শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
বাংলা সাহিত্যের আলোচনা করতে গেলে সবার আগে যার নামটি উচ্চারিত হয়, যাকে ছাড়া বাংলা সাহিত্য অপূর্ণ, যিনি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উপমহাদেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল মানুষ তাকে এক নামে চিনেন। তাঁর ছদ্মনাম ভানুসিংহ ঠাকুর (ভণিতা)। সাহিত্যের এমন কোনো দিক নেই যেখানে তাঁর পদচারণা নেই। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন, রেখেছেন সফলতার স্বাক্ষর। রবীন্দ্রনাথ একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গীতিকার, সুরকার, চিত্রকর, অনুবাদক, দার্শনিক এবং অভিনেতা। বহু গুণে গুণান্বিত এ মানুষটি কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজি ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মে, বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ শে, বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদাসু’দরী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাদের চতুর্দশ সন্তান। বাবা ছিলেন জমিদার, তিনি নিজেও জমিদার ছিলেন। তাঁর জীবনটা ভোগবিলাসিতার মাঝে অতিবাহিত হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু না। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক, সাধক আমৃত্য জ্ঞানপিপাসু। সমস্ত জীবনটাই কাটিয়েছেন সাহিত্য সাধনা করে। তাঁর রচিত গান ্রআমার সোনার বাংলা ও জনগণমন-অধিনায়ক জয় হেগ্ধ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীত। তিনিই একমাত্র কবি যার লেখা গান দুইটি দেশের জাতীয় সংগীত। তাছাড়া শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের মূল লেখক ও সুরকারও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যেটি আন’দ সামারাকুন সিংহলি ভাষায় অনুবাদ করেন।
ইউরোপের বাইরে এশীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ কবি নিজেই করেছেন। তাঁর বিপুল সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বিশাল বিশাল পুস্তকে পরিণত হবে তবু আলোচনা শেষ হবে না।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য জনপ্রিয় ও কালোত্তীর্ণ কাব্যগ্রন্থের মধ্য একটি হচ্ছে ‘সোনার তরী।’
সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দ (১৩০০ বঙ্গাব্দ)। কাব্যগ্রন্থটি কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রতি উৎসর্গিত। সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের নামকবিতা অর্থাৎ যে কবিতাটির নামে বইটির নামকরণ করা হয়েছে সে কবিতাটি হলো‘সোনার তরী’।
কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাও ‘সোনার তরী’। এটি বহুল পঠিত ও আলোচিত কবিতার মধ্যে একটি। এই কবিতাটির অর্থ-নিরূপণ নিয়ে যত বাদ-প্রতিবাদ হয়েছে, এমন আর কারো কোনো কবিতা নিয়ে হয়েছে কি না স’েদহ। সোনার তরী কবিতার অর্থ নানাজনে নানাভাবে করেছেন। যাকে বলে বহুরৈখিকতা। একটি কবিতা পাঠের পর একেকজন পাঠক যখন একেকরকম অর্থ আবিষ্কার করে তখনই কবিতাটি সার্থক। পরবর্তীতে কবি নিজেই তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে কবিতাটির ভাবার্থ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।
কবিতাটিতে একজন কৃষক তার জমির ধান কেটে নদীর
পাড়ে একা বসে আছে নৌকার অপেক্ষায়। কবির ভাষায়-
্রএকখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাক
প্রভাতবেলা-
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।গ্ধ
এখানে ছোট ক্ষেত, রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন কবি।
ছোট ক্ষেত বলতে কবি এই ধরিত্রীকে বুঝিয়েছেন। যেখানে মানুষ একা আসে এবং যাবার সময় একাই যায়।
কৃষকের কাছে নৌকা আসে, কৃষকের কষ্টার্জিত সোনার ধান নৌকায় তুলে নেয় কিন্তু কৃষক যখন নৌকায় উঠতে চায়, মাঝি কৃষককে সেই নৌকায় উঠায় না। তখন কৃষক হতাশ হয়ে উচ্চারণ করেন,
‘আর আছে?-- আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে--
এখন আমারে লহ করুণা করে।গ্ধ
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-- ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।গ্ধ
তরী অর্থাৎ মহাকাল, মানুষের কর্মটুকুকে শুধু তার বুকে ঠাঁই দেয়, এখানে ব্যক্তির কোন স্থান নেই। তাই কৃষক যতই অনুনয়বিনয় করুক না কেন, মাঝির কাছে করুণা ভিক্ষা পাবে না। সংসার সমস্তই নেবে, একটি কণাও ফেলে দেবে না-কিন্তু যখন মানুষ বলে, ঐ সঙ্গে আমাকেও নাও আমাকে রাখ; তখন সংসার বলে-তোমার জন্য জায়গা কোথায়? তোমাকে নিয়ে আমার হবে কী? তোমার জীবনের ফসল যা-কিছু রাখবার সমস্তই রাখব, কিন্তু তুমি তো রাখবার যোগ্য নও!
