Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

এফ আর টাওয়ারের স্ল্যাব-বিমে ফাটল

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:৩৭ এএম

আগুন লাগা বনানীর বহুতল ভবন এফ আর টাওয়ার হেলে পড়েছে। কলাম ও স্ল্যাব ভেঙে গেছে, যা সংস্কার করতে সময় লাগবে তিন মাস। গতকাল বেলা ১১টার দিকে বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি ভবনটি পরিদর্শন শেষে এ তথ্য জানান। গণশুনানি শেষে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফয়জুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আটতলা (সেভেন ফ্লোর) থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্য দিকে মামলায় ভবনের বর্ধিত অংশের মালিক তাসভির উল ইসলাম (৬৬) ও ভবনের জমির মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুকের (৭৫) সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অনুমোদন না নিয়ে যারা ভবন নির্মাণ করেছেন এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার যেসব দায়িত্বশীল কর্মকর্তার গাফিলতি রয়েছের, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। ভবনের বিভিন্ন ফ্লোর মালিকদের হয়রানি না করে প্রকৃত জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হলে এ ধরনের অনিয়মের সংখ্যা কমে আসবে বলে তারা মনে করেন। ওই ভবনে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাবিবুল আলম বলেন, প্রকৃত অপরাধীদের একজন রূপায়ণ গ্রুপের মালিক। তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিত। সাধারণ ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হলে দুর্নীতিবাজরা পার পেয়ে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংস্কারের আগে ভবনটি ব্যবহার করা যাবে না। এ দিকে হেলে যাওয়ায় ঝুঁকিতে রয়েছে পাশের ভবন এ আর টাওয়ারে অবিস্থিত সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরাও ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। অগ্নিকান্ডের পর প্রকৃত অর্থে কে এমনটি ঘটাল, কারা দায়ী বা কাদের গাফিলতি ছিল- এগুলোর বিশ্লেষণ কখনো হয় না। এসব বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ড ঘটলে কী কী ব্যবস্থা ও উপকরণ থাকা উচিত, এ প্র্যাকটিস অনেক ক্ষেত্রেই নেই।
তদন্ত কমিটির সদস্য ও বুয়েটের শিক্ষক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও ফায়ার সেফটি কোড অনুযায়ী সংস্কার ছাড়া এফ আর টাওয়ার ব্যবহার করা যাবে না। ভবনে কলাম ও স্ল্যাব ভেঙেছে এবং এটি কিছুটা হেলেও পড়েছে। এই ভবন সংস্কারে কমপক্ষে তিন মাস লাগবে। ভবনটিতে ফায়ার এক্সিট ছিল নামমাত্র। কার্যকরও ছিল না।
তিন মাস লাগার কারণ ব্যাখ্যা করে বুয়েটের শিক্ষক বলেন, ভবনে জরুরি নির্গমন পথ ছিল খুবই অপ্রশস্ত। কেবল একটি ফ্লোরে ফায়ার ডোর ছিল। আরো বেশ কিছু জায়গায় ত্রুটি রয়েছে ভবনটিতে। এগুলো সংশোধন ছাড়া ভবনটি ব্যবহার করা যাবে না। ভবনে জরুরি নির্গমনের পথ ছিল না জানিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক রাকিব আহসান বলেন, পরিদর্শনের সময় আমরা দেখেছি যে, ভবনে জরুরি নির্গমন পথটি কোনো কোনো জায়গায় বন্ধ ছিল।
আগুনের সূত্রপাত কিভাবে হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমাদের তদন্তের মূূল ইস্যু নয়। আমাদের যেটা মনে হচ্ছে ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট হতে পারে। এজন্য বিল্ডিং কোড মেনে এটা করা হয়েছে কি না, ইলেকট্রিক সেফটিটা ঠিক ছিল কি না, সেই ডিটেইল অ্যাসেসমেন্টে যাচ্ছি। ওটা করলে বিল্ডিংয়ের তারে যদি কোনো সমস্যা থাকে, ফায়ারের প্রিভেনটিভ মেজার্সে কোনো সমস্যা থাকে, স্ট্রাকচারাল কোনো সমস্যা থাকে- সেগুলো চিহ্নিত করে ১৫০ দিনের মধ্যে একটা রিপোর্ট দেবে। এরপর সংস্কারমূলক কাজগুলো করে এটাকে চালিয়ে নেয়া হবে।
১৮ তলা ভবনটি ২৩ তলা করায় তা কতটা ঝুঁকি তৈরি করেছে সেটি খতিয়ে দেখতে ইট ও কংক্রিট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞ কমিটিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক, রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী ও সচিব (উন্নয়ন) এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রয়েছেন। এই কমিটি তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেবে।
আটতলা থেকেই আগুনের শুরু
গণশুনানিতে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, আটতলা (সেভেন ফ্লোর) থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। অগ্নিকান্ডের বিষয়ে জানতে ওই ভবনে কর্মরতদের গতকাল সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি।
গণশুনানি শেষে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফয়জুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা মোট ২৪ জনের বক্তব্য রেকর্ড করেছি। তারা কেউ আটতলায় কাজ করতেন না। প্রত্যক্ষদর্শীরা ৯, ১০ থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত বিভিন্ন ফ্লোরে কাজ করছিলেন। ৯ ও ১০ তলার লোকজন আগুন লাগার পর নিচে নামতে দেখতে পেয়েছেন যে, নিচতলা অর্থাৎ আটতলায় আগুন জ্বলছে। এ সময় তারা প্রচন্ড ধোঁয়াও দেখতে পান। পরে তারা ওপরের দিকে উঠে পাশের ভবন ব্যবহার করে বের হয়ে আসেন। তারা বলেছেন, আটতলায় বায়িং হাউজ স্পেক্ট্রা এসেনসিয়াল থেকেই আগুন লেগেছে। আগুন লাগার কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে এ আগুন লাগতে পারে।
