পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নদী হচ্ছে সভ্যতার ভরকেন্দ্র। নদীকে কেন্দ্র করেই শহর গড়ে উঠেছে। সভ্যতাগুলো গড়ে ওঠার পেছনে নদীর অবদান বেশি। দূষণ আর দখলের শিকার বাংলাদেশের প্রায় সব নদী। বিশেষ করে রাজধানী বা বড় শহরগুলোর নদীগুলোর অবস্থা শোচনীয়। আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের ভয়ে সাক্ষ্য দেয় না কেউ। বলা যায়, জনগণের সহায়তা নেই। এ কারণে রূপসা থেকে সুরমা, নাফ-হালদা-পূনর্ভবা, করতোয়া থেকে তিতাস-কর্ণফুলি সবই দূষণ আর দখলের শিকার। রাজধানীকেন্দ্রিক নদীগুলো তো এক একটা বিষফোঁড়া হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-বালু-তুরাগের পানি বিষাক্ত, লালচে কালো হয়ে গেছে। অথচ নদীগুলোকে সম্ভাবনাময় পর্যটনখাতকে বিকশিত করতে পারত। এখনো ব্যবস্থা নিলে পর্যটনখাতকে বিকশিত করার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রেহাই দেবে। এজন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সময়োপযোগী আইন-বিধিমালা প্রণয়ন করে এবং ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করে আমরা এগিয়ে যেতে পারি।
বিবিসির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৪৩৫ টি নদী এখন হুমকির মধ্যে। এর মধ্য ৫০-৮০টি নদী বিপন্ন।এখন এ সংখ্যা অনেক বেশি। তবে আশার কথা, সরকার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। জাতীয় নদী কমিশনের এক জেলা সভায় চেয়ারম্যান/সদস্য মারফত এ তথ্য জেনেছি। সরকার কিছু কাজও শুরু করেছে। আদালত থেকে দূষণ ও দখলের ব্যাপারের নির্দেশনাও রয়েছে। এখন আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
দূষণ আর ভরাটের কারণে বদলে যাচ্ছে নদীর চেহারা। অবৈধ দখল আর অপরিকল্পিত নদীশাসনের ফলে ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে নদী, হারাচ্ছে নাব্যতা। অপরিকল্পিত ড্রেজিং বা একেবারেই ড্রেজিং না করা, আর ইচ্ছেমতো যেখানে-সেখানে বাঁধ নির্মাণের কারণে নদী মৃত্যুর মুখে পড়ছে। কপোতাক্ষ, ইছামতী, ভৈরব, মুক্তেশ্বরী, বেতনা, নরসুন্দা, ফুলেশ্বরী, ধনু, রূপসা, ডাকি, শিবসাসহ আরও কতো নদ-নদী পরিণত হয়েছে সরু খালে! এমনকি অপরিকল্পিত রাস্তা ও কালভার্ট নির্মাণের কারণেও নদী ভরাট হয়। মূলত দীর্ঘ সময় অবহেলা করার কারণেই এ দেশে নদীমৃত্যুর হার বাড়ছে। কোনো-কোনোটির আ¯হা এত খারাপ যে, চেষ্টা করেও নাব্যতা ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না।
নদী এই দেশে জালের মতো ছড়ানো, এই নদীকে কেন্দ্র করেই মানুষের জীবনযাপন ও যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা, প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁওসহ সকল শহর-নগর। যাতায়াত মানেই ছিল নদীপথে যাতায়াত। সওদাগরী নৌকা পাল তুলে ছুটে যেতো দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এখন নদীপথে পণ্য যাতায়াত কমে গেছে। নাব্যতার কারণে এ দুরবস্থা। কিন্তু নৌপথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারলে রাজধানীসহ বেশ কিছু শহরের যানজট কমে যেত। এতে সময় ও অর্থের অপচয় কমে যেত। বাংলাদেশে এখনো শিল্প কারখানা স্থাপনেও গুরুত্ব দেওয়া হয় নদীপথের যোগাযোগকে। মালামাল পরিবহণে নদীকে ব্যবহার করা গেলে খরচ কম পড়ে। ছোট বড় মিলেয়ে প্রায় সাতশ নদী জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশে। বাংলাদেশ নদী প্রধান দেশ। নদীর সাথে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল। কিন্তু নদীগুলোর বির্যয়ে আমরা সংকটাপন্ন। এর জন্য দায়ী আমরাই। এখনই সজাগ হতে হবে আমাদের। হাতে নিতে হবে মহাপরিকল্পনা, প্রণয়ন করতে হবে আইন ও বিধি। সেগুলো বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করতে হবে সাধ্যমত।
ঢাকা ঘিরে থাকা চার নদী শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা প্রায় একই দশায় পড়েছে। এগুলোতে পানির চেয়ে বর্জ্যই বেশি। মাত্রাতিরিক্ত দূষণে এ নদীগুলোর পানি ও রং হারিয়ে ফেলেছে। বর্জ্যের মিশ্রণে নদীগুলোর পানি কালো, নীল বা লাল হয়ে গেছে। এ চার নদীকে সরকার ‘প্রতিবেশ সংকটাপন্ন’ ঘোষণা করেছে। আর বিশ্বব্যাংক বুড়িগঙ্গাকে অভিহিত করেছে ‘মরা নদী’ নামে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলো এতটাই দূষিত যে, এসব নদীর পানি এখন শোধনেরও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নদীগুলোতে এক সময় প্রচুর মাছ ছিল। অথচ এখন শুধু মাছ নয়, কোনো জলজ প্রাণিই টিকে থাকতে পারছে না। বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত ঢাকা শহরের পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকার কারণে প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ ঘনমিটারেরও বেশি পয়োঃবর্জ্যরে প্রায় সবটাই উন্মুক্ত খাল, নদী, নর্দমা বেয়ে অপরিশোধিত অবস্থায় বুড়িগঙ্গায় এসে পড়ছে। টঙ্গী, বাড্ডা প্রভৃতি অঞ্চলের বর্জ্য চলে যাচ্ছে বালু ও তুরাগে। বর্জ্য শোধণাগার নির্মাণ করতে হবে আরও। শুধু সায়েদাবাদেরটাতে কাজ হবে না।
অল্পকথায় আমাদের দেশের নদীগুলোর অবস্থান তুলে ধরা যায় এভাবে। বৃহত্তর দিনাজপুরে নদীগুলো ভারত থেকে পানি নামার খাল মনে হয়, মরে গেছে পঞ্চগড় দিনাজপুর ঠাকুরগাঁওয়ের ৩৬ নদী ও সীমান্ত পাগলাও,খরস্রোতা নদী বড়াল এখন গবাদিপশুর চারণ ভ‚মি, মাথাভাংগা নদী এখন মরা খাল,দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩০ নদী পানি শূন্য: দরিদ্র হচ্ছে জেলেরা,মেঘনা ও গোমতির মোহনায় গড়ে উঠছে গ্রাম,যমুনার শাখা নদী এখন সংকীর্ণ খাল,নিঃস্বপ্রাণ শংখ নদী,উৎস মুখে ভারতের বাঁধ মরে গেছে ভৈরব নদ। বাপার তথ্য অনুযায়ী, হুমকি মুখে থাকা বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্যে আছে, উত্তরাঞ্চলে ৬৭ টি,দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ১২ টি এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৩২টি যেগুলো খুব দ্রুত বিলীন হচ্ছে।
