Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাংলাদেশই হতে পারে আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রের রোল মডেল

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

পরিবর্তনশীল মুসলিম বিশ্বে আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে আগামীতে বাংলাদেশই নেতৃত্ব দেবে- এমন সম্ভাবনার কথা রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে ইসলাম বিশারদ ও পন্ডিত ব্যক্তিদের মুখে জোরেসোরে উচ্চারিত হচ্ছে। তাদের এই আশাবাদ অমূলক নয়। ভৌগলিক অবস্থান ও ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে, মুসলমানদের মধ্যকার সুদৃঢ় বন্ধন এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির অনুকুল পরিবেশের কারণেই বাংলাদেশকে আদর্শ মুসলিম দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদরা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের অন্তর্গত বিষয় এবং বিশ্বাসের ভিত্তি এবং এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই, এ বাস্তবতার আলোকেই এ কথা বলছেন। অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বী দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দেশগুলো তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের প্রাধান্য দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা হয় না। মুসলমান প্রধান দেশগুলোও একই পন্থা অবলম্বন করে। ১৮৫৭ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান উপমহাদেশে শিক্ষাÑদীক্ষায় পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ভারতে সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স¤পৃক্ত হতে হলে মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। তার এই আত্মোপলব্ধি থেকেই তিনি ভারতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মুসলমানদের যুগোপযোগী ও আধুনিক শিক্ষা ধারায় সম্পৃক্ত করতে তার এই চিন্তা ছিল অতুলনীয় এবং সুদূরপ্রসারী। মুসলমানদের শিক্ষা ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রণী ভূমিকার কথা সবারই জানা। বিশ্বে বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনেক নজির রয়েছে। ১৯১৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের বানারসÑএ বানারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি গড়ে উঠে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ডো ও ফ্লোরিডায় ১৯৯৩ সালে গড়ে উঠে হিন্দু ইউনিভার্সিটি অফ আমেরিকা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইয়োগা, মেডিটেশন ও হিন্দুত্ববাদ নিয়ে পড়াশোনা করানো হয়। আমেরিকা ও কানাডায় বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে দশটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকায় রয়েছে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে দ্য ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকা খ্রিস্টানদের মধ্যে অত্যন্ত প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। অর্থাৎ ধর্মীয় চেতনা, মূল্যবোধ এবং নীতিÑনৈতিকতা সমুন্নত রাখতে ধর্মকে কেন্দ্র করে বিশ্বে অনেক আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ বাস্তবতা কেউই উপেক্ষা করেনি। আমাদের দেশে কুষ্টিয়ায় একটি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং স্বতন্ত্র একটি ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হিসেবে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরী। লাখ লাখ মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিতে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় অপরিহার্য। এতে এক দিকে যেমন মাদরাসা শিক্ষা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত হতে পারবে, তেমনি ইসলামী বিশ্বে একটি আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে যে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে, তা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
কিছু ব্যক্তি আছেন যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে বাংলাদেশকে তথাকথিত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। তাদের এ কথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনা ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। বাস্তবতার বিচারে তা গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা স্রোতের বিপরীতে চলার শামিল। তাদের বোঝা উচিত, মুসলমান প্রধান দেশ হয়েও বাংলাদেশের মতো সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধন বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নেই। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সাথে পারস্পরিক সহবস্থানের মধ্যে থেকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নাগরিক তাদের স্ব স্ব ধর্ম পালনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অবিচ্ছেদ্য। এমনকি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়া সত্তে¡ও আলাদা কোনো শরিয়া ভিত্তিক আদালত নেই। অথচ মালয়েশিয়ায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং তাদের আলাদা শরিয়া ভিত্তিক আদালত রয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের শরিয়া ভিত্তিক আদালত নেই। এ থেকেই তাদের বোঝা উচিত, অন্য যে কোনো মুসলিম দেশের চেয়ে বাংলাদেশের মুসলমানরা চিন্তাÑচেতনা ও সহনশীলতায় অনেক এগিয়ে। কাজেই বাস্তবতা মেনে নিয়ে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষাকে কিভাবে উন্নত ও আধুনিক করা যায়, এদিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। শত বছর ধরে আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখরা এ চিন্তা করে আসছেন। তারা উপলব্ধি করেছেন, মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক ও যুগোযোগী করতে না পারলে পিছিয়ে থাকতে হবে।
দুই.