অতিরিক্ত সচিব বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীরা বললেও আমরা এখনই এই সিদ্ধান্তে যাচ্ছি না। আমরা তাদের বক্তব্য শুনেছি, তারা বলেছেন আগুন আটতলা থেকেই লেগেছে। আগামীকাল আটতলার কর্মরত ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনব। এরপর এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তিনি বলেন, শুনানিতে আট তলার একজন গার্ড ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আট তলার গ্লাসের ভেতর থেকে তিনি আগুন দেখতে পেয়েছেন। একপর্যায়ে তাপে গ্লাস ভেঙে যায়। ভবন মালিকদের কাছে কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। এখনো পাইনি। শনিবার ভবন মালিকদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনেছি আমরা। প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময়সীমা আগামী ৩ এপ্রিল, আমরা নির্ধারিত এই সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেবো।
অন্য দিকে ছয়জনের সাক্ষ্য নিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। তাদের বর্ণনায় উঠে এসেছে আট তলা থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর নিয়াজ আহমেদ বলেন, এখনই সিদ্ধান্ত জানানো যাবে না। এখন পর্যন্ত জানা গেছে, আটতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আমরা আরো সাক্ষ্যগ্রহণ করব।
অগ্নিকান্ডের মামলা ডিবিতে
এফ আর (ফারুক রূপায়ণ) টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় করা মামলা ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল রোববার সকালে মামলাটি ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছেন ডিবির পরিদর্শক জালাল। এ ঘটনায় শনিবার রাতে বনানী থানায় মামলা দায়ের করা হয়। বনানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মিল্টন দত্ত বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
মামলা তিনজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন, জমির মালিক এস এম এইচ আই ফারুক (৬৫), রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান ওরফে মুকুল (৫৭) ও কাশেম ড্রাইসেল লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী তাসভিরুল ইসলাম (৬২)। এ ছাড়া এফ আর টাওয়ার বিল্ডিংয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতাসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন তাসভিরুল ইসলাম ও জমির মালিক এস এম এইচ আই ফারুক। কেবল বাকি রয়েছেন রূপায়ণ গ্রুপের মালিক লিয়াকত আলী খান ওরফে মুকুল।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ডিবি পুলিশের পরিদর্শক জালাল উদ্দিন গতকাল অভিযুক্তদের আদালতে উপস্থিত করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। অপর দিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদের জামিন আবেদন করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরী উভয়পক্ষের শুনানি শেষে তাসভিরুল ইসলাম এবং এস এম এইচ আই ফারুকের বিরুদ্ধে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলায় তাসভিরুল ইসলাম এবং এস এম এইচ আই ফারুকের বিরুদ্ধে অসৎ উদ্দেশ্যে পরস্পর জোগসাজশে মানুষের জানমালের ক্ষতি, অবহেলা ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ কার্যকলাপের ফলে অপরাধজনক অগ্নিকান্ডে মানুষের প্রাণহানি, মারাত্মক জখমসহ সম্পদের ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয়।
গতকাল দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় ইতোমধ্যে ফারুক ও তাসভিরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজউক, মালিকপক্ষ এবং ডেভেলপার কোম্পানিদের মধ্যে কার কী ভূমিকা ছিল, দেখা হবে। সব অপরাধগুলো পর্যালোচনা করে তদন্ত শেষে তাদের গাফিলতি ও অপরাধ চিহ্নিত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হবে।
মামলার তদন্তে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না জানিয়ে ডিবির ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা বলেন, তদন্তে অপরাধ অনুযায়ী সবাইকেই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। মামলার অন্যতম আরেক আসামি রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান পলাতক রয়েছেন, তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
গত ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর ৩২ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহভাবে আগুন লাগে। ভবনটির আটতলা থেকে শুরু হওয়া আগুন বেশ কয়েক তলায় ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে পুড়ে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এবং নিচে নামতে গিয়ে পড়ে মারা যান সব মিলিয়ে ২৬ জন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: এফ আর টাওয়ার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