তিনি ছিলেন আদর্শিক জীবনের মাইলফলক
ব্যক্তি পরিচয় অতিক্রম করে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিস্তৃত আবহে নিজেকে মেলে ধরে আদর্শিক জীবনের মাইলফলক হয়ে উঠা
‘উম্মার ইতিহাসে কারো কারো অবস্থান
দ্যুতিমান জ্যোতিস্কের মত
মরেও অমর তারা, হৃদ-নভে বিস্তারে সতত
আলোকের ধারা অফুরান
চির অম্লান থাকে যাদের খিদমত অবদান
তেমনি মানুষ এক মাওলানা আবদুল মান্নান।’
২০০৬ সালের আজকের এইদিনে অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেছেন, তবু মনে হয় ওইতো তিনি বসে আছেন। ক্ষণজন্মা পুরুষ, বিস্ময়কর প্রতিভা, অপূর্ব মেধা-মনন দক্ষতা ও নেতৃত্ব ইত্যাদি অভিধা অনেক আছে, প্রকৃত পক্ষে এর সবগুলোই ছিল এই কালজয়ী মানুষটির মধ্যে। অনন্ত সম্ভাবনার দীপ্তি নিয়েই তার জন্ম হয়। এ কথা বলার পেছনে একটি কারণ আছে। একটু পরে আসছি সে কথায়। চাঁদপুর জেলার, ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ১৯৩৫ সালের মার্চে তাঁর জন্ম হয় এক পীরানা ঘরানায়। পিতা সুফী শাহ মোহাম্মদ ইয়াছীন রহ. ছিলেন ফুরফুরা শরীফের প্রখ্যাত পীর হযরত মাওলানা আবু বকর সিদ্দীকী রহ. এর খলিফা, একজন উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তেমনি তাঁর মায়ের বাবা মানে নানা মাওলানা আবদুল মজীদ রহ.ও ছিলেন উক্ত পীর সাহেবের খলীফা একজন ওলীয়ে কামেল। মাওলানা হুজুর তখন নিতান্তই শৈশবে। এ সময় তাঁদের বাড়িতে মাহফিলে এলেন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও বক্তা ২৪ পরগনা জেলার বশিরহাটের মাওলানা রূহুল আমীন। বাড়ির শিশু বাচ্চাদের তাঁর সামনে নিয়ে আসা হলো। তিনি শিশু এম এ মান্নানের চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন: শাহ সাহেবের এই ছেলে একদিন দ্বীন-দুনিয়ার উভয় দিক থেকে বিশ্ববিখ্যাত হবে। ইতিহাস সাক্ষী তাঁর ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল।
আমি তাঁকে প্রায় অর্ধশত বছর ধরে দেখেছি। শিক্ষক হিসাবে, মুহাদ্দিস হিসাবে, প্রিন্সিপাল হিসাবে, জন প্রতিনিধি হিসাবে। এম.পি, মন্ত্রী, দূত হিসাবে। সংগঠক রূপে, বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, অভিভাবক পরিচালক হিসাবে। তাঁর স্নেহ-ছায়া তলে থেকে ছাত্রজীবন থেকে তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত বহু কাজ করেছি, বহুদেশ ভ্রমণ করেছি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু সভা-সম্মেলন, সেমিনার বৈঠকে যোগদান করেছি। সর্বক্ষেত্রেই দেখেছি তাঁর যোগ্যতা, দক্ষতা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, বুদ্ধিমত্তা, আদর্শে অবিচলতা। বিচ্ছুরিত হতে দেখেছি তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার-প্রোজ্জল দীপ্তি। তিনি যেমন মেহমান নেওয়াজ ছিলেন, তেমনি ছিলেন দানশীল।
সামাজিকতার ক্ষেত্রে ভেদাভেদ আছে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা আছে, দ্বন্দ্ব-সংঘাত আছে। ধর্মীয় ক্ষেত্রে মাজহাব, ফিরকা, মতপার্থক্য বা ইখতিলাফ আছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় আর এটা নিরসনও করা যাবেনা। তবু তার ভেতর সহযোগ, সমন্বয়, ঐক্য-প্রচেষ্টা থাকতে হবে। থাকতে হবে সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, গভীর আন্তরিকতা, উদার মানসিকতা, আর এতে যারা নেতৃত্ব দেবেন তাদের প্রতি থাকতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলের আস্থা ও বিশ্বাস। এ গুণাবলী মাওলানা হুজুরের মধ্যে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। সম্পূর্ণ বিরোধী দল, মত, জাতি, ধর্মের লোকদেরকেও তিনি কখনো অবজ্ঞা-অবহেলা করতেন না। তাদের সম্পর্কে অশোভন, অশালীন মন্তব্য করতেন না। যথাযথ সম্মান দিতেন।
