চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
দুই
ফলে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর থেকে এ দেশের প্রায় সকল সরকারের ক্ষেত্রেই কম-বেশী দুর্নীতির অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছে। প্রশাসন ব্যবস্থায় প্রশাসনিক দুর্নীতির অভিযোগ কোন নতুন ঘটনা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জরিপে বর্তমানে হতাশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটে ওঠে। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সরকারের প্রতি বছর যে অপচয় হয় তা হচ্ছে ১১,২৫৬ কোটি টাকা। ফলে সকল স্তরে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে এবং উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ চীন ও ভারতের চেয়ে প্রবৃদ্ধি অনেক কমে যাচ্ছে। ২০১১ সালে এউচ তে বিনিয়োগের অবদান মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ। অউই-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর তেরেসাখো বলেন, WEF-এর ২০১৫-১৬ রিপোর্টে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অবকাঠামোর দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে। এর অন্যতম কারণ দুর্নীতি। এ ক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন, তবে এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাষ্ট্রকেই পালন করতে হবে। শাসকদের সামনেও এগুলোকে এমন কোন উদ্দেশ্যে পেশ করো না যার ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে তোমরা অন্যের সম্পদের কিছু অংশ খাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাও।” বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে গোটা বিশ্বকে একটি এষড়নধষ ঠরষষধমব মনে করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে অপেক্ষাকৃত কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলো অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর সংস্পর্শে এসে প্রতিযোগিতামূলক ভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। IMF, World Bank, USA পলিসি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি অনেক ঘএঙ দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছে।
দুর্নীতি দমনে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্ব-কর্তব্য, ভূমিকা ও আইনগত বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথির মোহাম্মদ বলেছিলেন, “ঘুষ যদি টেবিলের উপরে উঠে যায় তা হলে আমার করণীয় কিছুই নেই, আর যদি নিচে থাকে তাহলে এক্ষুণি প্রতিরোধ করা সম্ভব”। বর্তমানে আমাদের জাতীয় জীবনে ঘুষ, দুর্নীতির অবস্থান কোথায় তা সহজেই অনুমেয়। দুর্নীতিমুক্ত পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ধর্মীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ এবং তাকওয়ার (আল্লাহভীতি) ব্যাপক অনুশীলন হওয়া প্রয়োজন; ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণতি ও কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন; রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন, এ ক্ষেত্রে সৎ, যোগ্য ও দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরির জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে সম্পূরক অধ্যায় চালু করা যেতে পারে; সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততার মানদণ্ড রক্ষা করা উচিত; এ বিষয়ে লিখিত অঙ্গিকারনামা ও মৌখিক শপথ নেয়া উচিত যে, তিনি কোন পর্যায়ে নিজেকে দুর্নীতির সাথে জড়াবেন না; রাজনৈতিক পক্ষপাত ও স্বজনপ্রীতি মুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা প্রয়োজন; সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পদমর্যাদা ও দ্রব্যমূল্য সামনে রেখে সম্মানজনক জীবন-জীবিকার উপযোগী বেতনভাতা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য সুইডেন, আর্জেটিনা, পেরু, সিংগাপুরসহ বিভিন্ন দেশে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা জীবন-জীবিকার উপযোগী বলে সেখানে দুর্নীতি অনেক কম; সকল ক্ষেত্রে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন; সৎ, যোগ্য ও দক্ষ প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ অডিট ব্যবস্থা, স্বচ্ছ মনিটরিং পদ্ধতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চতকরণ এবং সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও তথ্য সংরক্ষণ; দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে এবং দুদককে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির ক্ষমতা দিতে হবে; জনপ্রতিনিধিদের ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মানসিকতার উন্নতি করতে হবে, যাতে দুর্নীতির মত ঘৃণ্য কাজকে ঘৃণার চোখেই দেখে এবং দুর্নীতি থেকে বিরত থেকে নিজেদেরকে মডেল হিসাবে উপস্থাপন করতে হবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে; দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র ও প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা। জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রাইভেট চাকরিজীবী ও সাধারণ জনগণকে এ পরিকল্পনার অধীনে নিয়ে আসতে হবে এবং সকলকে আধ্যাতি্মক ও নৈতিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সততা