পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভেনিজুয়েলার রাজনৈতিক সংকটকে ঘিরে ল্যাটিন আমেরিকায় বড় ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের আভাস নাকি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেজিমনিক ডমিনেন্স নতুন মাত্রা লাভ করতে চলেছে তা এখন বিশ্বরাজনীতির অন্যতম আলোচ্য বিষয়। এটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ভেনিজুয়েলা ক্রাইসিসকে যথাযথ রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় মোকাবেলা করে নিজেদের পক্ষে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভেনিজুয়েলা পরিস্থিতি এখন সোভিয়েত আমলের ঠান্ডা লড়াইয়ের নতুন সংস্করণ হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে। সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভেনিজুয়েলার তেল বিক্রির অর্থ স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ও পশ্চিমা সমর্থিত আন্দোলনের নেতা হুয়ান গুয়াইদোকে দেয়ার ঘোষণা দেয়ার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো ভেনিজুয়েলার বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তথা তেল রফতানীর অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বদলে রাশিয়ার গ্যাজপ্রমএও ব্যাংকে স্থানান্তরের ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি ভেনিজুয়েলায় মার্কিন মানবিক সহায়তা প্রবেশের বিরুদ্ধেও কঠোর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে মাদুরো। মার্কিনীদের তথাকথিত মানবিক সহায়তা কে উপহাস এবং ধ্বংসের বিষ বলে আখ্যায়িত করে মাদুরো বলেছেন, এর আগে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন ধ্বংস হয়েছে। মার্কিন ত্রাণ সহায়তা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাংক হিসাব স্থানান্তরে মাদুরোর এই পাল্টা ঘোষনা কার্যকর হলে এটি হবে দুর্বল ও বিপর্যস্ত ভেনিজুয়েলার হাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর অনেক বড় চপেটাঘাত। মাদুরোর রিজিম চেঞ্জ, জুয়ান গুয়াদোর ক্ষমতা গ্রহণের ঘোষণার প্রেক্ষাপটে ভেনিজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সঙ্কটকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের অবস্থান এবং মাদুরোর প্রতি রাশিয়া ও চীনের সমর্থন বিশ্বব্যবস্থায় আবারো সোভিয়েত আমলের কোল্ড ওয়ারের নীরব উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এই উত্তেজনায় এখনো কোনো তৃতীয় পক্ষ বা মধ্যস্থতাকারীর ভ’মিকায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। পরস্পর বিরোধী দুই পক্ষ পরিস্থিতিকে ক্রমবর্ধমান হারে উত্তপ্ত করে তোলছে। গত বছরের মে মাসে অনুষ্ঠিত ভেনিজুয়েলার সাধারণ নির্বাচনে সে দেশের বিরোধীদল বয়কট করলেও নির্বাচন কমিশন স্বাভাবিক নিয়মে ভোটের ফলাফল ঘোষণার মধ্য দিয়ে নিকোলাস মাদুরো দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ লাভ করে। এই নির্বাচনকে অনেকটা বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাথে তুলনা করা যায়। বিরোধীদলের বয়কট সত্তে¡ও সাংবিধানিক বৈধতা ও বাধ্যবাধকতার কারণে দ্বিতীয় মেয়াদে আরো ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার লেজিটিমেসি প্রাপ্ত হন শেখ হাসিনা। একইভাবে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক ভোট কারচুপি, নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের যোগসাজশ ও সমন্বয়ে আগেই ব্যালটে সিল মারার যে সব অভিযোগ উঠেছে নানাভাবে তা’ অনেকটাই এখন অথেনটিক হয়ে গেছে। এমনকি মহাজোটের অন্যতম শরিকদল জাসদের নেতা, বিগত সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আগেই ব্যালটে সিল মারা হয়েছিল। ভেনিজুয়েলার নির্বাচনটি ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে ৭ মাস আগেই অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের আগে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের কারণে তারা নির্বাচন বয়কট করে। একই ঘটনা আরো ব্যাপকভাবে ঘটলেও বাংলাদেশে বিরোধীদলগুলো নির্বাচন বয়কট করেনি। তবে দুর্বল ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্বেও জুয়ান গুয়াইদোর মত কোনো নেতা বা কোনো পরাশক্তির দৃশ্যমান সমর্থন না থাকায় এসব অভিযোগ কাজে লাগাতে পারেনি বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে বাংলাদেশেও ভেনিজুয়েলার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে ইতিমধ্যে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিতর্কিত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয় মেয়াদের জন্য সরকার গঠনের পর গণভবনে আবারো বিরোধীদলের সাথে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনের অনিয়ম এবং নতুন নির্বাচনের দাবী নিয়ে আলোচনার কোনো এজেন্ডা বা প্রতিশ্রুতি না থাকায় বিএনপি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল গণভনে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি।
ভেনিজুয়েলার নির্বাচন এবং চলমান রাজনৈতিক সংকটকে দেশটির আভ্যন্তরীণ বিষয হিসেবে উল্লেখ করে এ সংকটের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের উপর গুরুত্ব দিয়ে গত সপ্তাহে রাশিয়ার পক্ষ থেকে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছিল রাশিয়া। এই প্রস্তাবের পাল্টা হিসেবে গত শনিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে ভেনিজুয়েলায় আন্তজার্তিক ত্রাণ সরবরাহ শুরু এবং নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানানো হয়েছে জাতিসংঘে ভেনিজুয়েলায় নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতি তাঁর ইতিবাচক প্রভাব বা কর্তৃত্ব খাটানোর আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পাল্টা প্রস্তাব ঠেকাতে রাশিয়া জাতিসংঘ অধিবেষতণে তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে বলে ক’টনৈতিক সুত্র থেকে জানা যায়। রাশিয়া ভেনিজুয়েলার আঞ্চলিক অখন্ডতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের হুমকিতে রাশিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভেনিজুয়েলার রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত হলেও গণতান্ত্রিক পন্থায় গঠিত জাতীয় পরিষদের নেতা জুয়ান গুয়াইদো নিজেকে দেশের বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দাবী করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের প্রায় ৫০ টি দেশ গুয়াইদোর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে বলে জানা যায়। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, রাশিয়া, চীনসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সমর্থন এখনো নিকোলাস মাদুরোর প্রতি। এই সংকট ও সাংঘর্ষিক অবস্থানের মধ্য দিয়ে ভেনিজুয়েলায় সমাজতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে মার্কিনীদের দীর্ঘদিনের লক্ষ্য অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। মূলত: ভেনিজুয়েলার কট্টর মার্কিন বিরোধী প্রেসিডেন্ট উগো শ্যাবেজের আমল থেকেই ভেনিজুয়েলা মার্কিনীদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক টার্গেটে পরিনত হয়েছিল। মার্কিনীদের সব ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতা মোকাবেলা করে প্রায় ১৪ বছর ভেনিজুয়েলা শাসন করেন শ্যাভেজ। ২০১৩ সালে শ্যাভেজের মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য অনুসারী নিকোলাস মাদুরো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই সেখানে অর্থনৈতিক সংকট ক্রমে ঘনীভ’ত হতে থাকে। ধারণা করা যায়, ল্যাটিন আমেরিকার দেশ হিসেবে ভেনিজুয়েলার রাজনৈতিক সংকট, খাদ্যাভাব, বিদ্যুত, ওষুধপত্রসহ নানামুখী সংকটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। নজির বিহীন মূল্যস্ফীতি বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ তেদন কোনো কাজে আসেনি। যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষাবস্থার মত লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছে। জানুয়ারী পর্যন্ত প্রায় ৩০ লাখ ভেনিজুয়েলান বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। কোটি কোটি মানুষকে দু:সহ জীবনযাত্রার মধ্যে ঠেলে দিয়ে সেখানে একটি সরকার বিরোধী গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে রিজিম চ্যাঞ্জের সুযোগ তৈরী করাই হয়তো এই মুহুর্তে ভেনিজুয়েলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিষ্ঠ। অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের পাশাপাশি ব্যাপক আন্তর্জাতিক ত্রান সহায়তা এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনা ভেনিজুয়েলার নাগরিকদের বিভক্ত করে ফেলেছে। একদিকে দেশপ্রেমিক সমাজতান্ত্রিক চেতনা অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা মদদপুষ্ট গুয়াইদোর মত ক্রীড়নক ব্যক্তিত্বের তুখোড় বিরোধে পুরো জাতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। এমন দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে পদানত করে নিজেদের পুতুল সরকার কায়েম করা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদিদের জন্য খুব কঠিন নয়। তবে এ ক্ষেত্রে বিশ্বশক্তিগুলো নিজ নিজ স্বার্থ ও সমর্থনে অটুট থাকলে এমন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান অসম্ভব হতে পারে। সিরিয়া ও আফগানিস্তানে মার্কিনীরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল ভেনিজুয়েলায় তা আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। ভেনিজুয়েলায় সরাসরি মার্কিন হস্তক্ষেপের আশঙ্কা সামনে রেখে প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো সেখানে মার্কিনীদের জন্য ভিয়েতনামের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার হুঁশিয়ারী দিয়েছেন।
ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, মেক্সিকো বা কিউবার মত প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কখনোই সম্প্রীতিপূর্ণ ছিলনা। এর পেছনে রয়েছে এ অঞ্চলের জনগণের সাধারণ প্রত্যাশা, ঐতিহ্য ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাথে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ধারণার একটি ঐতিহাসিক দ্ব›দ্ব। স্পেনিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে ল্যাটিন আমেরিকার জনগনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রত্যাশা জেগে উঠেছিল তার কেন্দ্রে অবস্থান করছে ল্যাটিন আমেরিকার অবিসম্বাদিত নেতা, স্বাধীনতা ও মুক্তির মহানায়ক সাইমন বলিভারের বীরত্ব গাঁথা। ল্যাটিন আমেরিকার রাজনৈতিক বলয়ের সে অবদমিত স্বপ্নের বীজ মাঝে মধ্যেই সেখানকার শিল্প সাহিত্য ও আন্দোলন সংগ্রামে ফুটে উঠতে দেখা যায়। উনবিংশ শতকে স্পেনিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নিগড় থেকে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোকে মুক্ত করতে ভেনিজুয়েলার সেনানায়ক সাইমন বলিভারের যুদ্ধজয়ের কাহিনী সেখানকার রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে অবিষ্মরণীয় অবিষ্মরীয় হয়ে আছে। সাইমন বলিভারের নেতৃত্বে ১৮১০ সাল থেকে ১৮২২ সালের মধ্যে তার সেনাবাহিনী একের পর এক ভেনিজুয়েলা, কলাম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু, পানামাও বলিভিয়া ঔপনিবেশিক স্পেনিশদের কব্জা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সাইমন বলিভারের নামানুসারে বলিভিয়ার নামকরণ করা হয়। তিনি একই সাথে ভেনিজুয়েলা,কলাম্বিয়া,পেরু ও পানামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার অধীনস্থ সেনাকমান্ডার জোসে দ্য সুক্রে কে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি বলিভার সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ দক্ষিন আমেরিকার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ল্যাটিন আমেরিকার স্বাপ্নিক পুরুষদের সে স্বপ্ন কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। পশ্চিমা এক গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কলম্বিয়ার নোবেল বিজয়ী লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বলেছিলেন, সাইমন বলিভারের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমি এখনো জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত আছি। ল্যাটিন আমেরিকার সামরিক বাহিনীর কমান্ডাররা সাইমন বলিভারের বীরত্ব গাঁথা ও স্বপ্নকে আদর্শ হিসেবে বুকে ধারণ করেন। সেনা কমান্ডার হুগো শ্যাভেজ ১৯৯৮ সালে ভেনিজুয়েলার শাসনতন্ত্রে যে সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তন সূচিত করেন তা বলিভারিয়ান রেভ্যুলেশন হিসেবেই পরিচিত। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে, পশ্চিমা পুঁজিবাধী শক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকা হুগো শ্যাভেজের পক্ষে সম্ভব হলেও মাদুরোর পক্ষে তা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেনশিয়াল ও স্থানীয় নির্বাচনের বেশীরভাগ আসনে মাদুরোর ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রার্থীরা বিজয়ী হলেও বিরোধীদল ডেমোক্রেটিক ইউনিটির নেতৃত্বাধীন জোট পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের মধ্য দিয়ে ভেনিজুয়েলায় সমাজতন্ত্র বিরোধী একটি ভিন্ন রাজনৈতিক মেরুকরণকে এগিয়ে নেয়ার পশ্চিমা নীলনকশা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। হুগো শ্যাভেজের মৃত্যুর পর ২০১৩ সালের নির্বাচনে মাদুরো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ভেনিজুয়েলার উপর একের পর এক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানাবিধ অবরোধ আরোপের মধ্য দিয়ে সেখানকার জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক সংকটকে দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের এ এক চিরচেনা চেহারা। বশ্যতা আদায়ের নানাবিধ কৌশল ব্যর্থ হলে ভীতি প্রদর্শন, শাসকদের জন্য লোভনীয় প্রস্তাবের আড়ালে ষড়যন্ত্র সক্রিয় হয়ে উঠে।
অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ও ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলোর সম্পদ লুণ্ঠনের নতুন কৌশল হিসেবে গর্ভনর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি সাবসিডিয়ারী অ্যালায়েন্স বা অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির ঘোষণা দেন। সামরিক অভিযানের মাধ্যমে রাজ্য দখলে নেয়ার বদলে স্থানীয় রাজাদের সাথে এই মর্মে চুক্তিতে উপনীত হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয় যে, এর ফলে দেশীয় রাজ্যগুলো অভ্যন্তরীণভাবে স্বাধীনতা ভোগ করবে। বিনিময়ে তাদেরকে একদল ইংরেজ সেনাকে ভরন পোষনের দায়িত্ব বা ব্যয়ভার বহন করতে হবে এবং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অনুমোদন ছাড়া অন্যকোন বিদেশী শক্তির সাথে কোনো রকম চুক্তি বা বৈদেশিক লেনদেন করতে পারবে না। বার্ষিক ট্যাক্স অথবা রাজ্যের কোনো একটি অঞ্চলের জমিদারির বিনিময়ে এই চুক্তি কার্যকর করা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল থেকে পশ্চিমা পুঁজিবাদি সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ ও নতুন বিশ্বব্যবস্থায় পরোক্ষভাবে ভিন্ন নামে ও কৌশলে সেই অধীনতামূলক মিত্রতা নীতিরই বাস্তবায়ন দেখা গেছে যা এখনো চলছে। সেখানে গণতন্ত্র, সামরিক-বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্রের মধ্যে কোনো বাছ বিচার দেখা যাচ্ছে না। বিগত শতকের শেষ দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হওয়ার ফলে বিশ্বব্যাপী অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমে যাওয়াই ছিল সঙ্গত। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় নিরাপত্তাহীনতা ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা আরো বেড়ে গেছে। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বজায় রাখতে বিভিন্ন দেশে রিজাইম চেঞ্জ এজেন্ডা, সামরিক হামলা ও দখলবাজির মাধ্যমে ধ্বংস ও লুণ্ঠনের মহোৎসব চালানো হয়েছে, অন্যদিকে আল কায়েদা, আইএস’র মত নতুন নতুন জুজু সৃষ্টি করে প্রক্সি যুদ্ধ ও অস্ত্রবাণিজ্য চাঙ্গা করে তোলা হয়েছে। আফগানিস্তানে ন্যাটোর সামরিক হামলা ও দখলবাজির মধ্য দিয়ে ওয়ার অন টেররিজম শুরু করার প্রায় দেড়যুগ পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনানুষ্ঠানিকভাবে তালেবানদের কাছে তাদের পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের রিজাইম চেঞ্জের স্বপ্ন ও পরিকল্পনাও ভেস্তে গেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য থেকে সেনা প্রত্যাহার ও যুদ্ধ পরিকল্পনা পুর্নমূল্যায়ণের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। পক্ষান্তরে মেক্সিকো ও ভেনিজুয়েলার মত দক্ষিন আমেরিকান প্রতিবেশী দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী মনোযোগ আরো বেশী নিবদ্ধ করতে দেখা যাচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধকালে ষাটের দশকের শুরুতে কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসে মার্কিনীদের চরম হুমকি উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেও ক্ষুদ্র দেশ কিউবা তার মান মযার্দা ও স্বাবভৌমত্ব অক্ষুন্ন রেখেই সবকিছু মোকাবেলা করেছিল। এর পেছনে ছিল কিউবানদের জাতীয় ঐক্য ও ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মত যোগ্য ও সাহসী নেতৃত্ব। একইভাবে পশ্চিমা দুনিয়ার সব শক্তি মোকাবেলা করে ১৯৭৯ সালে ইমাম খামেনির নেতৃত্বে ইরানে গণবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর থেকেই দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের রিজিম চেঞ্জের অন্যতম টার্গেট হয়ে আছে। শুধুমাত্র জনগনের বৃহত্তর ঐক্য এবং সুশৃঙ্খল, ভবিষ্যতমুখী নেতৃত্বের কারণেই ইরানের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামকে কেন্দ্র করে গত দুই দশক ধরে একের পর এক অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা ও যুদ্ধের হুমকির মধ্যেই ইরান নানাক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এ বছর সগৌরবে বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকী পালন করছে ইরান। সাইমন বলিভারের দেশ ভেনিজুয়েলা রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পৌছে গেছে। ভেনিজুয়েলায় চলমান সংকট সেখানকার জনগন, সেনাবাহিনী এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জন্য যেমন অগ্নি পরীক্ষা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পরাশক্তিগুলোর জন্যও এটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজতন্ত্রি মাদুরোকে সরাতে ভেনিজুয়েলায় আরেকটি সিরিয়ার পুনরাবৃত্তি কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার, ক্ষেপনাস্ত্র প্রকল্প ইত্যাদি বিষয়গুলোকে শ্রেফ অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেই দেশে দেশে স্থিতিশীলতা ও অখন্ডতা বিনষ্ট এবং সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ হাসিলের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাধান ও সমঝোতা না হলে পশ্চিমা ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদীরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করবেই। রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক ঐক্য গড়ে তোলা ছাড়া এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কোনো বিকল্প পথ নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।