লক্ষ্য অর্জনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হয়, তা বাস্তবায়নের জন্য বিজ্ঞানসম্মত প্ল্যান-প্রোগ্রাম করতে হয়। সেজন্য উপযুক্ত লোক বাছাই করে তাদের ওপর দায়িত্ব অর্পন করতে হয়। তারপর তা অর্জনের জন্য চালিয়ে যেতে হয় অবিরাম চেষ্টা-সাধনা। কথায় আছে, হয় মন্ত্রের সাধন না হয় শরীর পতন। মাওলানা হুজুরের মধ্যে এই গুন ও সাধনা আমি বিভিন্ন কাজে দেখেছি। এর দু’ একটি উদহারণ দেয়া যেতে পারে। মন্ত্রী থাকাকালীন এক সময় তাঁকে কোন এক জরুরি কাজে দেশের বাইরে যেতে হবে। সকালের দিকে ফ্লাইট। রাতে তিনি আক্রান্ত হলেন ডায়রিয়ায়, বেশ দুর্বল হয়ে পড়লেন। বাহাউদ্দীন ভাইসহ আমরা সকলে এ অবস্থায় প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করার জন্য বারবার অনুরোধ জানালাম। কিন্তু তাঁর একই জবাব, আমাকে তোমরা নির্দিষ্ট ফ্লাইটে উঠিয়ে দিয়ে এসো। আমার লাশ গেলেও সময় মত সেখানে যাবে।
আর এক বারের ঘটনা। তখন তিনি কঠিনভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। সপ্তাহে একাধিকবার ডায়ালাইসিস চলছে। ওদিকে তিনি বরিশাল শহরে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের আঞ্চলিক এক সম্মেলনে যোগদানের সংকল্প করলেন। হাসপাতালের বেডে শায়িত তিনি, চলছে ডায়ালাইসিস। ওদিকে স্টিমার ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু ডায়ালাইসিস শেষ হতে আরও বেশ সময় লাগবে। ডাক্তারদের বললেন আমাকে মুক্ত করে দিন। তারা বললেন, তা হয় না, আপনি প্রোগ্রাম স্থগিত করুন। তিনি বললেন, না। এক্ষুণি। জীবনে বেঁচে থাকলে বাকীটা ঢাকা ফিরে করাব। তাই করলেন, সময় মত স্টিমারে গিয়ে উঠলেন, বরিশাল সম্মেলনে যোগদান করলেন, বক্তৃতা দিলেন।
আর একবার তিনি অসুস্থতা নিয়ে বাগদাদ শরীফ জিয়ারতের সিদ্ধান্ত নিলেন। সব বাধা অগ্রাহ্য করে সেখানে গেলেন। ফেরার তারিখ মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে হুশ হারিয়ে ফেললেন। সেই অবস্থায়ই সিরিয়ান মরুভূমি পার হয়ে জর্দানের রাজধানী আম্মানে এসে ঢাকার পথে বিমানে উঠলেন। বিমান বন্দর থেকে সরাসরি নিতে হলো হাসপাতালে। এ রকম নজির আছে আরও বহু।
মুসলিম জাহান বিশেষ করে আরব দুনিয়ার সাথে সাংগঠনিকভাবে এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও এমন নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সেসব দেশের রাজা-বাদশাদের সাথে যখন তখন ফোনালাপ করতেন। প্রখ্যাত সরকারি-বেসরকারি লোকেরা যেন তাঁকে নিজ পরিবারভুক্ত ভাবত। সে সব দেশে সফরে গেলে রাজকীয় সম্মান দিত। এর বিস্তারিত বিবরণ অনেক দীর্ঘ। তবে আমি সৌদী বাদশা খালেদের রাজকীয় মেহমান হতে, সেখানকার প্রখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে বন্ধুর মত আচরণ দেখেছি। এদের মধ্যে সালাহ জুমজুম, আলী আল হারাকান, আবদুল্লাহ ওমর নাসিব প্রখ্যাত সৌদী ব্যক্তিবর্গের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সাথে তাঁর ঘনিষ্টতা সকলের জানা। এমনকি সেখানের মন্ত্রীদেরও অনেকে তার পরামর্শ ও সুপারিশ নিতেন। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত, জর্দানের বাদশা হাসান, তাঁর ভাই ও পুত্রের সাথে তিনি একাধিকবার মিলিত হয়েছেন। মিসরের প্রেসিডেন্ট হুসনী মোবারকতো এক বৈঠকে তাঁর কাঁধের ওপর হাত রেখে বললেন, আপনি হলেন আরবজাহান ও বাংলাদেশের মধ্যে এক সেতুবন্ধন। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মোয়াম্মার গাদ্দাফীর দাওয়াতে তিনি লিবিয়া সফরতো করেছেন ই, ত্রিপলীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে যোগদান করে সেখানকার বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ফেডারেশন দেখে অনুরূপ ফেডারেশন বাংলাদেশেও প্রতিষ্ঠার জন্য অনুপ্রাণিত হন। বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনের কয়েকজন বিশিষ্ট নেতাও সে সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। তাদের সাথে এ নিয়ে পরামর্শ হয় এবং দেশে ফিরে তাঁর নেতৃত্বে সরকারি-বেসরকারি স্কুল কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষক সমিতি সমুহের সমন্বয়ে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন গঠিত হয়। এই সম্মিলিত ফেডারেশন থেকে বিশেষ করে বেসসকারি শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া পেশ করা হয়, যার অনেকটা এখন বাস্তবায়িত হয়েছে।
আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ জায়েদ ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রনায়কের সাথেও কায়েম হয়েছিল সুসম্পর্ক। যার সুফল তৎকালীন বন্যার সময় পাওয়া গেছে। তিনি বাগদাদে অনুষ্ঠিত ৮২ জাতির আন্তর্জাতিক সম্মেলনের এক বৈঠকের সভাপতিত্বও করেছেন। অনুরূপ মিসরের রাজধানী কায়রোর জামেউল আজহার শরীফে ওআইসি আহুত শিক্ষা-কনফারেন্সেও এক বৈঠকের সভাপতিত্ব করেছেন। এই বিশ্ববিখ্যাত প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলেম-ওলামাসহ পন্ডিত ব্যক্তিদের সাথেও বৈঠক করেছেন, আলাপ আলোচনা, মত বিনিময় করেছেন। অনুরূপ সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের সর্বমহলের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সাথে ঐতিহাসিক ও ইলমী আলোচনা করেছেন। শিক্ষামন্ত্রিত্বের কালে তিনি দিল্লীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষাবিষয়ক বৈঠকে তার প্রতিপক্ষ প্রতিমন্ত্রী শিলা কাউলী ও অন্যান্য শিক্ষাবিদের সাথে আলোচনা ও মত বিনিময় করেছেন। এ ক্ষুদ্র নিবন্ধে সে সবের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়।
আগেই আভাস দিয়েছি সর্বমহলের ওলামা মাশায়েখের সাথে ছিল তাঁর যোগাযোগ ও আন্তরিক সম্পর্ক। ছারছীনার পীর কেবলা হযরত মাওলানা শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ রহ. তো বাল্যকাল থেকেই তাঁকে পুত্রবৎে স্নেহ দিয়ে এসেছেন। তিনি বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের প্রধান পৃষ্টপোষকতো ছিলেনই ইরাক সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বড়পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী ওয়াকফ ষ্টেটের অর্থায়নে ইরাকী ইঞ্জিনিয়ারদের পাশ করা প্ল্যান অনুযায়ী তাদেরই প্রত্যক্ষ তত্ত্ববধানে মসজিদে গাউসুল আজম কমপ্লেক্স যখন নির্মাণ সমাপ্ত হয়, তখন তাঁরা ইরাক সরকারের পক্ষ থেকে যে দলিল হস্তান্তর করেন তাতেও দুজনকে এর মুতাওয়াল্লী করা হয়। তার প্রথম জন ছারছীনার পীর শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ রহ. এবং দ্বিতীয় জন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি মাওলানা এম এ মান্নান এবং এও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয় যে, তাঁরা দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার পর উভয়ের বংশের তাদের উত্তরাধীকারী যারা হবেন তারাও অনুরূপ মোতাওয়াল্লী হতে থাকবেন। সেই মোতাবেক মাওলানা হুজুরের জ্যেষ্ঠপুত্র এ এম এম বাহাউদ্দীন যিনি ইনকিলাবের সম্পাদক, যেমন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের নির্বাচিত সভাপতি তেমনি মাওলানা এম এ মান্নানের উত্তরাধিকারীর সূত্রে মসজিদে গাউসুল আযম ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীন কমপ্লেক্সেরও স্থায়ী মুতাওয়াল্লীও বটে।
পাকিস্তানের বিশ্বব্যাপ্ত ইসলাম প্রচার সংগঠন মিনহাজুল কুরআন ও তার প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক ড. তাহের আল কাদেরীর নাম ও বক্তব্য শুনেনি, ইসলাম প্রিয় এমন লোক খুব কম আছে। তিনি এসেছিলেন একবার বাংলাদেশ সফরে, ছিলেন কয়েকদিন। ঢাকা এসে তিনি মাওলানা হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করতে ইনকিলাব ভবনে আসেন। ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে মহাখালীস্থ বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন কমপ্লেক্সে এসেও দীর্ঘ সময় আলাপ-আলোচনায় কাটান। এক সময় বিস্ময় বিমুগ্ধ কণ্ঠে বলেন, মাওলানা মান্নান হচ্ছেন চলতা ফেরতা জীবন্ত এক ইতিহাস। শেখ ইউসুফ হাশেম রেফায়ী একজন জগৎবিখ্যাত পীর ও কুয়েত মন্ত্রিসভার এক সময়কার মন্ত্রী। তিনি মাঝে মাঝে বাংলাদেশে আসলে মাওলানা হুজুরের সাথে বৈঠক করতেন। মসজিদে গাউসুল আযমের উদ্বোধনী সালাতে জুমার তিনিই খুৎবা প্রদান করেন ও নামাজের ইমামতি করেন।
সে যাই হোক, বলছিলাম মাওলানা হুজুরের সাথে দেশের অন্যান্য ছিলছিলা, মাসলাকের ওলামা-মাশায়েখের ছিল অত্যন্ত সুসম্পর্ক। তাদের মধ্যে মাওলানা শামছুল হক (ফরিদপুরী) সদর সাব হুজুর, কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতাহার আলী, বাহাদুরপুরের হাজী শরীয়াতুল্লার উত্তরসূরী পীর দুদুমিয়া, মাওলানা ছিদ্দিকুর রহমান (চট্টগ্রাম), ছাহেব কিবলা ফুলতলী আল্লামা আব্দুল লতীফ চৌধুরী, শায়খুল হাদীস মাওলানা আজীজুল হক, চরমোনাই-এর পীর মাওলানা ফজলুল করীম রহ, এভাবে মাওলানা আমীনুল ইসলাম, মাওলানা মুহীউদ্দীন খানসহ সে সময়কার বহু ওলামা-মাশায়েখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দ্বীনী প্রয়োজনে তিনি তাদের সাথে মিলিত হয়েছেন, আলাপ-আলোচনা করেছেন। করণীয় নির্ধারণ করেছেন। ছোটখাটো ইখতিলাফ বা মতপার্থক্য কখনো সামনে নিয়ে আসেননি। এসব ব্যাপারে যার যে মত তাই রয়েছে। জাতীয় ও দ্বীনী স্বার্থ নিয়েই হয়েছে বৈঠক ও কথা-বার্তা। মাওলানা হুজুরের পরে তার পথ অনুসরণ করে তার সুযোগ্য উত্তরসূরী ইনকিলাব পত্রিকার সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনও উসমানী মিলনায়তনে এমন এক বৃহত্তর ওলামা-মাশায়েখ মহাসম্মেলন অত্যন্ত সফলভাবে অনুষ্ঠিত করেছিলেন। আজ যখন বিভিন্ন মিডিয়ায় দেশের যোগ্য ও দক্ষ ওলামা-মাশায়েখ ও ওয়ায়েজকে এসব শাখা মাসায়েল নিয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করতে দেখি তখন মাওলানা হুজুরের কথা মনে পড়ে ও খুবই কষ্ট লাগে।
