকে কারাগারে পাঠানোর জন্য সরকার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কেন? অসুস্থ হলেও বেগম খালেদা জিয়া যে এখনও বেঁচে আছেন এবং তিনি যে নীতির প্রশ্নে জীবনে কখনও আপোস করেন না, এটা কে না জানে?
সেই বেগম খালেদা জিয়াকে বর্তমান সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে বদ্ধপরিকর এটা দেশের যে কোনো রাজনীতি সচেতন ব্যক্তির কাছেই এখন সুস্পষ্ট। অসুস্থ হলেও বেগম খালেদা জিয়া যে বেঁচে আছেন এটাই যেন সরকার সহজভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। অথচ যে কোনো দেশে সরকার-সমর্থক বা সরকার বিরোধী যে কোনো নেতানেত্রীর চিকিৎসা পাবার অধিকার তাঁর মৌলিক ও মানবিক অধিকার সমূহের অন্যতম। সরকারে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা সবাই শিক্ষিত। তাই এই সত্যটা তারা জানেন। তাই বলতে হয়, সরকার জেনে শুনেই বিরোধী দলের প্রধান নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু তথা জীবনাবসান চান তাদের নিজেদের ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে।
শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে যারা দেশের বিরোধী দলের প্রধান নেত্রীর মৃত্যু কামনা করেন এবং যেহেতু তাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাই অনৈতিকভাবে ক্ষমতা খাটিয়ে হলেও বেগম খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চান, তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আসলে এসবই আমাদের যে বাংলাদেশে বাস্তবে দেখতে হচ্ছে তার কারণ, বর্তমান সরকার প্রধান আদৌ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে তার নিজের দলের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরকে যেখানে সরকারি খরচায় বিদেশে দীর্ঘদিন চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করিয়ে দেশে ফেরত আসার সুযোগ দিয়েছেন, সেখানে যে নেত্রী অতীতে তিন তিনবার নিরপেক্ষ নির্বাচনে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশ চালিয়েছিলেন, তাঁকে এভাবে দেশের হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগও বন্ধ করে দিয়ে কারাগারে পাঠাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠতেন না।
এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, বর্তমান সরকার প্রধান কোনো নেতা বা নেত্রী যত জনপ্রিয়ই হোন, সরকার বিরোধী হলে তার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতেও সামান্যতম বিব্রত বোধ করেন না। অথচ একজন রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে বর্তমান সরকার-প্রধানের প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিৎ ছিল খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া। কারণ তিনি সরকার প্রধানই হোন বা প্রধানমন্ত্রীই হোন, প্রথমত তিনি মানুষ এবং মানুষ হিসেবে মানবিক গুণে গুণান্বিত হওয়া সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
সমগ্র পরিস্থিতি ও ঘটনাবলী দেখে যে কোনো বিবেক সম্পন্ন মানুষ একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন, প্রধানমন্ত্রী হলেও মানবিকতার বিচারে তিনি নিজেকে নেহায়েৎ অযোগ্য প্রমাণ করেছেন। এর পরিবর্তে তিনি যদি অতীতে যিনি তিন তিনবার নিরপেক্ষ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তাকে বিরোধী দলের প্রধান নেত্রীর প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দিতেন, তাহলে তিনি নিজেকে গণতন্ত্রের বিশ্বাসী প্রমাণ করতে পারতেন।
কিন্তু তিনি তা করেননি। কেন করেননি? করেননি এজন্য যে, বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ হলেও দেশের জনগণের কাছে তার যে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তাকে তিনি ভয় করেন। তিনি মনে করেন, বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ হলেও দেশের মানুষের কাছে যদি স্বাধীনভাবে যেতে পারেন, সভা-সম্মেলন করতে পারেন, তা বর্তমান সরকার-প্রধানের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। এরকম দৃষ্টান্ত অতীতে রয়েছে অসংখ্য। তাই বর্তমান সরকার প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে সে সুযোগ দিতে ভয় পান। এর ফলে লোকে যদি গণতন্ত্রবিরোধী আখ্যা দিতে চায়, তাতেও যেন তার চিন্তা নেই। কারণ, সরকারে থাকলে ক্ষমতা বলে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করা তার কাছে সহজ হয়ে উঠতে বাধ্য।
এসব কারণেই বেগম খালেদা জিয়া যত অসুস্থই হোন, তার প্রতি মানবিকতার সামান্যতম মনোভাব প্রদর্শনে ভয় পান বাংলাদেশের বর্তমান সরকার-প্রধান। তাছাড়া একথাও তিনি ভুলে যান না যে, অতীতে তাঁর দল যখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের নেতৃত্বে ছিল, তখন দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল। অথচ পরবর্তীকালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তখন দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বিএনপির মাধ্যমে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত না হলে বর্তমান সরকার-প্রধানের পক্ষে কখনও ক্ষমতায় আসা হতো না। এ কারণে বিএনপির প্রতি বর্তমান শাসক দলও ঋণী।
বর্তমানে দেশে যে অবস্থা চলছে, তা নিয়ে এ লেখা শুরু করছিলাম। বর্তমান সরকার যে আদৌ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না তার প্রমাণের পাশাপাশি আমরা এ সত্যেরও প্রমাণ পেয়েছি যে, সরকার নিজেকে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হিসেবে দাবি করতে চায়। সেই হিসেবে বর্তমান সংসদে একটি বিরোধী দল আছে। কিন্তু সেটি গণতন্ত্রের স্বার্থে কোনোভাবেই অর্থবহ নয়। যদিও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেশে একটি একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়, তবুও পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশে বহু দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে আওয়ামী লীগও একটি দল হিসেবে সক্রিয় হয়।
সর্বশেষে যে কথাটি বলে আজকের এ লেখা শেষ করতে চাই তা হচ্ছে, নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত দেশে স্থিতিশীলতা আসবে না। সেই ব্যবস্থা যাতে কায়েম হয় তাতে সকল দলের সহযোগিতা আবশ্যক। সে পথে না গিয়ে বর্তমান সরকার যেভাবে মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তার প্রধান নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যিনি অতীতে তিন তিনবার নিরপেক্ষ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশ পরিচালনা করেছেন তাকে অন্যায়ভাবে রাজনীতি করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখতে অটল রয়েছেন বলে মনে হচ্ছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এতে দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ দুর্বল ও অনিশ্চিত হয়ে পড়তে বাধ্য।
এই প্রেক্ষাপটে আমরা দাবি করব, গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল করার পথে কোনো সামান্যতম বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এমন পথ পরিহার করে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল হতে পারে এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করুন। এলক্ষ্যে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে, তা হলো অসুস্থ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, যিনি একাধিকবার নিরপেক্ষ নির্বাচনে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন, তার অসুস্থতার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন। শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে বেগম খালেদা জিয়ার মতো জনপ্রিয় নেত্রীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন না। বর্তমান সরকারের ক্ষুদ্র স্বার্থে বেগম খালেদা জিয়ার জীবনের যদি কোনো রকমের ক্ষতি হয়, তাহলে বাংলাদেশের জনগণ বর্তমান সরকার প্রধানসহ ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতানেত্রীকেই ক্ষমা করবে না। সুতরাং সাধু সাবধান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।