শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
ভোর হলো। বেলা গড়িয়ে গেল। অতঃপর আলো হারালো আগামী দিনের জন্য। অনেকদিন হলো, প্রভাতের আলো দেখা যাচ্ছে না। প্রকৃতিতেও কেমন যেন বিষন্নতার আবরণ। আবৃত করে রেখেছে প্রতিটি হৃদয়। পরদিন সকাল হলো। হয়তো আলোর দেখা মিলবে। ধূসরবর্ণ আকাশ। বাতাসের প্রাণে শোকের মাতম। চাপা একটা যন্ত্রণার ব্যথা উপচে পড়ছে সবার হৃদয়ে।
একজন মুসল্লি নামায পড়ে বের হচ্ছেন। মুখভর্তি দাড়ি। গায়ে সফেদ জামা। বেশ-ভ‚ষায় উজ্জ্বল-ঝলমলে। কিন্তু তাঁর চোখে-মুখে ছড়িয়ে আছে আবছা বেদনা। মসজিদ থেকে বের হয়ে লালবাগ মোড়ের দিকে রওয়ানা হলেন লোকটি।
রাস্তার পাশে একটি কুকুর। খিদের যন্ত্রণায় ছটফট করছে। পাশেই একটি দোকান। একটুকরো রুটি পড়ে ছিল তার সামনে। তাই নিয়ে লাফালাফি করছে কুকুরটা।
চার-পাঁচটি ছাগল নিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একজন ছেলে। তার মধ্যে একটি বাচ্চা ছাগলও ছিল। একবার ছেলেটির পাশে যায় একবার মায়ের কাছে। চঞ্চল প্রকৃতির। ছেলেটিও বেশ আনন্দের সাথে ছাগলগুলি নিয়ে চলছে। চলতে চলতে একসময় মোড়ে এসে থেমে যায়।
প্রভাতে আলোর মিছিল। মিষ্টি ভোরের স্নিগ্ধ সকাল। ধীরে ধীরে মানুষের আনাগোনা বাড়ে। দেখতে দেখতে শহরের রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। হঠাৎ জনতার উচ্চকিত কণ্ঠে কেঁপে ওঠে আকাশ-বাতাস। মুহূর্তেই বিদ্রোহী হয়ে উঠল লালবাগ মোড়ের চিত্র। কুকুর খাবার ফেলে দিশাহারা হয়ে ছুটল, ভয়ে ছাগলগুলোর দলছুট অবস্থা। এদিকে মুসল্লি হয়ে উঠলেন বিদ্রোহীদের একজন। ভরাট কণ্ঠে আওয়াজ তুললেন, ‘জুলুমবাজী শেষ কর, রাষ্ট্রভাষা বাংলা কর’।
মজিদ ও সুজন খুব ভাল বন্ধু। একই কলেজের ছাত্র। গরীব ঘরের ছেলে মজিদ। বহু কষ্টে লেখাপড়ার সুযোগ হয়েছে। দেশের প্রতি তাদের গভীর ভালবাসা। দু’জনের স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে দেশের সেবায় নিয়োজিত হবে। এ জন্যই তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে।
সুজন বাংলাভাষার প্রতি অনুরাগী একজন ছেলে। কবিতা ও সাহিত্যচর্চা করে সবসময়। তার প্রতিভা মজিদকে খুব অনুপ্ররণা জোগায়। কারণ তার বাবাও একই চেতনাবোধের। বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে বাংলা চর্চায় সুজনের খ্যাতি রয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় সে লেখালেখি করে।
আমি যদি শিক্ষার আলোর প্রসারিত করি তাহলে জাতি তুলনামূলক বেশি শিক্ষিত হবে। হ্যাঁ, যদি দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে কিংবা মায়ের ভাষা নিয়ে কেউ টানাটানি করে, তাহলে ছাড়বো না। দেশের ভালবাসা থেকেই বুকের রক্ত দিয়ে দেশ-জাতি রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ব।
মজিদ মায়ের একমাত্র ছেলে। ভার্সিটিতে যখন পা রাখছিল তখন বাবা মারা যান। বাবা হারানো যেমন কষ্টের ছিল তেমন মর্মান্তিক বেদনারও। বাবা ছিলেন প্রচন্ড দেশপ্রমিক। তিনি কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন। মজিদের বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন এ দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।
মজিদের বাড়ি রংপুর। ছ’মাস-বছরে গিয়ে দেখা করে আসে। কিছুদিন আগেও দেখা করে এসেছিল। মা আর খালাতো বোন রুনা মিলে তাদের জীর্ণ-শীর্ণ সংসার। রুনার মা-বাবা শিশুকালেই মারা গিয়েছিল। মা-ছেলের উপরেই তার সব আশা-ভরসা আর স্বপ্ন।
ক্যাম্পাসে ফেরার সময় মজিদের মা বলেছিলেনন, ‹সাবধানে চলাফেরা করিস বাবা! ঢাকা শহরের অবস্থা নাকি খুব খারাপ।›
সে মাকে শান্তনা দিয়ে বলে, তোমার ছেলের কিচ্ছু হবে না। যেমন যাচ্ছে, দেখবে এরচে›ও ভালভাবে ফিরে আসবে।
ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ। সন্ধা থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। তখনও কেউ বুঝতে পারেনি পরদিন ২১ তারিখে কী ঘটতে যাচ্ছে! সুজন কলেজের ছাত্রনেতা। তাদের কলেজের ফজলুল হক হল, ঢাকা হল এবং সলিমুল্লাহ খান হলের ছাত্ররা মিটিং করে জানিয়ে দিয়েছে যে, ভাষাপ্রেমীরা আন্দোলন থেকে পিছপা হতে রাজী নয়। সরকার চোখ রাঙিয়ে, রক্তচক্ষুর ভয় দেখিয়ে কিংবা আরো যা কিছু ইচ্ছা করেও আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। ছাত্রনেতাদের এ সিদ্ধান্ত গোটা আন্দোলনের চেহারাই পাল্টে দেয়।
সুজন রুমে আসে। উত্তেজনায় থরথর কাঁপছে। ছটপট করছে। মাজিদ তার কান্ড দেখে তাকিয়ে থাকে।
কি হয়েছে রে দোস্ত! বাহিরের অবস্থা কী এখন?