কবি নিজে তাঁর কোন এক লেখায় বা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ্রমহাকাল মানুষের কর্ম কীর্তি বহন করিয়া লইয়া যায়, রক্ষা করে; কিন্তু স্বয়ং কীর্তিমান্ মানুষকে সে রক্ষা করিতে চায় না। হোমার,বাল্মীকি, ব্যাস, কালিদাস, শেক্স্পীয়ার, নেপোলিয়ান, আলেকজান্ডার, প্রতাপসিংহ প্রভৃতির কীর্তিকথা মহাকাল বহন করিয়া লইয়া চলিতেছে, কিন্তু সে সেই সব কীর্তিমানদের রক্ষা করে নাই। যিনি প্রথম অগ্নি আবিষ্কার করিয়াছিলেন, বস্ত্রবয়নের তাঁত ইত্যাদি আবিষ্কার করিয়াছিলেন, তাঁহাদের নাম ইতিহাস রক্ষা করে নাই, কিন্তু তাঁহাদের কীর্তি মানব-সভ্যতার ইতিহাসে অমর হইয়া আছে।”
তাই তো কবিতার শেষে কবিকে বলতে শুনি,
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি--
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।গ্ধ
রূপকের মাধ্যমে কবির গভীর দর্শন ফুটে উঠেছে কবিতায়। কবি যেন এখানে একজন কৃষক আর তাঁর সাহিত্য হচ্ছে ধান। মহাকালে যদিওবা কবির সৃষ্টিকর্মের ঠাঁই হবে কিন্তু ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের ঠাঁই সেখানে নেই। সোনার তরীতে শুধু সোনার ধানই গ্রহনযোগ্য।
‹সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের সবক’টি কবিতা নিখুঁত ছ’েদ রচনা করেছেন কবি। উপমা এবং অলংকার প্রয়োগে তিনি যে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, তা যেকোনো পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে যায়। কবিতাগুলোতে ফুটিয়ে তুলেছেন আলো-আঁধারির এক অন্যরকম চিত্র।
সোনার তরীতে রয়েছে,‘পুরস্কার’‘বর্ষাযাপন’‘আত্মসমর্পণ’‘দেউল’‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’‘যেতে নাহি দেব’ এরকম অনেক বিখ্যাত কবিতা।
‘পুরস্কার’ কবিতায় কবির কাজেকর্মে উদাসীনতা লক্ষ্য করে কবির স্ত্রী বলেন,
‘অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা,
নিশিদিন ধরে এ কী ছেলেখেলা!
ভারতীরে ছাড়ি ধরো এইবেলা
লক্ষীর উপাসনা॥’
একজন কবির সংসার জীবনের চিত্রকে দীর্ঘ এই কবিতায় রসাত্মকভাবে উপস্থাপন করেছেন কবি; যা পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় পরিণতি শোনার আকাঙ্ক্ষায়।
রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী বাংলা কাব্যসাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। সোনার তরীতে সোনা ধান তুলে দিয়ে প্রকারান্তরে কবি নিজেই নৌকায় উঠে বসেছেন। দৈহিকভাবে তিনি আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তিনি তাঁর সৃষ্টির দ্বারা রয়েছেন সকলের অনুভবে।
১৫৮তম জন্মবার্ষিকীতেও তিনি মানুষের কাছে সমানভাবে চির উজ্জ্বল। তাঁর আবেদন ফুরাবার নয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।