Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মোশারফের একদিন

মুহাম্মদ কামাল হোসেন | প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

নববর্ষ ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। একদিন পরেই দেশব্যাপী উৎসবের আমেজ নিয়ে আসছে, সেই শুভ মাহেন্দ্রক্ষণ। মোশারফ করিমের আজ সকাল থেকে অফিসে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু।ওর জন্য পরিবারের সকল সদস্যই ব্যস্ত। কেউ জামা এগিয়ে দিচ্ছে, কেউ জুতা, কেউ’বা টাই। ছোট বলে পরিবারের খাতির যতœটাও একটু বেশি। মোশারফের স্বভাব চরিত্র মন্দ নয়।একটু বাউন্ডুলে টাইপের।আগ বাড়িয়ে কেউ বলতে পারেনা,কখন কী করে বসে। ওর ভিন্ন জাতকের রাশি। বন্ধুদের ধারণা ও আগাগোড়াই একটা কুফা।শনি গ্রহটা সারাক্ষণ বিপদসীমার কাছে ঘুর ঘুর করে।একটা না একটা কুফা লেগেই থাকে।মোশারফ যেখানে কুফাও সেখানে। নিশ্চিত কিছু একটা হবে।পরিবারের বাকি সদস্যদেরও টেনশন ওকে নিয়ে এজন্যই একটু বেশি।বিশেষ করে মিলাকে হারানোর পর থেকে মোশারফ কেমন জানি হয়ে যায়। মিলাকে অসম্ভব ভালোবাসত সে। বলা নেই কওয়া নেই- হঠাৎ একদিন মেয়েটি বাহিরে চলে যায়।উচ্চ শিক্ষার জন্য। ধনী পয়সাওয়ালা বাবা-মার একমাত্র মেয়ে বলে কথা। তাছাড়া মোশারফ করিমকে মিলার বাবার মোটেও পছন্দ নয়। চশমার ওপর দিয়ে কেমন জানি সন্দেহের চোখে পিটপিট দেখে। ভদ্রলোক তাকে দু’চোখে একদম সহ্য করতে পারেনা।মোশারফও জীবনে আর কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় নি। এদিকে কোন চাকুরীই তার ছয় মাসও টেকে না। স্বাধীনচেতা মানুষ।বরাবরি চাকুরী ছেড়ে চলে আসে। হন্ত দন্ত হয়ে সাহেরা বেগম ছুঁটে আসে-‘অ্যাই মোশারফ? শোন বাবা। “হ্যাঁ মা কী বলবে,তাড়াতাড়ি বল। “বাবা কিছু মুখে দিয়েছিস?খালি মুখে অফিসে যাস না। “না মা, আজ অত সময় নেই। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম।অফিসে যাচ্ছি,বিয়ে করতে নয়। দেখি বাহিরে গিয়ে কিছু একটা মেরে দিব। “ছিঃ অসভ্য ছেলের মত কথা! বাহিরে মেরে দিবি মানে কী?’ ‘আহহা, বুঝলে না?বাহিরে মেরে দিব মানে বাহিরে খাব। এখানে তুমি অসভ্যতা কোথায় দেখতে পেলে?’ ‘শোন বাবা। আজকের দিনটাতেও অন্তত কারো সাথে ঝগড়া-টগড়া বাঁধাস না। রাত পোহালেই নববর্ষ। এবারের নতুন বছরটা সম্পূর্ণ নতুনভাবে নতুন উদ্যোমে শুরু কর। এবার একটু মনটন দিয়ে চাকুরীটাও কর। একটু দায়িত্ব নিতে শিখ।নিজের পায়ে দাঁড়া। তোকে আমি খুব শিগগীর বিয়ে করাব। এভাবে আর কত দিন? ‘আচ্ছা মা, আমার হাতে সময় একদম নেই। এই দ্যাখো, আমি নিজের পায়েই দাঁড়িয়ে আছি, দিব্যি হাঁটাচলাও করছি। এমনিতে কুফা পিছু ছাড়ছে না।আমি চললাম। এসব প্যাঁচাল পরে শুনব।
মোশারফ এমনি।বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে।একবার বলেছে যখন,তখন বাহিরেই খাবে। কেউ আটকাতে পারবে না। সামনে লায়লা হোটেল। গলির উল্টোমুখে দোকানটা।গরীব অনাথ মেয়ে লায়লা দোকানটি চালায়।ব্যবসাপাতিও ভালো হয়।