সুজন- ওরা নাকি বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবে। আমি-আমরা যে ভাষায় মনের কথা বলি ও লিখি, সে ভাষার উপরে উর্দুভাষা চাপিয়ে দিতে চায়। রাগে তো আমার রক্ত জ্বলে যাচ্ছে!
তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু মজিদ। সুজন অনেকটা রাগ-অভিমান মাখিয়ে বলে, তুই পড়ালেখা করে আখের গোছাতে থাক। পরে দেখবি ভাষাও যাবে, শিক্ষাও যাবে। আর শিক্ষিতরা হবে পাকিস্তানিদের কলুর বলদ। আমি এভাবে বসে থাকতে পারবো না। যদি সঙ্গ দিতে ইচ্ছে হয়, তাহলে চল।
মজিদ এই প্রথম সুজনকে ক্ষিপ্ত হতে দেখেছে। সে এভাবে আর বসে থাকতে পারে না। তার মনেও মাতৃভাষা ফিরিয়ে আনার স্পৃহা জাগে। সেও সোনালী একটা আলো দেখতে চায়। সুজনের হাতে হাত রেখে শপথ নেয় মজিদ। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ওঠায় ঊর্ধ্বমুখে।
চারদিকে হরতালের স্লোগান। মিছিলের পর মিছিল। উত্তর দিকের গলি দিয়ে ঢুকে পশ্চিমের গলি দিয়ে বেরুচ্ছে। সবার হাতে ছোট বড় প্ল্যাকার্ড। লাল বর্ণে তাতে লেখা- ‘রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই’।
বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা স্লোগান- পুলিশের অত্যাচার, মানি না মানব না! ‘পাক পুলিশ নিপাত যাক, বাংলাভাষা জিন্দাবাদ’।
আমতলায় ছাত্রদের মুষ্টিবদ্ধ অনেকগুলো হাত উঠলো। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার আহ্বানে বক্তৃতা দিচ্ছে সুজন। জড়ো হয়েছে বিভিন্ন কলেজে-ভার্সিটির ছাত্ররা। সুজনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মজিদ। সময় যত যাচ্ছে লোকজনের ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। মিছিলের স্লোগান তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে।
‘পাকিস্তানের অত্যাচার মানি না মানবো না’,
‘আমাদের সব দাবি, মানতে হবে মেনে নাও’,
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা, করতে হবে করে দাও’
সরকার থেকে নির্দেশ আসে। মিছিল-মিটিংগুলো লন্ডভন্ড করার জন্য। পুলিশ টিয়ারসেল ছুঁড়ে দেয় মঞ্চের দিকে। বিক্ষিপ্তভাবে ছুটোছুটি করতে শুরু করে ছাত্ররা। কাদানে গ্যাসের আক্রমণ, অসহ্য যন্ত্রণা সবার চোখে মুখে। রাস্তায় তুমুলভাবে জনতার উত্তেজনতা বেড়ে গেছে। ছাত্রদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে লালবাগের কেল্লার ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে মিছিলে গুলি খেয়ে রাস্তায় লাশ হয়ে পড়ে থাকে অনেকে।
সুজন মজিদকে বুকে টেনে নেয়। উত্তপ্ত রাজপথ থেকে আড়াল করতে গিয়ে সহসাই বুকে বুলেট বিদ্ধ হয় মজিদের। পুলিশ মিছিলকে লক্ষ করে এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছে। আরেকটি গুলি এসে বিদ্ধ হল সুজনের বুকে। সবকিছু আচানক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত সুজন মজিদের দিকে তাকায়। দু’হাত বাড়াতে চায়, পারে না। তাকে বাঁচাতে চায়, পারে না। শেষ পর্যন্ত সে নিজেও বাঁচতে পারে না হায়েনার কবল থেকে। যাবার আগে হাতের রক্তাক্ত আঙুলে লিখে যায়, ‘রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই’।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।