মাওলানা হুজুরের কীর্তি অনেক। উল্লেখযোগ্য খেদমত বহু। তবে তার মধ্যে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন পুনর্গঠন, মসজিদে গাউসুল আযম ও দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়া যায়। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের জন্ম ১৯৩৭ সালে। এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান নবপ্রাণ লাভ করে মাওলানা হুজুরের নেতৃত্বে আসার পরে। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে এর প্রতি তিনি মনোনিবেশ করেন এবং মাদরাসার জন্য কিছু কাজ করাতে সক্ষম হন। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে এই সংগঠনের প্রাণ চাঞ্চল্যেও দুর্বার গতি সঞ্চারিত হয় মাওলানা হুজুর সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করার পর। ব্যাপকভাবে শুরু হয় এর সাংগঠনিক তৎপরতা। তখন তো ছিল না এর কোনো দফতর, দলিল-দস্তাবেজ, নিয়মতান্ত্রিক ফাইল-পত্র। ছিল না একটা টাইপ রাইটার পর্যন্ত। নিজ বসতঘরেই তিনি শুরু করেন এর কাজ। কখনো কখনো আমাকে ডেকে আনতেন ছারছীনা থেকে। রাখতেন নিজ বাড়িতে। হাজার হাজার মাদরাসায় চিঠিপত্র দেয়া, শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন, সভা-সম্মেলন, মহাসম্মেলন অনুষ্ঠানের যে বিশাল কর্মযজ্ঞ তা সুচারু রূপে সম্পাদন করতে তাঁর কিশোর ছেলে-মেয়েরা যে ত্যাগ, শ্রম, আন্তরিকতা দিয়েছে তা ভুলবার মত নয়। তারই ফলে আজ বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও দেশের শ্রেষ্ঠ পেশাজীবী অরাজনৈতিক সংগঠন।
ইতিহাসের পেছনের ইতিহাস অনেকসময় অলিখিত ও অকথিতই থেকে যায়। মাওলানা হুজুর যখন বলতেন, বেসরকারি শিক্ষকদের জন্যও সরকারি শিক্ষকদের ন্যায় বেতন স্কেল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা চালু হবে, তখন মাদরাসা শিক্ষকতো দূরের কথা বেসরকারি স্কুল, কলেজ সংগঠনের বড় বড় নেতাও হাসতেন, নিজেরা চোখ টিপাটিপি করতেন। শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন কীভাবে গঠিত হলো তার কিছুটা আভাস পূর্বে দেয়া হয়েছে। ক্রমে দাবি আদায় হতে থাকল। বর্তমান অবস্থা তো সবার চোখের সামনেই আছে এবং তা ভোগও করে চলছেন। সেসব কথা এখানে লেখার অবকাশ নেই। তবে ইবতেদায়ী মাদরাসার কথা একটু না বললেই নয়। তখন মাদরাসা বোর্ডের কোর্স কারিকুলামে এর উল্লেখ থাকলেও এ স্তরটির অস্তিত্ব স্বতন্ত্রভাবে তো ছিলই না এমনকি ঢাকার সরকারি মাদরাসা সহ দেশের কোনো মাদরাসাতেই ছিল না। মাওলানা এম এ মান্নানের নেতৃত্বে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের প্রচেষ্টায় এটি চালু হয়। ২১ হাজারেরও বেশি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা স্বল্পদিনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়। তা আজ আবার কমতে কমতে এ অবস্থায় পৌঁছেছে। এই ফিডার ইন্সটিটিউসন পর্যাপ্ত না থাকলে মাদরাসার পরবর্তী স্তরগুলো ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। স্বতন্ত্র ও সংযুক্ত ইবতেদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পেছনে মাওলানা হুজুরের দূরদর্শিতা ও নেতৃত্ব অবিস্মরণীয়।
মাওলানা হুজুরের আধ্যাত্মিক রূপটিও উল্লেখ করার মত। আল্লাহর ঘর কাবা শরীফে, মদীনা মুনাওয়ারায় আল্লাহর হাবীবের মসজিদে ও রওজা মোবারকে গিয়ে তিনি যেন আত্মহারা হয়ে যেতেন। বড়পীর হযরত আ. কাদের জিলানী রহ.-এর মাজার শরীফে খাসভাবে যেতেন সবাই ঘুমিয়ে গেলে, বিশেষ ব্যবস্থায় দরজা খুলিয়ে একান্তভাবে নির্জনে, নিরালয়ে দাঁড়াতেন মাজার শরীফের জালি ধরে। নড়তেন না একচুলও। চোখ বন্ধ করে গভীর ধ্যানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মনে হতো, যা চান তা নিয়েই যাবেন, না নিয়ে ফিরবেন না। অন্যান্য ওলীর মাজারও জিয়ারত করতেন অত্যন্ত বিনয় ও আদবের সাথে। পাকিস্তানের লাহোরস্থ আলীহুজবিরি দাতাগঞ্জে বখশ রহ. এর মাজারেও তাঁকে দেখেছি এই হালতে। দিল্লিতে খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া, বুস্তানুল মুহাদ্দিসিন এবং অন্যান্য প্রখ্যাত ওলী-আউলিয়ার মাজারেও দেখেছি তাঁর একই রূপ। চাইতেন অবশ্যই আল্লাহর কাছে, দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের দরবারে। দেশে বসেও কোনো বিপদ-মুছিবত বা প্রয়োজন দেখা দিলে মহাখালীস্থ মসজিদে গাউসুল আযমে যেতেন গভীর রজনীতে, পড়ে থাকতেন আল্লাহর দরবারে সিজদায়।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইনকিলাবের কথা আর নাই বা বললাম। তাঁরই সুযোগ্য জ্যেষ্ঠপুত্র আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীনের সুদক্ষ সম্পাদনায় সুদীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে এ পত্রিকা। সারাবিশ্বে বাঙালি পাঠকদের মাঝে ইনকিলাব সত্যিই ইনকিলাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। দেশে তো বটেই বিদেশেও সমাদৃত হয়েছে বাঙালি পাঠকদের কাছে সমভাবে। গ্রেট বৃটেনের বিভিন্ন শহরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটে ইনকিলাবের সাথে সংযুক্ত থাকার সুবাদে অতিরিক্ত সমাদর লাভ করে আমি আনন্দে আপ্লুত হয়েছি। অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করার কারণে কর্তৃপক্ষের রোষানলে পতিত হওয়ার সময় বিভিন্ন শহরে ও জনপদে ইনকিলাবের স্বপক্ষে অনেক প্রতিবাদ সভা ও মিছিল হতে দেখে বিস্মিত হয়েছি, নবউদ্দীপনা লাভ করেছি।
তিনি ছিলেন মজলিসী মানুষ, একা থাকতে পারতেন না, চলতেন না। এমনকি একাকী খেতেও পারতেন না। মেহমান নেওয়াজী, অতিথিপরায়ণতা ছিলো যেমন তার স্বভাবজাত, তেমনি দানশীলতায়ও ছিলেন উদার হস্ত। নিজের বসত ভবন ছেড়ে প্রায় কাটাতেন অফিস ভবনে প্রিয়জনদের সাথে গল্পগুজব করে। তার মধ্যেও ছিলো অনেক শিক্ষনীয় বিষয়। শুক্রবারের মূল সময়টা কাটাতেন মসজিদে গাউসুল আযমে। জুমার জামাতের পূর্বে বসতেন মূল হাদীস গ্রন্থ নিয়ে। বিশেষ করে বুখারী শরীফ নিয়ে। হাদীসকে কেন্দ্র করে করতেন তথ্য বহুল পান্ডিত্যপূর্ণ মনোজ্ঞ আলোচনা। তা রেকর্ড করার ব্যবস্থাও ছিলো। সেখান থেকে লিপিবদ্ধ করিয়ে কখনও কখনও ইনকিলাবেও দু’একটি প্রকাশ করতেন। এ নিয়ে ‘সিরাতুল মুস্তাকীমের সন্ধানে’ শিরোনামে দুটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। এই বিজ্ঞ মনিষী ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নশ্বর দুনিয়া ত্যাগ করে অবিনশ্বর জগতে পাড়ি জমিয়েছেন।
যেই মসজিদে গাউসুল আযম তাঁর সাধনার কুতুব মিনার তাঁরই আঙ্গিনায় শুয়ে তিনি শুনছেন আজান, ইকামত, সালাতের আওয়াজ, দোয়া-দরুদ, মুনাজাত ও খোদার দরবারে ফরিয়াদ। তাঁর সুযোগ্য চার পুত্র বাহাউদ্দীন, মঈনুদ্দীন, বাকী বিল্লাহ, সালাহ উদ্দীন ও এক কন্যা। তারা প্রত্যেকেই আল্লাহর মেহেরবানীতে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন সুযোগ্য নেতৃত্বে ধাপেধাপে উন্নতি করে চলছে, এগিয়ে যাচ্ছে তাঁর প্রিয় পত্রিকাও। তাঁর জন্য দেশের মাদরাসায় মাদরাসায়, মসজিদে মসজিদে হচ্ছে দোয়া ও মোনাজাত। তাঁর নশ্বর দেহ চোখের অন্তরালে চলে গেছে বটে তবুও আছেন লক্ষ কোটি মানব হৃদয়ে চির অম্লান। তাই তিনি মরেও অমর।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।