‘অ্যাই লায়লা খাড়া কতা আছে। “কী কবি ক।টাইম নাই। “এত তাড়া কিসের? দেমাগ দেহাস ক্যান? সোন্দর হইছস বইলা?’‘মুই সোন্দর না বান্দর, তাতে তর কী রে?’ ষন্ডামার্কা বদরুল ছেলেটি মুহূর্তে শায়লার ডানহাত চেপে ধরে। হাত দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে বলে,‘আহারে! এই সোনার অঙ্গে কতো জাদু লুকিয়ে আছে। এই শক্ত কাজ তোমার জন্য নয় সুন্দরি, তোমাকে সারাজীবন রাজরানি করে রাখবো। ‘লায়লা একঝটকায় হাত নামিয়ে আনে। মুখে শ্লেষাত্মক খিস্তি দিয়ে বলে, ‘হালার পো হালা,রাজরানি না ছাই চুতমারানি!যা ফুট এখান থেকে। বাঁচতে চাইলে এখনি কেটে পড়।‘
মোশারফ করিম দুর থেকে দেখতে পায় দোকানের সামনে ছোট্ট একটা জটলা।বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে।ভিড় ঠেলে সে ভেতরে ঢুকে। ‘অ্যাই কী হয়েছেরে লায়লা? সমস্যা কী?’ হঠাৎ মোশারফকে দেখতে পেয়ে লায়লার চোখ চিকচিক করে উঠে। শশব্যস্ত ছুটে আসে।টুল পেতে দেয়।‘ভাই বহেন। অ্যাই হানে বহেন।বদরুল আমারে সবসময় বেইজ্জত করে।কটু কতা কয়।নানান ছুতোয় শইলে হাত দে।সাংঘাতিক ইভ টিজিং!’‘ব্যস, বেরেক বেরেক। আর বলতে হবে না।সব বুইঝা ফালাইছি।ওকে এক্ষুণি উপযুক্ত
বাডাম দিতে অইবো।
‘মোশারফ ওঠে দাঁড়ায়। মেজাজ বিগড়ে যায়। সিগারেটে টান দিয়ে মুখ গোল করে শূন্যে কুন্ডলী পাকিয়ে ধোয়া ছাড়ে।সোজা গিয়ে বদরুলের কুর্তার কলার ছেপে ধরে।চোখ মুখ লাল করে সজোরে কানের নিচে মারে চড়।‘হালার পো হালা, তোরে যেন এই মহল­ায় আর কোনোদিন জীবনে না দেহি।সোজা ঠ্যাং ভেঙে গলায় ঝুলায়ে হাতে ধরায়ে দিবো।তারপর মাইনসের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভিখ মাগবি।হালা কুফার বাচ্চা কুফা।না জানি আজকের দিনটাই আমার মাটি হয়।‘
দৈনন্দিন মহল­ায় নিত্য টুকিটাকি এসব ঝুট ঝামেলা লেগেই থাকে।আর এসবের বেশির ভাগ মোশারফকেই সামলাতে হয়।সবাই ভরসাও করে তাকে।মহল­ার গুন্ডা পান্ডা, চোর বদমাস’রা মারাত্বক ভয় পায় মোশারফকে।হোটেল থেকে বেরিয়ে মোশারফ সোজা ট্যাক্সি ধরে।মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যায় ধানমন্ডির অফিসে।ভেতরে ঢুকতেই অফিসের সুন্দরী বসকে দেখে সে টাসকি খায়।অত্যন্ত মিহি সুরে বলে,‘আপা আসব?’‘আপা মানে! কে আপনি?’‘না মানে,আমি মোশারফ করিম।আপনার অফিসের নতুন ষ্টাপ।আজই জয়েন করার কথা।‘
মিলা। অফিসের সুন্দরী বস। এ মুহুর্তে মেজাজ হট। তেলেবেগুনে। ঠিক কী কারণে বুঝা যাচ্ছে না। এটুকু জানতে পেরেছে মোশারফ খুব কাজের ছেলে। চৌকস আর দক্ষ। আজই জয়েন করার কথা। মিলা নিজেকে সামলালেন।টেবিলের ওপর থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,‘আসুন,ভেতরে আসুন। “থ্যাংক ইউ আপা। “শুনুন,আপা টাপা নয়। বলুন ম্যাডাম। “জ্বী জ্বী। “দেখেতো খুব চৌকস আর দক্ষ মনে হচ্ছে। অথচ প্রথম দিনেই ১০ মিনিট লেট! কেন? আপনি লেট লতিফ?’ ‘না মানে ম্যাডাম,বাসায় ব্রেকফাস্ট সেরে আসিনি।গলির ফুটপাতে লায়লা হোটেলে সেরে এসেছি। “লায়লা হোটেল?! ফাজলামো হচ্ছে?’
‘না মানে..ম্যাডাম..’ ‘থামুন। আর ম্যা ম্যা করতে হবে না।‘
মিলার চোখ জোড়া এতক্ষণ ভারি কালো বড় চশমার আড়ালে ছিল। মোশারফের কাছে ম্যাডামের কন্ঠস্বরটা কেমন জানি একটু চেনা চেনা লাগছিল। একিসঙ্গে চেহারাটাও। যদিও ভারী চশমা মুখটাকে প্রায় ঢেকে রেখেছে।মিলা চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। মোশারফ মিলাকে দেখে তো অবাক।একি!এতো মিলা!অবিকল মিলা!! যার জন্য মোশারফ পাগল পারা দু’দুটি বছর। মিলা মিটি মিটি হাসছে।চোখে মুখে দুষ্টুমীর ছটা। মোশারফের ক্ষণিক আগের খটকাটা এতক্ষণে পরিস্কার হল। ‘মিলা তুমি!! ’‘হ্যাঁ আমি।কেমন দিলাম ক্যাপসুল ফাইভ হান্ড্রেড ডোজেস?’ মোশারফ নিজের চোখকে যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রশ্নের পর প্রশ্ন ভিড় করে মনে। অবাক চোখে প্রশ্ন করে। ‘তুমি!! দেশে ফিরলে কবে?’’গত মাসে। এসেই ব্যবসার ভার কাঁধে তুলে নিলাম। তোমাদের বাসায়ও গিয়েছি। তোমাকে পাই নি।আন্টি আমাকে সব কিছু খুলে বলেছে।ভাবলাম তোমাকেও নিয়ে আসি। দু’জনে মিলেমিশে এতোবড় অফিস ও ব্যবসা একসাথে চালাই।একই সাথে ছেলেপুলে সংসারটাও। “মানে!!’ ‘আর কোন মানে টানে নয়। সারাজীবন এভাবে চির কুমার সেজে থাকবে নাকি?শোনো,অফিস সেরে দু’জনে সোজা কাজী অফিস। আর সময় নষ্ট নয়। এমনিতে অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি। এই দ্যাখ আমি সাজুগুজু করেই চলে এসেছি।আর হ্যাঁ অবশ্যই সেভটেভ করে পরিষ্কার হয়ে আমার সামনে আসবা। নইলে খবর আছে। “কিন্তু আংকেল,মানে তোমার বাবা...?!’ ‘বাবা নেই। হঠাৎ করে গত মাসে আমাদের রেখে দুনিয়া ছেঁড়ে চলে গেছেন। “বলো কী! আংকেল নেই!!’ ‘না নেই।‘মিলা কথা বলতে বলতে হঠাৎ আবেগী হয়ে ওঠে।অশ্রুসিক্ত চোখ টলমল করে। মোশারফ সান্তনা দেয়।মিলা মুহূর্তে জড়িয়ে ধরে তাকে। ‘মোশারফ আমি আর পারছি না।বড্ড একা একা লাগে নিজেকে। খুব অসহায়ও লাগছে।আমাকে ধরে রেখ শক্ত হাতে। এমনিতে মেজাজ বিগড়ে ছিল,তোমার আসতে দেরী দেখে। ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আসবেনা।’
এতক্ষণে মোশারফ বুঝতে পারলো,মিলার রাগটা আসলে কেন।রাত পোহালেই নববর্ষ। সারাদেশব্যাপী উৎসবের রঙিন আমেজ।এবারের নববর্ষ মোশারফের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।মিলা ফিরে এসেছে মোশারফের জীবনে দ্বিগুণ আনন্দ নিয়ে।এদিকে বাসায় মূহুর্তে ধুম লেগে গেছে।বিয়েটা কাজি অফিসে নয়। বাসাতেই হচ্ছে। মোশারফের মা’র এমনটাই ইচ্ছা। সে শুধু ফোন করে মাকে বলেছে,‘মিলাকে নিয়ে আসছি,সঙ্গে কাজি।বিয়েটা আজই হচ্ছে।শুভকাজ কালকের জন্য ফেলে রাখতে নেই।হালার কুফার ওপর বিশ্বাস নেই।অনেকদিন পর নববর্ষের আমেজে অন্তত একটা দিন ভাল পাওয়া গেছে।আজকের দিনটা কুফা নয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মোশারফের একদিন

১৯ এপ্রিল, ২০১৯
আরও পড়ুন