অনেকে রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহার অনুচিত বলে মনে করেন। তাদের এ কথা মেনে নিয়েও বলা যায়, যিনি রাজনীতি করেন, মন্ত্রীত্ব করেন এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকেন, তিনি যদি প্রকৃতই ধর্মে বিশ্বাসী হন (যে ধর্মেরই হোক), তবে তার কর্মকাÐে ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-আচরণের প্রভাব ও প্রতিফলন থাকবেই। এক্ষেত্রে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির প্রয়োজন পড়ে না। বরং তার ধর্ম বিশ্বাসই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে পরিচালিত করে। মুসলমান প্রধান দেশ হওয়াতে আমাদের সামাজ ও পারিবারসহ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ইসলামের চেতনাবোধ রয়েছে। যে কোনো শুভ কাজ শুরুর আগে মুসলমানরা ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করেন। আত্মবিশ্বাসী হওয়ার ক্ষেত্রে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে শেষ করেন। এটা তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা থেকেই করেন। অর্থাৎ হাজার বছর ধরে আমাদের দেশের মুসলমানদের অন্তরাত্মায় ইসলামী মূল্যবোধের চেতনা প্রোথিত হয়ে আছে। এটাই বাংলাদেশের মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য। আধুনিক বিশ্বের মোড়ল হিসেবে পরিচিত আমেরিকা কি ধর্মকে উপেক্ষা করতে পারছে বা করছে? মোটেই না। বরং তারা রাষ্ট্র পরিচালনা শুরুই করেন ধর্মের উপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে। আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যখন শপথ গ্রহণ করেন, তখন সাধারণত তিনি বাম হাত বাইবেলের উপর রেখে ডান হাত উঁচিয়ে ধরেন। শপথের শেষ বাক্যে বলেন, ‘সো হেল্প মি গড’। তারা যে কোনো সভা-সমাবেশ এই বলে শেষ করেন, ‘গড বেøস আমেরিকা’। এমনকি তাদের যে ডলার, সেখানেও তাদের ধর্মের প্রতি আস্থা এবং ব্যবহার রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’। অর্থাৎ তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও ধর্মের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে এবং তারা তা মেনে চলেন। এ নিয়ে আমেরিকার নাগরিকদের মধ্যে কোনো হইচই হতে দেখা যায় না। এমনকি সেখানে যারা ধর্ম বিদ্বেষী বা ধর্মের নাম শুনলেই রেগে যান, তারাও ধর্মের কথা লেখা ডলারই ব্যবহার করছেন। অথচ আমাদের দেশের কিছু লোক, যারা নিজেদের অতি প্রগতিবাদী মনে করেন, কেউ ধর্মের কথা বললেই মনে করেন তিনি মৌলবাদীÑতারা এ কথা বুঝতে চান না, বাংলাদেশের মতো ধর্মপ্রাণ মুসলমানপ্রধান দেশে ধর্মের প্রাধান্য থাকাই স্বাভাবিক এবং এই বাস্তবতা উপেক্ষার সুযোগ নেই। বরং তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার ধোঁয়া তোলার মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ ও মতলববাজি রয়েছে। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের হাজার বছরের সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফায়দা লুটতে চান। পার্শ্ববর্তী ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলা হলেও, সেখানে ধর্মকে বাদ দিয়ে জীবনচর্চা হয় না, রাজনীতিও হচ্ছে না। বিজেপির মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল যে কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষবাদী দলকে ধুলোয় মিশিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছিল তার মূলেই ছিল দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সমর্থন। এ থেকে প্রমাণিত হয় ধর্ম নিয়ে ভারতে রাজনীতি আছে এবং তারা ধর্ম দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। বিশ্বে তারা বিভিন্নভাবে তাদের ধর্মাচার তুলে ধরছে। মুম্বাইয়ের সিনেমা এবং ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলোতে অহরহ তাদের ধর্মকে ব্যবহার করে চলেছে। ঘরে আলাদা করে পুজোর জন্য দেব-দেবীর মূর্তি রেখে দেয়া এবং মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করার দৃশ্য প্রায় প্রত্যেক সিনেমা ও সিরিয়ালে দেখানো হচ্ছে। হলিউডের সিনেমায়ও গির্জায় গিয়ে এবং খাওয়ার আগে প্রার্থনার দৃশ্য অহরহ দেখানো হচ্ছে। অন্যদিকে মুসলিম প্রধান দেশ হয়েও আমাদের দেশে এ সময়ের সিনেমা বা মেগা সিরিয়ালে ধর্মচর্চার ব্যবহার দেখানো হয় না বললেই চলে। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হয়েও একটি উদার ও অসা¤প্রদায়িক ইসলামী রাষ্ট্রের নিদর্শন রাখতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে ধর্ম নিয়ে কখনোই উগ্রতা প্রদর্শন বা বাড়াবাড়ি হয় না, হওয়ার আশঙ্কাও নেই। কিছু লোক যারা, ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলেন বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কার কথা বলেছন, তারা প্রকারন্তরে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছন।
তিন.
