Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পর্ক

আহমেদ সুজন | প্রকাশের সময় : ১৭ মে, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

প্রিয় মঞ্জু খালা! যে কথাগুলো তোমার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারিনি, সেই কথাগুলোই আজ তোমাকে বলছি। জানি আমার লেখা পড়তে গিয়ে তোমার দু’চোখে জল গড়িয়ে পড়বে। হয়তো তুমি তোমার প্রিয় বোনের জন্য হাউমাউ করে কাঁদবে। তোমার বোন, আমার মা। তুমি কি জানো? আমি এখনো ঘুমের ঘোরে মা মা বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠি। গভীর অন্ধকারে খাটের ওপর বসে থাকি। আমার পাশে যে মানুষটা ঘুমিয়ে থাকে সেও আমার চিৎকারে লাফিয়ে উঠে হাত চেপে আমাকে সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করে। আমার পাশের রুমে থাকা আদরের ছোট্ট বোন বৃষ্টি। তাকেও অসংখ্য ভোরে ঘুমের ঘোরে মা মা বলে কাঁদতে শুনি। তার কান্নার শব্দ শোনে ছুটে গিয়ে যখন চোখের জল মুছে দিই- তখন তার মুখে অব্যক্ত ভাষা ফুটে ওঠে। আমাকে যেন বলতে থাকে, ‘ভাইয়া মাকে এনে দাও, ভাইয়া মাকে এনে দাও।’
মাকে যখন অসুস্থ অবস্থায় তোমার কাছে পাঠিয়েছিলাম তখন মা আমাকে বলেছিল, ‘আমি ভালো হব তো ?
আমি মাকে বলেছিলাম, ‘মা তুমি সেখানে ডাক্তারের চিকিৎসার পাশাপাশি একজন নার্স পাবে, যে তোমার যতœ করবে প্রতিনিয়ত আর সেই নার্স হচ্ছ তুমি। মাকে যখন গাড়িতে বসালাম তখন অনেকেই বলেছিল, ‘মানুষ অসুস্থ হলে ভালো ডাক্তারের জন্য ঢাকা নেওয়া হয়, তোরা পাঠাচ্ছিস ফেনী, এটা ঠিক হচ্ছে?’
আমি বলেছিলাম, ‘ঢাকার ডাক্তারের চেয়েও বড় ডাক্তার সেখানে আছে, যে আমার মাকে ভালো করে দেবে।’
সেই ডাক্তার হচ্ছ তুমি। সেদিন মায়ের সাথে যাওয়ার কথা ছিল ছোট ভাই রকির। কিন্তু কেন জানি সেদিন সে যায়নি। শুনেছি রকি না যাওয়াতে মা পথে কান্না করেছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় সন্তানের জন্য কেঁদেছেন, এটাই বুঝি মা। তোমার বাড়ি পৌঁছানোর পর ফোনে মায়ের কথা শুনে বুঝেছিলাম, মা বুঝি অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেছে। খালা তুমি যখন মাকে নিয়ে এই ডাক্তার, সেই ডাক্তারের কাছে পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছ, তখন মা ফোনে তোমার কথা বলে কান্না করত। ডাক্তার যখন মাকে দেখে বলেছিল, আমার কাছে যখন এসেছিস তখন আর ভয় নেই, আমি তোকে ভালো করব।মা ফোনে আমাকে হাসি মুখে বলেছিল, ‘বাবা ডাক্তার বলেছে আমি ভালো হব।’
তুমি যখন জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে দু’হাত পেতে চোখের পানি ফেলতে, তখন মা আড়ালে দাঁড়িয়ে তোমার সেই আর্তনাদ শুনত। তুমি যখন হুজুর দিয়ে দোয়া পড়াতে তখন মা আমাকে বলত, তোর খালা আজ আমার জন্য দোয়া পড়িয়েছে। মায়ের অসুখ যখন কিছুতেই উন্নতি হচ্ছিল না, তখন তুমি মায়ের অজান্তে পড়িয়েছিলে জালালি খতম। মা ভারাক্রান্ত মনে আমাকে বলেছিল, ‘দেখলি বাবা! তোর খালা কীভাবে শেষে এটা পারল? তুমি, বড় খালা আর নানু যখন পাশের রুমে বসে মায়ের জন্য কান্না করতে তখন বিছানায় শুয়ে থেকে কান পেতে শুনতেন তোমাদের সেই কান্না। ফকরুল ভাইয়ের ধরে আনা ছোট মাছের কথাও বলতেন। বলতেন আমি পছন্দ করি বলে ফকরুল আমার জন্য ছোট ছোট মাছ ধরে আনে। নীলফামারী থেকে মামার নিয়ে আসা সেই বুনো ঔষধের প্রশংসাও করেছে অনেকবার। বলেছে, ‘আমার ভাইয়ের ঔষধগুলো অনেক উপকার পাই।’