নগর সভ্যতায় নদীর সর্বনাশ। দূষণে আক্রান্ত নদী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নানা দেশীয় প্রজাতির মাছের। গবেষকরা জানিয়েছেন, অনেক দেশীয় প্রজাতিগুলোর মাছ লুপ্ত হওয়ার পথে। পরিস্থিতি যা তাতে কয়েক বছর পর ছোট পুঁটি, মৌরলা, খলসে, চ্যালা, প্যাঁকাল, খয়রার মতো বেশ কিছু মাছে রসনা তৃপ্তির আশা ছাড়তে হবে। শোল, ভেটকি, বোয়াল, এমনকি ইলিশও বিপন্নের তালিকায় যাবে। নদী দূষণের জন্য শিল্প-কারখানার বর্জ্য পানিতে মেশাকে যেমন কারণ বলা হয়েছে, তেমনই রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহারে চাষবাসকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। শহরের আবর্জনা ফেলাও কারণ। এতে নষ্ট হচ্ছে নদীর জীববৈচিত্র্য। অনুক‚ল পরিবেশ না পেয়ে প্রজননক্ষমতা হারাচ্ছে অনেক প্রজাতির মাছ। আর নদীর সাধারণ চরিত্র হারাচ্ছে দূষণের ফলে। এ বিষয়ে প্রচার প্রচারণা কম। সরকার ঘোষিত দিনে কিছুটা প্রচারপ্রচারণা হয়।
সুষ্ঠু পরিকল্পনা করলে বা নদীখেকোদের হাত থেকে নদী রক্ষা করে বা শিল্পকারখানা থেকে বর্জ্যের মাধ্যমে পানি দূষণ থেকে রক্ষা করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হবে। নৌপথে পরিবহন তুলনামূলক খরচ অনেক কম। নদীগুলো খনন করে পানির ধারা বজায় রেখে যোগাযোগ রক্ষা করা যেতে পারে। এতে সড়কপথের চাপ কমবে, অপচয় কম হবে এবং যানজট কমে যাবে। ব্যাপক কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে। নদীকেন্দ্রিক অনেক মৃতপ্রায় শহর জেগে উঠবে আর অনেক নতুন শহর গড়ে উঠবে।
পাহাড়িনদীতে স্ক্যাভেটর মেশিনে অপরিকল্পিতভাবে যথেচ্ছ পাথর উত্তোলনের কারণে জাফলংয়ের পিয়াইন, ডাউকি এবং ভোলাগঞ্জের ধলাই নদী, তামাক চাষের কারণে চকোরিয়ার মাতামুহুরী নদী, ভারতের মেঘালয়ে কালাপাহাড় কেটে কয়লা উত্তোলনের কারণে কয়লার ময়লা ও নুড়ি-পাথরের মিশ্রিত পানির ঢলের কারণে সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদী বিপর্যয়ের মধ্যে। ঢাকার চারপাশের চারটি নদী বাঁচাতে ২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্ট ১২ দফা নির্দেশনা দেন। এর মধ্যে ছিল নদীর সীমানা নির্ধারণ করে সীমানায় পাকা খুঁটি বসানো, তীরে হাঁটার পথ নির্মাণ ও বনায়ন করা, খনন করা, তীরের জমি জরিপ করা, যমুনার সঙ্গে ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের পানিপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য নিয়মিত খননকাজ পরিচালনা করা প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। আজ নদী দখল হচ্ছে, কাল হাইকোর্ট থেকে একটি আদেশ দেওয়া হচ্ছে। এর কয়েক দিন নিরিবিলি থাকার পর আবার দখল-দুষণ শুরু হয়ে যায়। এই কানামাছি খেলাটা বন্ধ হওয়া উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার চার নদীর দূষণের জন্য প্রধানত দায়ী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠান ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) ছাড়াই মালিকরা চালাচ্ছে। ফলে তার দূষিত তরল বর্জ্য সরাসরি পড়ছে নদীতে।
নদী বাঁচালে বেশ কয়েকটা সম্ভাবনাময় সেক্টর জেগে উঠবে। যোগাযোগ,পর্যটন,কৃষি,মৎস্য তো সরাসরি উপকৃত হবে। আর পরোক্ষভাবে অনেক সেক্টরের অক্সিজেন সরবরাহ হবে। জেলেসহ কয়েকটি সম্প্রদায়ের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আর দীর্ঘমেয়াদি বা স্বল্পমেয়াদি ক্ষুদ্র/মাঝারি কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ তৈরি হবে। চীনে একটা প্রবাদ আছে এরকম-‘নদীকে না দেখলে, নদীও তোমায় দেখবে না। আর, নদী দেখা বন্ধ করলেই... সব শেষ!
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।