পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
প্রবাসে বাংলাদেশি কর্মীদের বেশিরভাগই হৃদরোগ-স্ট্রোকে মারা যাচ্ছেন। মৃত কর্মীদের অনেকেই দালাল চক্রের একাধিক হাত বদল হয়ে অধিক ব্যয়ে বিদেশ গিয়ে মানসিক চাপে ভুগছিলেন। সরকারি হিসাবে গেল বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী কর্মী মারা গেছে ৩৮০০ জন। যদিও এ হিসাব দেশে ফেরত আসা বৈধ কর্মীর লাশের হিসাব মাত্র। এই হার আগের বছরগুলোর তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব কর্মীর মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক ও হৃদরোগ। এদের অধিকাংশেরই বয়স ২৫-৩৫ বছরের মধ্যে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশ গমনের খরচ বা অভিবাসন ব্যয়ের তুলনায় কম আয়ের কারণে মানসিক চাপ ও দীর্ঘদিন স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে একাকিত্বই প্রবাসী কর্মীদের স্ট্রোক ও হৃদরোগের প্রধান কারণ। পাশাপাশি দৈনিক ১২-১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম, অপর্যাপ্ত খাবার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকার কারণেও প্রবাসে রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব নেয়ার পর নবনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ঘোষণা করেছেন, অভিবাসন খরচ কমিয়ে বিদেশে কর্মীদের জন্য ভালো কাজের পরিবেশ তৈরিতে সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। জানা গেছে, গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩ হাজার ৭শ ৯৩ জন কর্মী বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন। এদের মধ্যে ১০৭ জনই মহিলা কর্মী। মৃত কর্মীদের মধ্যে অধিকাংশ কর্মীই উচ্চ সুদের ঋণের অর্থ যথাসময়ে পরিশোধ করতে পারেননি। ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পেরে অনেকেই বিদেশের কর্মস্থলে মৃত্যু ঝুঁকিতে কঠোর পরিশ্রম করে দিনাতিপাত করছে।
গত ৯ জানুয়ারি ইতালি প্রবাসী চাঁদপুর ফরিদগঞ্জের শাহাদাত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন । পরবর্তী সময়ে মেডিকেল পরীক্ষায় তার মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয় স্ট্রোক। শাহাদতের তিন সন্তান রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ইতালির উত্তর-পশ্চিম সালেরনো এলাকায় বসবাস করতেন তিনি।
সউদী আরবের দাম্মামে একটি কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাকির হোসেন। ১৬ জানুয়ারি রাতে হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসারত অবস্থায় ওইদিনই মৃত্যুবরণ করেন এ সউদী প্রবাসী। তাৎক্ষণিক হার্ট এটাকে জাকিরের মৃত্যু হয়েছে বলে তার মেডিকেল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবাসীরা বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে থাকায় তাদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্তের হার বেশি। এছাড়া দেশের বাইরে যাওয়ার পর তাদের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আসে, যা হৃদরোগের জন্য দায়ী। আবার অনেকে জানেন না, কোথায় কীভাবে চিকিৎসা নিতে হয়। কোনো ধরনের চেকআপের মধ্যে না থাকায় অনেকে হৃদরোগে ভুগলেও চিকিৎসা না করায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সব সময় চাপের মধ্যে থাকায় প্রবাসীদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার হারও বেশি বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রাজিউল হক।
বিএমইটির সূত্র জানায়, প্রবাসে মারা যাওয়া কর্মীদের লাশ দেশে আনতে সহযোগিতা করছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে লাশ দাফনের জন্য বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ ডেক্স প্রথমে ৩৫ হাজার ও পরে ৩ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী কর্মীদের পরিবারগুলোকে ২০১৮ সালে ১১৮ কোটি ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ১০১ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে মোট ৩ হাজার ৭৯৩ বাংলাদেশী কর্মীর লাশ দেশে আনা হয়েছে। এর মধ্যে বৈধ ও অবৈধ কর্মীর লাশের সংখ্যা ৩ হাজার ৩শ ৭১। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩শ ৫৩টি লাশ এসেছে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এছাড়া ৩শ ৭৪টি লাশ এসেছে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ৬৬টি সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বেশির ভাগ লাশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে সউদী আরব থেকে। সউদী আরবের পর বেশি লাশ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। সউদী আরব থেকে ১ হাজার ১শ ১৩ জন প্রবাসীর লাশ দেশে এসেছে। একই বছর মালয়েশিয়া থেকে ৭৩৬ জন প্রবাসী কর্মীর লাশ দেশে এসেছে।
২০১৭ সালে প্রবাসে কর্মীর লাশের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩৮৭। এছাড়া ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪শ ৮১, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩০৭ ও ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩ শ ৩৫ জন কর্মীর লাশ দেশে এসেছিল। অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এসব মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে স্ট্রোক ও হৃদরোগ।
সুস্থ দেহে দেশ থেকে যাওয়ার পরও প্রবাসী কর্মীদের স্ট্রোক ও হৃদরোগে মৃত্যু কেন বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, প্রবাসী কর্মীরা বিদেশে পাড়ি দেয়ার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যাচ্ছেন। সে সময় কিন্তু হৃদরোগ ধরা পড়ছে না। বিদেশে পৌঁছার পরও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় এ ধরনের কোনো উপসর্গ পাওয়া যাচ্ছে না। এর পরও প্রবাসী কর্মীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু কেন বাড়ছে, সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। আর যেসব মৃত্যুর কারণ হিসেবে দুর্ঘটনা বা অন্যান্য রোগের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো কতটা ঠিক, তাও বিবেচনা করতে হবে। কারণ বিমানবন্দরে লাশ আসার পর স্বজনরা প্রকৃত কারণ খোঁজার চেয়ে তাড়াতাড়ি লাশ দাফনেই বেশি গুরুত্ব দেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ে বিদেশে গিয়ে প্রত্যাশিত আয় করতে না পারার কারণেও মানসিক চাপে থাকছেন অনেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ প্রবাসী কর্মীই দালালের প্রলোভনে ভিটেমাটি বিক্রি ও চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বেশি ব্যয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে বেশির ভাগ সময়ই তারা প্রত্যাশা অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন না, যা তাদের সবসময় মানসিক চাপের মধ্যে রাখছে। আকস্মিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ এটি। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতীয় ও নেপালের প্রবাসী নাগরিকদের আকস্মিক মৃত্যুর হার কম। কারণ সেসব দেশের অভিবাসন ব্যয় (বিদেশ যাওয়ার খরচ) বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম।
ঢাকার একটি এজেন্সীর মাধ্যমে ২০০৪ সালে কুয়েতে যান পাবনা জেলার কালাম আলী। সেখানকার একটি কোম্পানিতে গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রত্যাশিত আয় না হওয়ায় সবসময় মানসিক চাপে থাকতেন কুয়েত প্রবাসী কালাম আলী। এ অবস্থায় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি কর্মরত অবস্থায় স্ট্রোক করে মারা যান।
বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান রাতে ইনকিলাবকে বলেন, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী মৃত কর্মীদের নিয়োগকর্তারা যাতে আর্থিক সহায়তা দিতে বাধ্য থাকেন সে জন্য সরকারকে সমঝোতা স্মারকে উল্লেখ থাকতে হবে। তিনি বলেন, বিদেশে যাওয়ার আগে কর্মীদের সচেতন হতে হবে-তারা কত টাকা ব্যয় করে যাচ্ছেন এবং প্রতি মাসে কত টাকা আয় করতে পারবেন। এটা বুঝে শুনে বিদেশে গেলেই প্রবাসে মৃত্যু ঝুঁকি কমবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। বায়রার সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব আলহাজ আবুল বাশার বলেন, প্রবাসে মৃত কর্মীদের বহু পরিবার ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পেরে বাড়ী-ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দালালদের একাধিক হাত বদল হয়ে কর্মীরা ঢাকার রিক্রুটিং এজেন্সীর মাধ্যমে তিন লাখ টাকা থেকে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা দিয়ে বিদেশে গিয়ে চরম মানসিক চাপে পড়েন। তিনি বলেন, দশ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় ৩/৪ লাখ টাকা ব্যয়ে কর্মী যাওয়ায় অনেকেই সেখানে চরম হতাশায় ভুগছে। আগে বিএমইটিতে বর্হিগমন ছাড়পত্র নিতে ১০ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হতো। এতে অভিবাসন ব্যয় বৃদ্ধি পেতো। দালালদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সরকারকে মনিটর সেল গঠন করে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনলেই প্রবাসী মৃত্যু ঝুঁকি কমবে।
অন্যদিকে, দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়ে দুবাই ভিজিট ভিসা নিয়ে সুদান হয়ে লিবিয়া গিয়েছিল ২৫ জন যুবক। এসব যুবকদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচার করার উদ্দেশ্যে জনপ্রতি ৬/৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র। গতকাল বুধবার সকাল ১০ টায় লিবিয়া থেকে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট যোগে খালি হাতে ঢাকায় ফিরেছে প্রতারণার শিকার এসব যুবক। হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর কল্যাণ ডেক্সের উপ-পরিচালক তানভীর আহমদ এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সুদান থেকে এদের কয়েক জনকে মরুভূমির ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। জানা গেছে, বিভিন্ন অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সীর মালিক ঢাকা বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশনের অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজস করে দুবাই ভিজিট ভিসায় এদেরকে পাঠিয়েছিল। এছাড়া সউদী আরবে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার রিয়াদ সফর জেল থেকে গত রোববার একটি ফ্লাইট যোগে ৮১ জন মহিলা গৃহকর্মী ঢাকায় ফিরেছে। এদের অধিকাংশই খালি হাতে বাড়ি ফিরে গেছে। সউদী আরবে প্রবাসী মহিলা গৃহকর্মীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ায় বিএমইটি কর্তৃপক্ষ শতাধিক মহিলা প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সীর সার্ভার লক করে রেখেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।