তিনি ছিলেন আদর্শিক জীবনের মাইলফলক
ব্যক্তি পরিচয় অতিক্রম করে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিস্তৃত আবহে নিজেকে মেলে ধরে আদর্শিক জীবনের মাইলফলক হয়ে উঠা
আজ মরহুম মগফুর মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর ১৫তম ওফাত বার্ষিকী। এই দিনটি মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারী ও ইসলামপ্রিয় ব্যাক্তিবর্গের নিকট একটি বেদনাবহ দিন। দুনিয়া ছেড়ে সকলকেই পরকালে যেতে হবে, এটিই বিধান। তবু কিছুকিছু ক্ষণজন্মা মানুষকে দলমত নির্বিশেষে মানুষ স্মরণ করেন কিংবা স্মরণে রাখেন। তাদের মধ্যে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) অন্যতম। দেশের মাদরাসা শিক্ষা তথা বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন স্কেলসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়ে তার অবদান চিরদিন এদেশের বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীগণ অতি যত্ন সহকারে লালন করবেন। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছিলেন উচ্চপর্যায়ের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। আলেমেদ্বীন হিসেবেও ছিলেন একজন বড় মাপের আলেম, মোহাদ্দীস ও মোফাসসীর। নিপুণভাবে তিনি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা দিতেন, যা সহজ-সরলভাবে সাধারণ মানুষদেরকে খুবই আকৃষ্ট করতে সক্ষম হতেন। ছাত্রজীবন থেকে তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ আল্লাহপাক আমাকে দিয়েছিলেন। সেই হিসেবে হুজুরকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। দেশে-বিদেশে অনেক সভা, সেমিনার, সম্মেলন ছাড়াও হজ্জে সফরসঙ্গী হয়ে কাছে থেকে দেখেছি। আজকের দিনে আমি তাঁর বড়ই অভাব বোধ করছি। তিনি ছিলেন দেশের উচ্চপর্যায়ের ধর্মীয় পন্ডিত, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখের প্রিয় পাত্র। আমি দেখেছি, ছারছীনা দরবারের মরহুম পীর সাহেব কেবলা শাহ্ আবু জাফর মো. ছালেহ (রহ.) হুজুরকে আপন সন্তানের মতই ভালবাসতেন। মরহুম আল্লামা আব্দুল লতিফ ফুলতলী (রহ.), মরহুম ফজলুল করিম (রহ.) পীর সাহেব চরমোনাই, মরহুম পীর সাহেব সোনাকান্দা, পীর সাহেব মশুরীখোলা, পীর সাহেব ধামতী, পীর সাহেব মৌকারা, আজিমপুর দরবার শরিফসহ অগণিত দরবারের পীর সাহেবদের সাথে ব্যাক্তিগত সম্পর্ক ছিল খুবই কাছের। আলেমদের মধ্যে মরহুম মাওলানা আমিনুল ইসলাম, মরহুম শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মরহুম মাওলানা নূরুল ইসলাম হাসেমী, মরহুম মাওলানা ওবায়েদুল হক (রহ.), মরহুম মাওলানা ফরিদ উদ্দীন আক্তার, মরহুম মাওলানা মুফতী আমিনি (রহ.) মরহুম মাওলানা শামছুল হক (রহ.), মরহুম মাওলানা আজিজুর রহমান নেছারাবাদী (রহ.) সহ অসংখ্য আলেম-ওলামার যাতায়াত ছিল। গাউছুল আজম কমপ্লেক্সে সর্বদাই হুজুর সকলের দুঃখ-সুখের খোঁজ খবর নিতেন, ওনাদের সান্নিধ্য পেলে আতিথিয়তায় মুগ্ধ করতেন সকলকে। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের অধিকার আদায়ে তিনি গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। সেই সুবাধে দেখেছি, শিক্ষক নেতা মরহুম অধ্যক্ষ শহীদুল্লাহ, মরহুম আলী রেজা, মরহুম আব্দুল খালেক, মরহুম তোফায়েল আহমদ, মরহুম আমান উল্লাহ, মরহুম শরীফুল ইসলাম, মরহুম অধ্যক্ষ মোকাররম হোসেন, কাজী ফারুক আহমদ, অধ্যক্ষ আসাদুল হক’সহ অনেকে হুজুরের সংস্পর্শে আসতে পেরে নিজেদেরকে ধন্য মনে করতেন।
তিনি ছিলেন দেশের আলিয়া নেছাবের মাদরাসা শিক্ষক কর্মচারীদের প্রাণের পুরুষ। এই ক্ষণজন্মা মানুষটির অভিজ্ঞ নেতৃত্বে আজ মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীগণ সমাজে মাথা উঁচু করে নিজেদের আত্মসম্মান নিয়ে মাদরাসা শিক্ষার খেদমত আনজাম দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্ব না হলে আজ হয়তো মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাস অন্যরকম হতো। আমি দেখেছি, মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর ডাকে মরহুম বড় হুজুর আব্দুস সালাম (ঢাকা), মরহুম মাওলানা আব্দুস সালাম মাদারিপুরী, মরহুম মাওলানা আমিনুল্লাহ (নোয়াখালী), মরহুম মুজাহের আহমদ (কক্সবাজার), মরহুম মাওলানা আলী হোসেন (কুমিল্লা), মরহুম মোজাম্মেলুল হক (কুড়িগ্রাম), মরহুম মাওলানা মুসা (রংপুর), মরহুম মাওলানা হাফেজ আব্দুল জলিল (ঢাকা), মরহুম মাওলানা মোছলেহ উদ্দীন (চট্টগ্রাম), মরহুম মাওলানা ইসহাক আহমদ (সিলেট), মরহুম মাওলানা আবু নছর (রংপুর), মরহুম মাওলানা মোহাম্মদ আলী নোমানী (রাজবাড়ি), মরহুম মাওলানা আব্দুর রহমান (বাগেরহাট), মরহুম মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান (চাঁদপুর), মরহুম মাওলানা ফারুক আহমদ (পটুয়াখালী), মরহুম মাওলানা শরীফ আব্দুল কাদের (ছারছীনা), মরহুম মাওলানা সাফি উদ্দীন ভ‚ইয়া (ঢাকা), মরহুম মাওলানা শামছুল হুদা (ময়মনসিংহ), মরহুম মাওলানা আব্দুল লতিফ (বরিশাল)সহ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের অসংখ্য নেতাকর্মী ছুটে আসতেন ঢাকায়, উৎসাহ যোগাতেন হুজুরকে। তাদের মধ্যে আজও আমাদের মাঝে রয়েছেন, মাওলানা রূহুল আমীন খান, মাওলানা নূর মোহাম্মদ খান, মাওলানা শামছুদ্দীন, মাওলানা মো. ইউনুস, মাওলানা আবু ছালেহ, মাওলানা আব্দুর রহমান বেলাসী, মাওলানা আব্দুল বাতেন, মাওলানা রূহুল আমীন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ভাড়া করা অফিস ছিল আমতলী, মহাখালীতে। পরবর্তী সময়ে হুজুরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বর্তমান মসজিদের গাউছুল আজম ও জামিয়াতুল মোদার্রেছীন কমপ্লেক্স স্থাপিত হলে সকলেই এখানে আসতেন। হুজুরের সান্নিধ্যে এসে সকলেই আত্মতৃপ্তি পেতেন। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-কে দেখেছি গভীর রাত্র পর্যন্ত উল্লেখিত ব্যাক্তিবর্গকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে। একজন মোফাসসির ও সুবক্তা হিসেবে মসজিদে গাউছুল আজমে শুক্রবারে জুম্মার পূর্ব সময়ে পবিত্র কোরআন হাদিস থেকে সমসাময়িক বিষয়াবলী নিয়ে বক্তব্য রাখতেন। তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য দূরদুরান্ত থেকে অগনিত মুসল্লি ভিড় জমাতেন গাউছুল আজম মসজিদে। হুজুরের ধারাবাহিক বক্তব্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে মূল্যবান গ্রন্থ।
মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর নিকট নিরাপদ স্থান মনে করে দলমত নির্বিশেষে সকলেই আসতেন। এমনকি সে সময়ের ডান-বাম ঘরনার রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী ব্যাক্তিবর্গকেও দেখেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা হুজুরের সান্নিধ্যে এসে হাসিমুখে বিদায় নিতে। এক কথায় বলা যায়, মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছিলেন সকল পেশা ও শ্রেণির অত্যন্ত আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত ব্যাক্তিত্ব। তাঁর রেখে যাওয়া প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বর্তমান সভাপতি হুজুরের বড় ছাহেবজাদা আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে আজ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের নেতৃবৃন্দ এ সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন হুজুরের অসমাপ্ত গন্তব্যে। যুগেযুগে জমিয়াতকে ভাঙ্গার অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। সরকারিভাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করেও জমিয়াতের ঐতিহাসিক ঐক্যকে বিনষ্ট করতে পারেনি। আজকের জমিয়াত আগের থেকেও অনেক এবং বহুগুণে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ। কারণ, এই জমিয়াতের পেছনে রয়েছে এদেশের প্রখ্যাত আলেম-ওলামার নেক দোয়া। বিশেষ করে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর স্মৃতিধন্য প্রেরণা ও রূহানী ফায়েজ। কাজেই আমরা বলতে পারি, মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর সময়ে যেমন দেখেছি ঠিক তেমনি আজকেও দেখছি হুজুরের প্রচেষ্টায় গড়া মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের জয় জয়কার ও উত্তরোত্তর সফলতা। আসুন, আমরা যে যেখানে আছি ইসলামি শক্তিতে বলিয়ান হয়ে বলি, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন জিন্দাবাদ। একই সাথে কমনা করি তিনি যেন জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকামে অধিষ্ঠিত হন। আমিন।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।