ধর্মের প্রতি মানুষের উদাসীনতা আত্মিক বন্ধন শিথিল করে। নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধকে দূরে ঠেলে দেয়। বিশ্বাসী মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা ধর্মীয় আচারÑআচরণ থেকে দূরে থাকলেও, যে কোনো বিপদে-আপদে বা অসুখ-বিসুখে ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। এমনকি ধর্মীয় কোনো উপলক্ষ বা সমাবেশে তাদের সুপ্ত বিশ্বাস জাগ্রত হয়। অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে রমজানে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় আচরণ ও অনুশাসনের চর্চা বেশি দেখা যায়। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবেও এ ধারা লক্ষ্যণীয়। ধর্মের প্রতি তাদের মনে গভীর অনুরাগ সৃষ্টি এবং এর প্রতিফলন তাদের জীবনাচারে প্রতিফলিত হয়। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয়। অর্থাৎ মানুষের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি ও মূল্যবোধ ধরে রাখার ক্ষেত্রে ধর্মই মূল নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে যে সংঘাত-সহিংসতা চলেছে, তার পেছনে ধর্মীয় মূল্যবোধের সংকটই কাজ করছে। ব্রিটেনে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং মাদকাশক্তি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে সামাজিক ও পারিবারিক শৃঙ্খলাবোধ এবং নীতিÑনৈতিকতার সংকটকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এক সময়ের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এ ব্যাপারে মুসলমানদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ক্ষয়ীষ্ণুৃ ব্রিটিশ সংস্কৃতির উন্নয়ন ও মর্যাদা রক্ষায় মুসলমানরা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি ব্রিটিশদের জীবনধারা অন্য কোনো দেশের ধারায় নয়, এশিয়ানদের মতো হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। এতে ব্রিটিশদের পারিবারিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতায় আমূল পরিবর্তন আসবে বলে তিনি মনে করেন। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এ উপলদ্ধি থেকে বোঝা যায়, ব্রিটেনে যে সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয় চলছে, তার মূলে মূল্যবোধের সংকটের বিষয়টিই প্রধান কারণ হয়ে রয়েছে। এ সংকটের পেছনে ধর্মীয় চেতনাবোধের অভাব রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তার এ কথার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য্য হচ্ছে, মুসলমান রীতি-নীতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং এশিয়ানদের সুশৃঙ্খল পারিবারিক জীবনযাপনের ধারাই পারে তাদের সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাতে। বিষয়টি উপলব্ধি করে সে সময় আংশিক রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত বানিজ্যিক চ্যানেল ‘ফোর’ পবিত্র রমজান উপলক্ষে রমজানের প্রতিদিন তিন মিনিট ফজরের আজান প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফজরের আজান প্রচার করা ছাড়াও অপর চার ওয়াক্ত নামাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য ২০ সেকেন্ডের একটি ভিডিওচিত্র প্রচার করেছিল। পাশাপাশি তাদের ওয়েব সাইটেও তা স¤প্রচার করা হয়। ইউরোপের কোনো মূলধারার টিভি চ্যানেলে আজান প্রচারের নজির সেটিই ছিল প্রথম। সে সময় চ্যানেল ফোরÑএর অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান র‌্যালফ লি বলেছিলেন, যুক্তরাজ্যে যে কয়টি ধর্মের প্রসার ঘটছে, তার মধ্যে ইসলাম অন্যতম। তিনি বলেছিলেন, যারা ইসলামকে সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন, তাদের ভুল ভাঙ্গানোর জন্যই আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বেও ইসলামের মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে এখন স্বীকার করা হচ্ছে। ইসলাম যে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ অটুট রাখার বর্ম এবং শান্তির ধর্ম, তা তারা উপলব্ধি করতে পারছে।