ও নৈতিকতার আদর্শে উজ্জীবিত করতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রণীত কর্মসূচির সাথে আলেম-ওলামা, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং মসজিদের ইমাম ও খতবীগণকে সম্পৃক্ত করা এবং তাঁদের মাধ্যমে সমন্বিত উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি চালু করা; দুর্নীতি প্রবণতার কারণসমূহ উদঘাটন করে সে আলোকে প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা; সংবাদপত্রের আদর্শিক স্বাধীনতা দিতে হবে; প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে; ইসলামের শাস্তি বিধান (ইসলামী ফৌজদারী আইন) চালু করা; কুরআনে বর্ণিত দুর্নীতি প্রতিরোধের আয়াতসমূহের ব্যাপক প্রচার করা; দুর্নীতির ভয়াবহতা ও পরিণাম সম্বলিত হাদীসের ব্যাপক প্রচার করা; সর্বোপরি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় দুর্নীতি বিরোধী ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে আরো গণসচেতনতা ও জনমত সৃষ্টি করতে হবে।
আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে মানুষ গড়ার কারিগর মুহাম্মদ স. দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত একটি সমাজকে উদ্ধারের নিমিত্তে কী ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তা লক্ষণীয়। সে শিক্ষা ব্যবস্থার সিলেবাস ছিল -আল-কুরআন ও আল-হাদীস। এ শিক্ষা গ্রহণ করে গড়ে উঠেছিলেন আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী রা.-এর মত মানবেতিহাস খ্যাত শাসক ও মনীষী। এ ব্যবস্থা আত্মস্থ করে এমন একদল মানুষ তৈরি হলেন যে, যারা অপরাধের পর বিবেকের কশাঘাতে টিকতে না পেরে নিজেদের অপরাধের বিচার প্রার্থনার জন্য রসূলের বিচারালয়ে হাজির হতেন। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে অভুক্তকে নিজের খাদ্য বিলিয়ে দেয়ার মানসিকতা গড়ে ওঠলো। এতে এমন এক দল চরিত্রবান নেতৃত্ব গড়ে ওঠলো, যারা এক সময় মানুষের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুর জন্য হুমকি ছিল, পরবর্তীতে তাদের পরিচালিত রাষ্ট্রে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রাতে-দিনে সুন্দরী, মূল্যবান সব অলঙ্কার পরিহিতা মহিলা একাকি পথ চলেছে কিন্তু কেউ তাকে জিজ্ঞাসাও করেনি, কেউ তার দিকে চোখ তুলে দৃষ্টিপাতও করেনি। প্রত্যেকটি মানুষ পরস্পরের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর বিশ্বস্ত আমানতদার বনে গেল। আল-কুরআন এমন সোনার মানুষ তৈরি করল যে, অর্ধেকটা পৃথিবীর বাদশাহী হাতের মুঠোয় পেয়েও দায়িত্বের ভার তাকে এমনভাবে তাড়া করে ফিরতো যে, আরামের ঘুম দূরে ঠেলে দিয়ে রাতের আঁধারে বেরিয়ে পড়লো অভুক্ত মানুষের সন্ধানে। কোথাও কি অসহায় মানবতা জুলুমের শিকার হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করছে? কেউ কি তাঁর শাসন কাজে অসন্তুষ্ট? এ সমস্ত প্রশ্ন তাকে সদা অস্থির করে তুললো। প্রয়োজন পূরণে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দু’টি কাপড় নয় বরং অন্যান্য নাগরিকদের ন্যায় একটিই গ্রহণ করলো। কিন্তু এক টুকরা কাপড় দিয়ে তার জামা হওয়ার কথা নয়; ছেলের ভাগের কাপড় দিয়ে নিজের জামা তৈরি করে নিল। সুতরাং দুর্নীতির সব ব্যবস্থা উন্মুক্ত রেখে দুর্নীতি দমন অসম্ভব। এ জন্য রসূলের স. পন্থায় আলোকিত মানুষ তৈরির জন্য আমাদের সেই কুরআন-যা আজো অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে, সেটিকে আমাদের সকল কাজে মূলনীতি রূপে গ্রহণ করতে হবে। রসূলুল্লাহ স. বিদায় হজ্জ অনুষ্ঠানে অমূল্য বাণী শুনিয়েছিলেন যে, ‘‘তোমরা সবাই একে অপরের ভাই এবং একজন অনারবও আরববাসী থেকে অধিক মর্যাদাশীল নয়।’’ এভাবে হজ্জ ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে এবং সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায়নীতির ভাবধারা চালু হয়। ইসলামের এই টুলসগুলো আইনের আওতায় এনে বাস্তবায়ন করা হলে সমাজব্যবস্থায় দুর্নীতি থাকবে না। যেই মহান রব মানুষকে সৃষ্টি করে মানুষেরই চির শত্রু শয়তানের অভয়ারণ্যে ছেড়ে দিলেন, শয়তানের সাথে যুদ্ধ করে নৈতিকতার সাথে টিকে থাকার জন্য সেই মহান রব উল্লেখিত বিধানগুলো আমাদের দিয়েছেন। এছাড়াও আল-কুরআন ও আল-হাদীস ক্রমাগতভাবে একটি সুন্দর সমাজ তথা রাষ্ট্র কায়েম করার উপড় অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। এমন কি মানুষের কষ্ট হয় এমন একটি ছোট ব্যাপারও ইসলাম বাদ দেয়নি। আবু মূসা রা. বলেন, ‘‘সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! কোন মুসলিমের ইসলাম সবচেয়ে ভাল? তিনি বলেন, ঐ মুসলিমের ইসলাম সবচেয়ে ভাল যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে।’’ ইসলাম এক সর্বজনীন ও কল্যাণকামী জীবনব্যবস্থা। আজ থেকে পরেনো শত বৎসর আগে রসূলুল্লাহ স. এর হাতে গড়া রাষ্ট্রটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায়, তিনি আল্লাহর দেয়া ঐ কর্মসূচিগুলোর মাধ্যমে এমন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যে সমাজের অধিবাসীরা কতটুকু আল্লাহর ভয় পোষণ করার ফলে সাধারণ কোন অপরাধ করার পর পরই বিবেকের ক্রমাগত কশাঘাতে টিকতে না পেরে সাথে সাথে রসুলুল্লাহ স.-এর বিচারালয়ে নিজের দুর্নীতির বিচার প্রার্থনা করতেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।