Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিতর্কিত ও ঐতিহ্য ভঙ্গের ডাকসু নির্বাচন

| প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও প্রত্যাশিত ডাকসু নির্বাচন প্রায় ৩ দশক পর ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হল। তবে যে প্রত্যাশাকে সামনে রেখে এই নির্বাচনের অপেক্ষা করা হয়েছিল তা’ অধরাই রয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় পরিবেশ না থাকলেও, নির্বাচন সুষ্ঠু স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট আশঙ্কা থাকা সত্তে¡ও ডাকসু নির্বাচনে প্রায় সব ছাত্র সংগঠনের অংশ নিয়েছিল। অবশেষে সেই আশঙ্কাই সত্যে পরিনত হল। জাতীয় নির্বাচনের পর সম্ভবত ডাকসু নির্বাচনই দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার অন্যতম পাদপীঠ হিসেবে পরিগণিত হয়। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষ তথা ভোটারদের আস্থা চরমভাবে নষ্ট হয়েছে। সাম্প্রতিক ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের আংশিক নির্বাচন এবং সারাদেশে চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটারদের অনুপস্থিতি থেকে নির্বাচন ব্যবস্থার উপর জনগনের আস্থার সংকট ধরা পড়ে। আটাশ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ভোটারদের ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা ছিল। আশা করা হচ্ছিল, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্র তার নবযাত্রার সূচনা করবে। ডাকসু ভোটার হিসেবে ৪২ হাজারের অধিক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ডাকসু তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। পুরো দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের দৃষ্টি ছিল এই নির্বাচনের দিকে। সবাইকে আশাহত করে ডাকসুতেও একটি কলঙ্কিত নির্বাচনের মহড়া দেখা গেল। ভোটের দিন সকালে ছাত্রলীগ ছাড়া প্রায় সব ছাত্র সংগঠনের ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে ডাকসুতে যেন বিগত জাতীয় নির্বাচনেরই পুনরাবৃত্তি ঘটল। সাবেক ছাত্র নেতা এবং সিপিবি প্রধান মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের মতে, আইয়ুব খানের আমলেও ডাকসু নির্বাচনে এমন কলঙ্ক হয়নি। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি দাবী করেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুদীর্ঘ আন্দোলন ও ইতিহাস বিজড়িত। সাতচল্লিশের দেশভাগ আন্দোলন, বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তুরের নির্বাচন এবং একাত্তুরের স্বাধীনতাযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ডাকসুর অবিচ্ছেদ্য গৌরবোজ্জ্বল ভ’মিকা রয়েছে। সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায় ৭ দশকের ঐতিহ্য লালিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগও এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অন্যতম অংশীদার। আমাদের বর্তমান জাতীয় রাজনীতিতে যারা অগ্রনী ভ’মিকা রাখছেন তাদের বেশীরভাগের রাজনীতির প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্বের স্ফুরণ সূচিত হয়েছিল ডাকসু ও ছাত্রলীগের হাত ধরে। দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের অনেকেই ডাকসু, রাকসু, চাকসুর নেতৃত্ব থেকে উঠে এসেছেন। আওমীলীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, কমিউনিস্ট পার্টি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, গণফোরাম নেতা সুলতান মনসুরসহ অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা জাতীয় নেতৃত্বে উঠে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও ছাত্র রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে। আমাদের চলমান জাতীয় রাজনীতির ধারায় যে মানহীনতা ও অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে তার মূল কারণ হচ্ছে ডাকসু সহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহাবস্থানমূলক ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়া। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়ে জাতীয় ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। এককালে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে সুখ্যাত সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস ও প্রতিহিংসার রাজনীতি জাতির রাজনৈতিক অগ্রযাত্রাকেই রুদ্ধ করে দেয়। দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে সেই রুদ্ধ দুয়ার খুলে দেয়ার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, নির্বাচনে অনিয়ম-অস্বচ্ছতা ও ভোট জালিয়াতির মধ্য দিয়ে সেই সুযোগ আবারো ব্যাহত করা হল।
জাতীয় নির্বাচন, স্থানীয় নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি, ভোট ডাকাতি থেকে শুরু করে আগের রাতেই বাক্স ভরে রাখার ন্যক্কারজনক নজির থাকলেও ডাকসু নির্বাচনের অতীত ইতিহাসে এমন নির্বাচনের কোনো নজির নেই। ডাকসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও দাবী-দাওয়ার প্লাটফর্ম। এখানকার সবকিছুই আবর্তিত হবে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা মাফিক। কিন্তু গত তিন দশক ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়া এবং সর্বশেষ এগার মার্চে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের মতামতের কোন মূল্য বা প্রতিফলন ঘটেনি। ছাত্রলীগ ছাড়া সব ছাত্র সংগঠন, কোটা আন্দোলন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবী ছিল হলের বাইরে ভোট কেন্দ্র স্থাপনের, তারা ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার সরবরাহ ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের দাবী জানিয়েছিল। কোন অজ্ঞাত কারণে এসব দাবী মানা হয়নি। ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রিত হলগুলোতে দলবাজ শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগের পক্ষে আগেই সিল মেরে রাখার ঘৃন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এমন ডাকসু নির্বাচন কারো কাম্য ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন জাতির আশা-আকাঙ্খা, মনন চর্চা ও উদ্ভাবনী শক্তির প্রাণকেন্দ্র। তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ধারায় জাতীয় রাজনীতির মানোন্নয়ন ও প্রাণ সঞ্চারের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসরণে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ছাত্র রাজনীতি, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পথে এগুবে এবং এরই পথ ধরে দেশের আগামী জাতীয় নেতৃত্বের নতুন ধারা সূচিত হবে। এমনটাই সকলের প্রত্যাশা। অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষপাত, ব্যর্থতার কারণে বহু প্রত্যাশিত ডাকসু নির্বাচন প্রায় সব ছাত্র সংগঠনের বর্জনের মধ্য দিয়ে কলঙ্কিত ও বিতর্কিত করার দায় সংশ্লিষ্টরা এড়াতে পারেন না। নির্বাচন বর্জন ও ক্লাস বর্জন ও লাগাতার ছাত্র ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছে প্রায় সবগুলো ছাত্র সংগঠন। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ডাকসু

৩ নভেম্বর, ২০২১
১৪ মার্চ, ২০২০
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন