পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
খাদ্য নিরাপত্তা ও পানি ব্যবস্থাপনা মানুষের সামগ্রিক অস্তিত্বের সাথে সর্ম্পকযুক্ত। কৃষি ও নগর সভ্যতার উন্মেষের সাথে জড়িয়ে আছে নদনদীর ইতিহাস। প্রতিটি সভ্যতার সূতিকাগার হচ্ছে সুপেয় পানির নাব্য জলধারা। আমাদের সীমিত আয়তনের দেশে কোটি কোটি মানুষের ঘনবসতি গড়ে ওঠার পেছনে এদেশের জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ অসংখ্য জলাধার, বহতা নদী এবং নদীবাহিত পলিমাটি দিয়ে গড়া উর্ব্বর ভ‚মি থেকে ফসলের সমারোহ। এ কারণেই নদীর অস্তিত্বের সাথে আমাদের ভ‚-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্তিত্বের সম্পর্ক নিবিড়ভাবে যুক্ত। আন্তর্জাতিক যৌথ নদীর উপর উজানের ভারতের বাঁধ নির্মান ও পানি প্রত্যাহারের ঘটনা শুধু পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়। উপরন্তু বাংলাদেশ পানিবঞ্চিত করে বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক পরিবেশসহ সামগ্রিক অস্তিত্বকইে দুর্বিসহ করে তোলার মত ঘটনা। একদিকে যৌথনদীর পানি নিয়ে আমরা সীমাহীন বঞ্চনা ও অব্যবস্থ্পানার শিকার। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে নদ নদীর দূষণ ও দখলবাজির কারণে নদনদীর সুপেয় পানি বহুমাত্রিক ব্যবহারের উপযোগিতা হারাচ্ছে এবং নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে। দীর্ঘকালীন নাব্য সংকটের পর ইতিমধ্যে শত শত নদনদী শুকিয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।
শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছ পানির গুনাগুনের উপর ভর করে গড়ে ওঠা নারায়নঘঞ্জের সোনারগাঁয়ের মসলিনশিল্প এক সময় বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছিল। সেই শীতলক্ষ্যা নদী এখন দূষণের শিকার হয়ে দুর্গন্ধ নহরে পরিনত হয়েছে। যে নদীর সুপেয় পানি এবং নাব্যতার উপর ভিত্তি করে সুলতানী আমলে বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকা নগরীকে নির্বাচন করা হয়েছিল, সেই বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পরিশোধনের পরও এখন আর এই নদীর পানিকে সুপেয় করে তোলা সম্ভব নয়। মাত্র তিন-চার দশক আগেও ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে স্বচ্ছ পানি ছিল, ছিল জলজ উদ্ভৎ, নানা প্রজাতির মাছ। এসব নদীতে মাছ ধরে শত শত জেলে পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। নৌকা ছিল মানুষের যাতায়াত ও ব্যবসায় বানিজ্যের প্রধান অবলম্বন। নদীর পানিতেই মাঝি-মাল্লারা তৃষ্ণা মেটাতো। সে সব নদীর পানিতে এখন দূষণ এতটাই প্রকট যে, পানি পান করা দূরের কথা, শিল্প বর্জ্যরে রাসায়নিক দূষণের কারণে পানি স্পর্শ করাও বিপজ্জনক। নদী পার হতে গেলে দুর্গন্ধে মুখে রুমাল চেপে ধরতে হয়। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ ও বালুনদীর পানির দূষণের মাত্রা এতটা প্রকট যে তা এখন শহরের নর্দমার পানির মত অনেকটা আলকাতরার মত রঙ ধারণ করেছে। এই পানি ফসলি জমিতে সেচকাজেরও অনুপযোগী, অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছে। নদী তীরে শত শত শিল্প কারখানা গড়ে উঠলেও শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিশোধন ও নিয়ন্ত্রণের প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থাপনা যেন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশই নদনদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা নগরায়ন ও শিল্পায়ণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়েছে। সেখানে এমন নদী দূষণের ঘটনা বিরল। আমরা আমাদের নদীগুলোর নাব্যতা এবং পানি দূষণ রুখতে না পারলে দেশের সব সম্ভাবনা বড় ধরনের হুমকির মধ্যে পড়বে।
ঢাকার চারপাশের সবগুলো নদী, বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদী, হালদা নদীর পানি দূষণ নিয়ে উদ্বেগ দীর্ঘদিনের। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে খুলনা মহানগরীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা ৩টি নদী প্রভাবশালী মহলের বেপরোয়া দখল আর দূষণে অস্তিত্বের সংকটে পড়ার তথ্য জানা যায়। অর্থাৎ সারাদেশের সব প্রান্তের প্রধান নদনদীগুলো লাগামহীন দূষণ ও দখলের শিকার হয়ে পড়েছে। নদনদীর নাব্যতা এবং দূষণ প্রতিরোধে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনা থাকলেও এসব উদ্যোগে নদনদীর দখল ও দূষণমুক্তিতে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। পানিসম্পদ মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে পানিব্যবস্থাপনা অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও এর বড় অংশই দুর্নীতি ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় লোপাট হয়ে যাচ্ছে। দেশের সামগ্রিক নদনদী ও অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যেই বহু প্রত্যাশিত ব-দ্বীপ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে নদনদীর নাব্য সঙ্কট, নদী ভাঙ্গন, উপকুলীয় সুরক্ষা ব্যবস্থাসহ নদী ও পানি ব্যবস্থাপনায় নি:সন্দেহে একটি বিশাল পরিবর্তন ঘটবে। তবে নদনদীর দূষণ ও দখল রোধে দীর্ঘ মেয়াদী পানি ব্যবস্থাপনা অথবা ব-দ্বীপ প্রকল্পের মত প্রকল্পের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। শিল্প কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ নদী দূষণের সব উৎসের দিকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। পানি সম্পদের উন্নয়ন ও পানিব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি রোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্যের নানাবিধ বিকল্প থাকলেও পানির কোনো বিকল্প নেই। নদনদীর দখল, দূষণ ও আগামীতে সুপেয় পানির সম্ভাব্য সঙ্কট মোকাবেলার মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।