ধর্মের প্রতি আকর্ষণ এবং সংবেদনশীলতা আমেরিকানদের মধ্যেও প্রবল। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কোন ধর্মাবলম্বী তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। তিনি মুসলমান নাকি খ্রিস্টান, এ নিয়ে আমেরিকানদের মধ্যে সন্দেহ দেখা দেয়। সে সময় ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়ার এক জরিপে দেখানো হয়, শতকরা ২০ ভাগ আমেরিকান মনে করে ওবামা মুসলমান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতে থাকে, তিনি গোপনে মুসলমান ধর্ম পালন করেন, মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন, ২০০৫ সালে সিনেটর হিসেবে কোরআন হাতে নিয়ে শপথ নিয়েছিলেন, তার নামের মাঝে মুহম্মদ আছে এবং তিনি খ্রিস্টান বিরোধী। আমেরিকানদের এই উদ্বেগের কারণ ছিল, তারা কোনোভাবেই তাদের ধর্ম বিশ্বাসের বাইরের একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে চাচ্ছিল না। এসব বিতর্ক এড়াতে ওবামাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। বিতর্কের অবসান ঘটাতে তাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে হয়েছিল, ‘আমি একজন খ্রিস্টান। প্রতিদিন প্রার্থনা করি। আমি মনে করি, ‘আমি যে খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী, আমার কর্মকাÐের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ করা আমার দায়িত্ব। তিনি ধর্মীয় আবেগ থেকে বলেছিলেন, আমরা মানুষ। মানুষই ভুল করে, পাপ করে। সৃষ্টিকর্তার দয়ার মধ্য দিয়ে এ থেকে আমরা মুক্তি পাই।’ সে সময় ওবামাকে নিয়ে আমেরিকানদের এই উদ্বেগের মধ্য দিয়ে এটাই প্রতীয়মান হয়, আমেরিকানদের অধিকাংশের জীবনযাপনে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা না থাকলেও, অন্য ধর্মের প্রেসিডেন্টকে মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অর্থাৎ তারাও ধর্মকে সমুন্নত রাখতে সবসময়ই তৎপর। ধর্মের প্রতি বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের জনগণ যখন অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল, তখন আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে এই চেতনা আরও বেশি কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক।
চার.
বাংলাদেশে যে ধর্মীয় কোন উন্মাদনা নেই, তা বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো বহুবার বলেছে। তারা বাংলাদেশকে একটি ‘মডারেট মুসলিম কান্ট্রি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বলা বাহুল্য, যেখানে বিশ্বের কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের এক ঘোষণাতেই জঙ্গী ও সন্ত্রাবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রই বাংলাদেশকে বারবার মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন সময়ে সেদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশ সফরে এসেও এ ধরনের কথা বলেছেন। অর্থাৎ বিশ্বে সহনশীল ও সব ধর্মের মানুষের বসবাসের আদর্শ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেয়েছে। এ স্বীকৃতির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সামনে বিশ্বে একটি আদর্শ এবং আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রের রোল মডেল হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য ইসলামী মূল্যবোধ, আচারÑআচরণ এবং রীতিÑনীতি চর্চা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে ব্যাপক পরিকল্পনা নেয়া অপরিহার্য। মাদরাসা শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে আরও ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া জরুরী। মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করার জন্য বেসরকারি উদ্যোগেও স্বতন্ত্র ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা উচিত। বাংলাদেশে বাংলা ও ইংরেজী মাধ্যমের অসংখ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কোনো ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় নেই। আমরা মনে করি, মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করতে বেসরকারীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এই উদ্যোগের মাধ্যমেই বাংলাদেশ বিশ্বে একটি আধুনিক ইসলামী দেশের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
[email protected]



 

Show all comments
  • তামিম ৫ এপ্রিল, ২০১৯, ৪:১৪ এএম says : 0
    আল্লাহ যেন আপনার কথাগুলো কবুল করে নেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Billal Khan ৫ এপ্রিল, ২০১৯, ৪:১৬ এএম says : 0
    Thanks to the writer
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম

৩ মার্চ, ২০২৩
২ মার্চ, ২০২৩
১ মার্চ, ২০২৩
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন