পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মোটামুটি নিরিবিলিতেই বিশ্ব ক্যানসার দিবস পালিত হয়ে গেল। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের চার তারিখে পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব ক্যানসার দিবস। উদ্দেশ্য মহৎ। ক্যানসার, তার নিবারণ বা প্রতিরোধ এবং এ বিষয়ে সচেতনতার প্রসার ঘটানোই এই দিবস পালনের লক্ষ্য। আমাদের দেশে অবশ্য এ সব অকিঞ্চিৎকর বিষয়ে সময় অপচয় করার লোক কম। বড় শহরগুলোতে, মুখ্যত বেসরকারি হাসপাতালগুলো আর সরকারি কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে কিছু প্রভাতফেরি-জাতীয় অনুষ্ঠান, কিছু ‘সেলিব্রিটির’ ভিড়, টিভিতে খুচরো কিছু ফুটেজ, ব্যস। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে এক বেলার এই আয়োজন। কিন্তু নাগরিকদের সারা বছরের সচেতনতা বৃদ্ধি যাঁদের দায়িত্ব, সেই সরকার কিংবা তাঁর স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় যে ক্যানসার বা তার প্রতিরোধ বিষয়ে আদৌ চিন্তিত, অথবা আগ্রহী, এমন প্রমাণ মেলে না। মাঝে মধ্যে বৈদ্যুতিক প্রচার মাধ্যম বা খবরের কাগজে ধূমপানের বিরুদ্ধে হইচই করা কিছু বিজ্ঞাপন প্রকাশ, তার বাইরে কোনো লাগাতার প্রয়াস নেই। পরিস্থিতি দেখে বোঝা মুশকিল যে, এ দেশে ক্যানসার একটি বড় এবং ক্রমবর্ধমান সমস্যা।
আমেরিকানরা যে কোনো ব্যাপারেই একেবারে যুদ্ধ ঘোষণা না করে থামাতে পারেন না, তাই প্রেসিডেন্ট নিক্সন শুরু করেন ‘ওয়ার অন ক্যানসার’। রোগ প্রতিরোধ নয়, চিকিৎসা করেই ক্যানসারের নিকাশ করতে হবে। আমরাও, এ দেশে, সেভাবে শুরু করলাম। বেশ কিছু হাসপাতালকে রেডিওথেরাপির যন্ত্র কিনে দিয়ে শুরু হলো অভিযান। কিছুদিন যেতে না-যেতেই, মার্কিন দেশে, ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল। ফিসফিসানি চলছিলই আগে থেকেই, কিন্তু আটাত্তর সালে প্রকাশিত হলো ‘দ্যা পলিটিকস অফ ক্যানস্যার’। দেখা গেল, উন্নত চিকিৎসার দ্বারা, আর যাই হোক, দেশ থেকে ক্যানসার নির্মূল করা সম্ভব নয়, এমনকি ক্যানসারজনিত মৃত্যুর হার কমানোও দুষ্কর, ক্যানসারমুক্ত আমেরিকা তো দূরস্থান, আক্রান্তের সংখ্যা কমানোতেও যুদ্ধ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। কিন্তু এর মধ্যে, ‘ওয়ার অন ক্যানসার’ এর সুবাদে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি এবং রেডিওথেরাপি যন্ত্র প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোর ব্যবসার পালে বাতাস লেগেছে। রোগ প্রতিরোধে, আর যাই হোক, তেমন ব্যবসায়িক লাভ নেই। কাজেই যুদ্ধ বজায় রইল। ১৯৮৬ সালে মার্কিন ন্যাশনাল ক্যানসার ইন্সটিটিউট জানায় ২০০০ সালের মধ্যেই, সে দেশে, ক্যানসারে মৃত্যু হার, তাঁরা একেবারে অর্ধেক করে ফেলবে। তাদের বড় কর্তা ভিনসেন্ট ডেভিটা আরও এক কাঠি এগিয়ে বললেন, দু’হাজার সাল, ততদিনে হয়তো ক্যানসার বলে কিছু থাকবেই না, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি এতটাই।
বলা বাহুল্য, এই দুরাশা পূরণ হয়নি। চিকিৎসা উন্নতি করে পৃথিবীর কোনো দেশেই, ক্যানসারে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হয়নি। ক্ষেত্র বিশেষে কোনো এক ধরনের ক্যানসারে মৃত্যুর হারে কিছুটা উন্নতি হলেও বেড়েছে অন্য ক্যানসারে মৃত্যু। আমাদের দেশে তখনও মুক্ত অর্থনীতির সুবাদে বহুজাতিক কর্পোরেটের রমরমা শুরু হয়নি। কাজেই, ১৯৮৫-৮৬ সাল নাগাদ জাতীয় ক্যানসার নীতিতে একটা পরিবর্তন আনা সম্ভবপর হলো। বলা হলো, গুরুত্ব দেওয়া হবে মূলত রোগ প্রতিরোধে, স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ানো এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ে।
গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া আর যথার্থ গুরুত্ব দেওয়া দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিষ। কাজেই, সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়টি রয়ে গেল অনেকটাই খাতায়-কলমে। পাশাপাশি, ক্যানসার প্রতিরোধে সরকারি স্তরে যে সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন ছিল, সেগুলো নেওয়া হলো না। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের দেশে ক্যানসারের হার বা তজ্জনিত মৃত্যুর হার কমানো গেল না। ২০০৫ সাল থেকে শুরু হলো নতুন করে ক্যানসার কেন্দ্র, যেখানে চিকিৎসাই মুখ্য, ক্যানসার নিবারণের ব্যবস্থা নামে মাত্র হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজগুলোতে জোর দেওয়া হলো অঙ্কোলজি উইং তৈরিতে। এখন পর্যন্ত এভাবেই চলছে।
স্ট্যাটেজিং এই পরিবর্তনে কতটা লাভ হয়েছে বলা মুশকিল। জাতীয় স্তরে একটি ক্যানসার রেজিস্ট্রি আছে বটে, কিন্তু তার তথ্য বেশ অসম্পূর্ণ। আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা সংস্থা গ্লোবোক্যানের তথ্য অনুসারে, আমাদের দেশে ক্যানসারের হার বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। তাঁদের আশঙ্কা, দু’হাজার তিরিশ সাল নাগাদ, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাবে ক্যানসারে। পরিবার পিছু ন্যূনতম একজন ক্যানসার আক্রান্ত হবে। সে দুর্দিনের আর বেশি দূরে নয়। কাজেই, ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে আমরা এগোচ্ছি, এমন ভাবার সুযোগ নেই।
ক্যানসারের প্রাথমিক প্রতিরোধ অর্থাৎ, কারণগুলো খুঁজে ক্যানসারের হার কমানো এ ছাড়া সমস্যার সহজ কোনো সমাধান নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করে মৃত্যুর হারে কিছুটা স্থিতিশীলতা হয়তো আনা সম্ভব, কমানো সম্ভব চিকিৎসার ব্যয়ভার ও জটিলতা-বর্তমান পরিস্থিতিতে তার গুরুত্বও কিছু কম নয়। কিন্তু ক্যানসার প্রতিরোধই একমাত্র দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। জাতীয় স্তরে সরকারি উদ্যোগ ছাড়া ক্যানসার প্রতিরোধে সাফল্য বিশ্বের অন্য কোন দেশে আসেনি আমাদের দেশে যে আসবে, সে সম্ভাবনা কম।
আমাদের সরকার কী ভাবছে? আদৌ কি ভাবছে? মুক্ত অর্থনীতির বাজারে সরকারের ভূমিকা বেশ আশ্চর্যের। একদিকে বহুজাতিক কর্পোরেটের ব্যবসার স্বার্থরক্ষায় সরকার মুক্তহস্ত, অন্যদিকে সাধারণ নাগরিকের স্বাস্থ্যের বিষয়ে সরকার উদাসীন, অথচ উপদেশ প্রবণ। তামাকজাত পণ্যের বিষয়টিই ধরা যাক। সরকারি সূত্রেই জানা যায় যে, এ দেশের ক্যানসারের মধ্যে প্রায় চল্লিশ শতাংশের কারণ তামাক। তামাকের অপকারিতা বিষয়ে আমজনতাকে সচেতন করতে সরকার সদা তৎপর। কিন্তু, তামাকজাত পণ্যের বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা আনতে সরকারকে উদ্যোগী হতে দেখা যায় না। সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের প্রস্তুতি ও বিপণনের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর নিষেধাজ্ঞা আনার বিষয়টি কি সরকার ভাবছে?
