পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মহাসড়ক থেকে শুরু করে রাজধানীসহ অধিকাংশ নগরীর সড়কে পরিবহনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সড়কগুলো পরিবহন চালকদের দ্বারা যেমন খুশি তেমন ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনায় ঝরছে একের পর এক অমূল্য প্রাণ। দুর্ঘটনায় সব শ্রেণীর মানুষেরই অকাল মৃত্যু হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে তাদের সহপাঠীরাই কেবল প্রতিবাদে রাস্তায় নামছে। এতে সংশ্লিষ্ট খাতের কর্তৃপক্ষের কিছুটা টনক নড়ে এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগী হতে দেখা যায় কিন্তু কিছু দিন যাওয়ার সাথে সাথে তা আগের অবস্থাতেই ফিরে যায়। সড়ক-মহাসড়কে এই নৈরাজ্য যেন কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। স্বয়ং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াকেও অসহায় হয়ে বলতে হয়েছে, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। গত বৃহস্পতিবার ডিএমপি ট্র্যাফিক (পূর্ব) কর্তৃক এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, আমারা সবাই রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছি। তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, পরিবহন মালিক, শ্রমিক, পুলিশ, সিটি করপোরেশন এবং পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সাথে বসে বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি এ কথাও জানান, মামলা করেও রুট পারমিটবিহীন বাসের অবিরাম চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে। পরিবহন খাত নিয়ে পুলিশ কমিশনারের এই সরল স্বীকারোক্তি থেকে বোঝা যায়, সড়কে পরিবহন নৈরাজ্য ঠেকাতে চলমান কোনো উদ্যোগেই কাজ হচ্ছে না এজন্য পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে একসঙ্গে উদ্যোগ নিতে হবে।
সড়ক-মহাসড়কে পরিবহন নৈরাজ্য আমাদের দেশের মতো বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা, জানা নেই। যুগের পর যুগ ধরে এ নিয়ে বহু কথা হলেও কোনো কাজই হচ্ছে না। পরিবহন খাতের সাথে জড়িতরা এতই ক্ষমতাবান যে সরকারের নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং উদ্যোগকে কোনো তোয়াক্কাই করছে না। সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূলত পরিবহন চালকদের বেপরোয় মনোভাব, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ভুয়া লাইসেন্সকে দায়ী করা হলেও এদের মূলে রয়েছে সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানির প্রভাবশালী মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। এদের প্রশ্রয় এবং অধিক ট্রিপ দেয়ার বাধ্যবাধকতা এবং চাপ পরিবহন চালকদের বেপরোয়া করে তুলেছে। চিরাচরিত যানজট, নগরীতে পর্যাপ্ত সড়কের অভাব, যেটুকু সড়ক রয়েছে তার মধ্যে দখলদারিত্ব, অবৈধ পার্কিং, উল্টোপথে গাড়ি চালানো, সড়ক ব্যবস্থাপনার ত্রæটি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি, যাত্রী ও পথচারীদের অসচেতনতা তো রয়েছেই। এরকম চরম অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যদি বছরের পর বছর চলতে থাকে, তবে সড়কের নৈরাজ্য কোনোদিনই দূর হবে না। তার উপর রয়েছে পরিবহন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব। এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই কিছুদিন পর পর ট্র্যাফিক সপ্তাহ, পক্ষকাল ব্যাপী কর্মসূচি পালন করা হয়। বিষয়টি জঞ্জালের মধ্যে ডুবে মুক্তা খোঁজার মতো। জঞ্জাল সরিয়ে মুক্তা খুঁজলে যে তা সহজে পাওয়া যায়, এ বুদ্ধিটুকু কারো মাথায় আসছে না। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, পরিবহন চালক বা শ্রমিকদের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে যদি আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়, তবে তারা পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়ে দল বেঁধে রাস্তায় আন্দোলনে নামে। অন্যায় স্বীকার না করে উল্টো মানুষকে জিম্মি করে ফেলে। সরকারও তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। তাদের দাবী মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে শান্ত করে। দেখা যাচ্ছে, সড়কের রাজা হয়ে আছে পরিবহন সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিকরা। তারা তাদের ইচ্ছামতো চলবে এবং তাদের কথামতোই সড়ক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণকারীদের চলতে হবে। এ ধরনের অনাচার কেবল আমাদের দেশেই দেখা যায়। সড়ক সংশ্লিষ্ট যে মন্ত্রণালয় রয়েছে, সেখান থেকে সড়কে বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে প্রায়ই কঠোর বার্তা দেয়া হয়। বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। সড়কে লক্কর-ঝক্কর মার্কা ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলবে না, সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে, মহাসড়কে নসিমন-করিমন, ভটভটি, থ্রি হুইলার চলবে না বলে ঘোষণা দেয়া হলেও, শুরুতে কিছুদিন এসব অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর পুনরায় তা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের ইঁদুর-বেড়াল খেলা চলছে। স্বয়ং মন্ত্রণালয় যদি তার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে না পারে, তবে এ পরিস্থিতির অবসান কি কোনো দিন হবে?
সড়কে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য নিয়ে অনেক কথা-বার্তা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এখন এসব কথা-বার্তা বাদ দিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। সড়ক-মহাসড়কে যেসব যানবাহন চলাচল করে সেগুলোর মালিক হোক, সংগঠন হোক এবং যতই প্রভাবশালী ব্যক্তি হোক, তাদের মনোভাবের পরিবর্তন করতে হবে। পরিবহন শুধু ব্যবসা নয়, এটা সেবারও কাজ, তাদের মধ্যে এ নীতি-নৈতিকতা বোধ থাকা বাঞ্চনীয়। ক্ষমতার জোর নয়, মানবিকতা এবং জীবনের মূল্য তাদের বুঝতে হবে। যে পরিবারের সদস্যের মৃত্যু হয়, সে ছাড়া এ কষ্ট আর কেউ বুঝতে পারে না। যারা যানবাহন চালায়, কিংবা মালিক তারা এবং তাদের পরিবারেরও অনেকে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। তখন যে বেদনা তারা অনুভব করে, তাদের ভুল এবং ভুল নীতির কারণে দুর্ঘটনায় একজন যাত্রীর মৃত্যু হলে তার পরিবারও একই বেদনা অনুভব করে। কাজেই এক্ষেত্রে তাদের সচেতন হতে হবে। নিজেকে যেমন বাঁচাতে হবে, তেমনি অন্যকেও বাঁচাতে হবে-এ চিন্তা করতে হবে। যারা সড়ক পথে চলাচল করে বা রাস্তা পারাপার হয়, তাদেরকেও সচেতন হতে হবে। রাস্তা পারাপারের নির্ধারিত স্থান দিয়ে যাতায়াত করতে হবে এবং তা সভ্যতারও পরিচায়ক। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসহায়ত্ব প্রকাশ কাম্য হতে পারে না। এতে বেপরোয়া চালক আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে, ফিটনেস ও রুট পারমিটবিহীন গাড়ি আরও বৃদ্ধি পাবে। তখন তা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সড়ক-মহাসড়কের যে কোনো অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সড়ক পরিবহনের সাথে মালিক-শ্রমিক সংগঠনসহ সরকারি যেসব স্টেকহোল্ডার জড়িত তাদের সকলের কাজের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। মহাসড়কে কেবল মহাসড়ক উপযোগী যান চলাচলের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে এবং এসব যানবাহনের চালকদের সচেতন ও দক্ষ হতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।