শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
সেদিন ছিল আলোকময় দিন। চা’বাগানের রাস্তা ও চারপাশ ছিল নির্জনতায় মোড়া। তার গায়ে ছিল খয়েরী রংঙের শেরওয়ানী। মনে হচ্ছিল কোন এক অদৃশ্য সূতার টানে যেন আকাশ-ও জমিনের মধ্যখানে দোল ছিলেন আমার গুরু কবি আল মাহমুদ। মুখে ছিলো গোপন হাসি। এ দৃশ্যটা আজও আমার মগজে সেলাই হয়ে আছে। স্মৃতির পাতায় যা যোগান দেয়, তাহল-আনুমানিক ১৯৯৭/১৯৯৮ সালে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে, ¯’ানীয় কবি আবদুল আজিজের একটি কাব্যগ্রšে’র প্রকাশনা অনুষ্ঠান ছিলো। কবি আল মাহমুদ ছিলেন অনুষ্ঠানের চীফগেস্ট, আমি বিশেষ অতিথি। গেস্টহাউজে দুপুরের খাবারের আগে, আমি তাকে বললাম, (পাশের খাট তার জন্য বরাদ্দ ছিল) আপনি একটু বসুন, গোসলটা সেরে আসি। কাজ সেরে ভেতরে ঢুকেই দেখি, অবিশ্বাস্য কাÐ! আমার সম্পূর্ণ নতুন একটি শার্ট, যা একদিনও আমি ব্যবহার করিনি। তিনি সেটা গায়ে চাপিয়ে, প্যান্টশার্ট ভালভাবে ইন্ক করে বসে আছেন!! মিটি মিটি হাসছেন। বললাম এই শার্টটি দিয়েছে উত্তর আমেরিকা থেকে প্রকাশিত শিকড় পত্রিকার সম্পাদক, সিলেটের সন্তান মোহিত চৌধুরী। কিভেবে গুরু কিছুক্ষণ পর শার্টটি আমার গায়ে নিজেই পরিয়ে দিলেন। এটাই সেই আলোচিত ‘জুব্বাদান পর্ব’। যা বিভিন্ন মিডিয়ায়ও এসেছে। যা কোনো দিনও আমি ভুলবো না। এ বিষয়টি নিয়ে জ্ঞানীগুণী একাধিকজনের মধ্যে আমার কথাও হয়েছে। তাদের উক্তিÑগুরু, যাকে ভালোবাসেন তাকেই জুব্বাদান করেন। এই জুব্বা না পাওয়া দলের বেদনা, এক একটি তীর হয়ে আজ আমার বুকে লাগছে! যারা তাকে সর্বক্ষণ ঘিরে রাখতেন এটা তাদের মধ্যেই বেশি লক্ষ্য করছি।
দুই.
১৯৯৪ সালের এপ্রিলে, আমি দৈনিক ইনকিলাবে চাকরিতে এক সাপ্তাহও হয়নি যোগ দিয়েছি। লাঞ্চের জন্য অফিসের ওপর থেকে নিচে নামতেই, একটি শ্যামলা রঙের মেয়ে, বড় ফুলের তোড়া আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। কিš‘ হঠাৎ দেখি, আমার সামনে কবি আল মাহমুদ ও সেই সময়ের সেরা সাপ্তাহিক পূণির্মার নির্বাহী সম্পাদক কবি আতাহার খান! গুরু মেয়েটির দিকে তাকিয়েই আমাকে বললেন ভালই, বিয়ে করে ফেল। মেয়েটি লজ্জা পেল। কিন্তু গুরুর সেদিনের কথা রক্ষা না করতে পেরে জীবনে আমার আজ বড় আগুন পোহাতে হচ্ছে।
তিন.
রবার্টফ্রস্টের একটি নতুন ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ কিনে, শাহবাগ থেকে পল্টানে কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের অফিসে ঢুকছিলাম, সেই ১৯৯০ দশকের মধ্যবর্তী সময়ে। ওখানে গুরু আলমাহমুদসহ তার কয়েকজন বন্ধু ছায়া ফেলে বসেছিলেন। ফজল ভাই, বইটি দেখেই বললেন, দেখি তো! আমি বললাম, এ বইয়ের কবিতা আগে যে আজ ভাষান্তর করতে পারবে, তারটা এ সংখ্যার শুক্রবার ইনকিলাবে ছাপা হবে। সবাই দামি কলমÑ খাতা নিয়ে যেন মহাসমরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন! কিন্তু আল মাহমুদ মাত্র ১০/১১ মিনিটের মধ্যে ফ্রস্টের ‘গোলাপ পরিবার’ কবিতাটি ২/১ বার পাঠেই চমৎকার বাংলায়ণ করলেন! পরবর্তীতে তার কোনো কাব্যগ্রন্থে এটি জায়গা পেয়েছিল। এই হলো অসম্ভব প্রতিভাবান কবি আমার গুরু। দেখলাম, অন্যেরা তখন একলাইনও অনুবাদ করতে পারেননি!
চার.
মনে পরে, একই সালে নারায়গঞ্জের আড়াই হাজার থানায় তার একটি অনুষ্ঠান ছিল। আমি তাকে পথে বলেছিলাম ড. আশরাফ সিদ্দিকীর স্ত্রী মারা গেছেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি, আশরাফ সিদ্দিকী মারা গেছে বলে আবেগ তাড়িত হয়ে মাইকের সামনে ভেঙ্গে পড়েন। আমি তখন দূরে, বাথরুমে বসে, ঐ বক্তৃতা শোনে দৌঁড়ে ছুটে এসে দেখি, তিনি আশরাফ সিদ্দিকী স্মৃতিচারণ করে চলেছেন। শ্রোতারাও কেউ কেউ তার কান্না শোনে চোখ মুছতে লাগলো। অব¯’া বেগতিক দেখে, আমি তার নিকটে ছুটে যেতেই তার বক্তৃতা শেষ! ওখান থেকে ফেরার পথে আমার পকেট থেকে একটি প্রেস রিলিজ দেখিয়ে বললাম, তিনি না তার স্ত্রী মারা গেছেন। এই প্রেস রিলিজই ইনকিলাবে ছাপার জন্য তার এক আত্মীয় আমাকে দিয়েছেন। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, তার এক কবি বন্ধু গভীর রাতে আমাকে বলেছেন স্যার নাকি মারা গেছেন! এমন মিথ্যা খবর কেউ দেয়! এই হলো আমার গুরু আল মাহমুদ। সামনের দিনগুলোতে গুরুকে নিয়ে স্মৃতির বাক্স পাঠকদের জন্য সুযোগ পেলে আবার খুলে দেবো।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।