পেটের বিভিন্ন ক্যানসারের বিষয়টি ধরা যাক। আমাদের দেশে পেটের ক্যানসারের ক্রমবর্ধমান হারের কথা বললেই সকলে ধরে নেন এর মূলে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন। ক্রমশ পাশ্চাত্য ধাঁচের খাবার খেয়ে চলেছি আমরা, তাই এ ধরনের অসুখে ভুগছি। অর্থাৎ, দায়িত্ব আমাদেরই। কথাটায় কিছুটা সত্য থাকতে পারে। কিন্তু, প্রত্যন্ত গ্রামে? সেখানে তো সাধারণ মানুষের পিৎজা-বার্গার বা অঢেল পরিমাণে চারপেয়ে প্রাণির মাংস খাওয়ার সুযোগ হয় না। সেখানেও কেন বাড়ছে এ সব ক্যানসার? খাদ্য উৎপাদনে, প্রক্রিয়াকরণে এবং সংরক্ষণে লাগামহীন রাসায়নিক, কীটনাশক, রঙের ব্যবহার চলছে। সে ব্যবহার এতটাই বিপজ্জনক পরিমাণে যে উন্নত দেশে আমাদের খাদ্যশস্য বা ফল রফতানি করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার সাধারণ নাগরিকের স্বাস্থ্য দেখবে, নাকি বহুজাতিক রাসায়নিক-কীটনাশক-বীজ-প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোর স্বার্থরক্ষা করবে?
ফুসফুসের ক্যানসারের জন্য ধূমপান অন্যতম কারণ, কিন্তু শহরের মানুষের মধ্যে এ ক্যানসারের পিছনে যে ধূমপান ছাড়াও বায়ুদূষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে, সরকার সে প্রশ্ন সযত্মে এড়িয়ে যান। গাড়ির ধূয়া নিঃসরণের আইনটি জোরালো করতে-যেমনটি আজ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সরকার ভারী সংকুচিত, পাছে গাড়ি তৈরির কোম্পানিরা রাগ করে বসে। পাশাপাশি, উন্নয়ন বা পরিকাঠামো-নির্মাণের নামে বছরভর শহরের মানুষকে শ্বাসের সাথে গ্রহণ করতে হচ্ছে সিমেন্ট-মিশ্রিত অতি মিহি ধূলিকণা বাড়ছে ফুসফুসের বিভিন্ন অসুখ, ক্যানসারও। আশা করি, সরকার নাগরিকদের স্বাস্থ্য রক্ষার দিকটা একটু ভেবে দেখবে।
বহুজাতিক কোম্পানিরা এখন ক্যানসার প্রতিরোধ বলতেই বোঝায় জেনেটিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদি এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ। জনপ্রিয় হলিউড-অভিনেত্রী নিজ স্তনযুগল বিসর্জন দিয়ে এ ধারণায় বেশ ধুনোও জুগিয়েছেন। কিন্তু সব মানুষের জিনগত গঠন জেনে ব্যবস্থা গ্রহণ যাকে বলে, তা অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ। আর জেনেটিক বিপদের সমাধান যদি অঙ্গচ্ছেদন হয়, তা হলে তো কোনো দিন এ সমাধান আত্মহত্যাতেও পৌঁছোতে পারে ক্যানসারের বিপদ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তির পথ হিসাবে। তার চেয়ে সহজতর পথগুলো দেখা যাক। সরকারি স্তরে কিছুটা বাড়তি সদিচ্ছা, উদ্যোগ তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন এবং ব্যবহার কমানো, রাসায়নিক কীটনাশকের মাত্রা একটু বেঁধে দেওয়া, দূষণমাত্রা নামিয়ে আনা- সামান্য এতটুকুতেই চমকপ্রদ ফল পাওয়া সম্ভব, বিশেষজ্ঞরা তাই মনে করেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।