মাকে না দেখে যখন আর থাকতে পারছি না, তখনই মাকে বলি, ‘মা বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরলাম তোমার কাছাকাছি থাকব বলে আর তুমি সেখানে নেই।’
মা কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘তুই চলে আয় বাবা।
চলে এলাম তোমার বাড়ি। তুমি জানো খালা! মা যখন আমাদের এগিয়ে নিতে রেললাইন পর্যন্ত চলে এসেছে, তখন মাকে দেখে এতটা আনন্দিত হয়েছি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। যে মাকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলাম, সে মা হেঁটে রেললাইন পর্যন্ত আসতে পেরেছিল শুধু তোমার জন্য। মায়ের কাছে শোনা জায়নামাজে বসে তোমার সেই কান্না আমিও দেখেছি নিজ চোখে। মা’র মনটাকে চাঙা রাখার জন্য নিজে চোখের পানি লুকিয়ে গেয়েছিলে কত গান করেছিলে ছোটবেলার অনেক গল্প। তবে তোমার সব লুকোচুরি মা বুঝতে পারতেন। তোমাদের বাড়ির পুকুরে যখন মানুষ গোসল করত, তখন মায়েরও ইচ্ছে হয়েছিল সে পুকুরের পানির সাথে খেলা করে গোসল করার। তুমি মায়ের সে ইচ্ছেও পূরণ করেছিলে। ছোট বাচ্চারা পানিতে খেলা করার সময় যেমন মা হাত ধরে রাখে তেমনি তুমি একহাত ধরে রেখে মাকে নামিয়েছিলে পুকুরে। মা ছোট বাচ্চার মতো খেলা করে গোসল করেছিল। খাওয়ায় অনিয়ম হলে মাকে তুমি শাসন করতে। রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাকে তুমি সুস্থ করে দিয়েছ। মাকে নিয়ে বড় খালার বাড়ি গেলাম। খালার দেবর মারা যাওয়ায় সেই বাড়ি ছিল নিস্প্রাণ, তাই মায়ের যতœ না নিতে পেরে বড় খালার মনে কষ্টের সীমা ছিল না। তারপর চলে গেলাম মামার বাড়ি। নানুও ছিলেন মায়ের সঙ্গে সঙ্গে। সেখানে মাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন মামি। মায়ের প্রতি সেই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার করণেই হয়তো সারাজীবন মামির কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। সেখান থেকেই আমরা বাড়ি ফিরব আর তাই তো বড় খালা, খালু, রুমা আপা, নুরু ভাই আর তুমি তোমরা সবাই আবার এসেছিলে মাকে দেখতে। মা অনেক বলেছে রুমকির কথা। রুমকি মাকে গোসল করিয়েছে, মায়ের কাপড় কেচে দিয়েছে। তোমার অজান্তে মা তোমার ব্যাগ থেকে পাঁচ’শ টাকা নিয়ে রুমকিকে দিয়েছিল। পরে আমার কাছ থেকে নিয়ে সেই টাকা আবার ব্যাগে রেখে দিয়েছিল তোমার অজান্তে। আচ্ছা তোমরা কেউ কি একবারও বুঝেছিলে আমার মাকে এটাই তোমাদের শেষ দেখা? নয়তো কেন সবাই একসাথে মাকে বিদায় দিয়েছিলে। খালা, যে বোনকে তুমি সুস্থ করে দিয়েছিলেÑ তাকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। মা আমাদেরকে এভাবে এতিম করে চলে যাবে জানলে হয়তো সারাজীবন তোমার কাছেই রেখে দিতাম। মায়ের মৃত্যুর পর আর কাউকে মা ডাকতে পারি না। খুব ইচ্ছে হয় একবার মা বলে ডাকি। কিন্তু কাউকে পাই না। খালা তুমি কি আমার মা হবে? আমি কি তোমাকে মা বলে ডাকতে পারব? খালা, একবার তোমাকে একবার, শুধু একবার মা বলে ডাকি...!

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সম্পর্ক

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২
১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন