পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর নারীশিক্ষা প্রসঙ্গে একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন মহলে সমালোচনা ও বির্তক সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে তথাকথিত প্রগতিবাদী ও নারীবাদী সংগঠনের ব্যক্তিবর্গ এবং এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী রীতিমত হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। চিলে কান নিয়েছে শুনে তারা দৌঁড় শুরু করেছেন; কানে হাত দিয়ে দেখার অবকাশ পাননি। আল্লামা আহমদ শফী দেশের একজন স্বনামধন্য বর্ষীয়ান আলেম, হাটহাজারি বড় মাদ্রাসার মুহতামিমও। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর ছাড়াও তিনি কওমিপন্থী ছয় বোর্ডের নিয়ন্ত্রণকারী হাইয়াতুল উলিয়া লিল জমিয়াতিল কাওমিয়ার চেয়ারম্যান। এহেন একজন আলেম ও ইসলামী শিক্ষাবিদ এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তির পক্ষে নারীশিক্ষার বিরোধিতা করা কতটা সম্ভব, সেটা সমালোচনাকারীরা যথেষ্ট বিবেচনায় নিয়েছেন বলে মনে হয় না। ইসলাম শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। মহানবী সা. এর মাধ্যমে মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর প্রথম বাণী ‘পড়’। পবিত্র কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ আয়াতই হলো: ‘পড় তোমার প্রভ‚র নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ লেখাপড়া ও জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে ইসলামের এই নির্দেশ, ইসলাম সম্পর্কে যার ন্যূনতম ধারণা আছে, তারও অজানা নেই। মহানবী সা. বলেছেন, ‘শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন প্রত্যেক নারী-পুরুষের জন্য ফরজ।’ শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনে ইসলামের এই প্রণোদনার জন্যই অল্প কালের মধ্যেই পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানরা নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়। ইতিহাস ও বিশ্বমানবমন্ডলী এটা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করে নিয়েছে। কাজেই একজন বড় আলেম ও ইসলামী শিক্ষাবিদের এসব বিষয় অজানা থাকার কথা নয়। নারীশিক্ষা প্রসঙ্গে কথিত বক্তব্যটি আল্লামা আহমদ শফী এভাবে দিয়েছিলেন কিনা এবং তার বক্তব্যের প্রেক্ষিত ও পটভূমি আসলেই কি ছিল তা সঠিকভাবে অবহিত না হয়ে অস্বাভাবিক তড়িঘড়ি করে সমালোচনার বান সৃষ্টি করা বৌদ্ধিক সৌজন্যের পরিচয় বহন করে না।
আমরা অত্যন্ত দু:খের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমাদের দেশে এক শ্রেণীর তথাকথিত প্রগতিবাদী, কমিউনিস্ট, সেকুলারিস্ট ও নারীবাদী আছেন যারা ইসলাম ও আলেম-ওলামার ব্যাপারে অসহিষ্ণু। তারা যে কোনো অজুহাতে ইসলাম ও আলেম-ওলামার সমালোচনায় সোচ্চার হয়ে উঠেন। নারীশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর অধিকার প্রসঙ্গে তারা ইসলাম এবং আলেম-ওলামাকে প্রতিবন্ধক হিসাবে গণ্য করেন। তাদের সাথে নাস্তিক্যমনা ধর্মবিদ্বেষী কিছু লোকেও আছেন। অথচ নারীর অধিকার, মর্যাদা ও সম্মান সবচেয়ে বেশি দিয়েছে ইসলাম। আলেম-ওলামা ইসলামের এই নির্দেশ ও শিক্ষাই প্রচার করেন, ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। এদেশের নারী-পুরুষের শিক্ষা বিস্তারে আলেম-ওলামার অবিস্মরণীয় ভূমিকা ইতিহাসে উজ্জ্বল অধ্যায় হিসাবে বিধৃত হয়ে আছে। আজকে দেশে শিক্ষিতের হার ৭০ শতাংশের ওপরে। নারীও এ শিক্ষা থেকে পিছিয়ে নেই। নেই বলেই আজ রাজনীতি, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা ও পেশা জগৎসহ সরকারী-বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে নারীর অবস্থান ও প্রতিষ্ঠা লক্ষ্য করা যায়। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে দেশ ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীরা কাজ করছেন। একমাত্র গার্মেন্ট সেক্টরেই কাজ করছেন ৫০-৬০ লাখ নারী। ইসলামে যদি নারী শিক্ষা, নারীর কর্মসংস্থান, নারীর অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী থাকতো এবং আলেম-ওলামাও যদি তার বিরোধিতা করতেন তাহলে কি এটা এত সহজে সম্ভবপর হতো? এটাও অত্যন্ত দু:খের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, দেশজুড়ে নারীর ওপর ব্যাপক সহিংসতা হচ্ছে। তারা ধর্ষিতা হচ্ছেন, নিহত হচ্ছেন, ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন। কন্যা শিশুরা পর্যন্ত এ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এক কথায়, ঘরে-বাইরে নারীরা আজ অনিরাপদ। এসব ক্ষেত্রে মৌসুমী বুদ্ধিজীবী ও তথাকথিত প্রগতিশীলদের ন্যূনতম প্রতিবাদ জানাতেও খুব কমই দেখা যায়। সমাজের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে, বিভেদ আছে, অন্যায়-অবিচার আছে, জুলুম-নির্যাতন আছে। এসবের অবসানে তাদের ভূমিকা ও অবদান কতটুকু তাও ভাবার বিষয়।
আজ সমাজের মধ্যে যে ব্যাপক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, বিশেষজ্ঞদের মতে, তার কারণ ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা,পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের ক্ষয়, বহিরাগত ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রভাব, সুশাসনের অভাব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি। তারা মনে করেন, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা, সুশিক্ষা ও পারিবারিক-সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করাসহ বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধ করা সম্ভব হলে এ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান ঘটতে পারে। সুশাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হতে পারে। সমাজে শান্তি, শৃংখলা, সুশিক্ষা, ধর্মীয়সহ পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় আলেম-ওলামার ভূমিকা আগেও ছিল, এখনো ও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সেই ভূমিকা কিভাবে আরো কার্যকর ও ফলপ্রসূ করা যায় সেটাই রাষ্ট্র ও সমাজের ভেবে দেখা উচিৎ। উল্লেখ আবশ্যক, আল্লামা আহমদ শফীর যে বক্তব্য নিয়ে এত শোরগোল, সে সম্পর্কে তিনি নিজেই একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, মাহফিলে দেয়া তার বক্তব্যের একটি খন্ডাংশ বিভিন্ন মিডিয়ায় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেছেন: বক্তব্যে আমি মূলত বলতে চেয়েছি, ইসলামের মৌলিক বিধান লংঘন হয়, এমন প্রতিষ্ঠানে নারীদের পড়াশুনা করানো উচিৎ হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলাম একটি পূর্ণার্ঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এখানে শিক্ষা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় সব কিছুই রয়েছে। ইসলামে নারীদের শিক্ষার বিষয়ে উৎসাহিত করা হয়েছে। নারীবিদ্বেষী ও নারীশিক্ষা বিরোধী বলে তাকে সমালোচনা করা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন: দেশের লাখো মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী দাওরায়ে হাদিস পাস করে মাস্টার্সের সমমান অর্জন করছেন, যে সম্মিলিত বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দিয়ে তারা রাষ্ট্রস্বীকৃত উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন সেই বোর্ডের প্রধান হয়ে আমি কিভাবে নারীশিক্ষার বিরোধী হলাম, তা বোধগম্য নয়। আমি বা আমরা নারীশিক্ষার বিরোধী নই, তবে নারীর জন্য উপযোগী পরিবেশ ও নিরাপদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আগেও সতর্ক করেছি, এখনো করছি। আমরা চাই, নারীরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। বলা বাহুল্য, নারীশিক্ষার নিরাপদ পরিবেশ মোটেই কোনো অযৌক্তিক দাবী বা প্রসঙ্গ নয়। এটা সঙ্গতকারণেই প্রয়োজন। অত:পর আমরা আশা করি, এ বিষয়ে সকল সমালোচনা ও বিতর্কের অবসান হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।