Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রবীন্দ্রকাব্যে নারীভাবনা

প্রকাশের সময় : ৬ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. গুলশান আরা
কল্পনা’ (১৯০০) কাব্যের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ। ঊনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীর কাব্যে ‘কল্পনা’। যে কাব্যে বিগত শতাব্দীর রেশ প্রাচীন ভারত এবং কালিদাসের কালের রোমন্থনে উপস্থাপিত ‘স্বপ্ন’ যার প্রতীক। সেই সময়ে রবীন্দ্র মানস শুধু প্রেম ও সৌন্দর্য সাধনায় তৃপ্ত থাকেনি, ধাবিত হয়েছে বৃহৎ আদর্শ ও মনুষ্যত্বের দিকে। ‘কল্পনা’ কাব্যে কবির মনন, ত্যাগ, বীর্য, সত্য, নিষ্ঠা, শাশ্বত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রেম- সৌন্দর্য কল্পনা প্রাচীন ভারতীয় পরিবেশের মধ্যে স্থাপন করেছেন। তবু ‘মার্জনা’ কবিতার নারী বর্তমান বিশ্বের প্রেয়সী। প্রিয়তমকে ভালোবেসে বলছেÑ
‘প্রিয়তম, আমি তোমারে যে ভালোবেসেছি,
  ...        .....    
রানীর মতন বসবো রতন আসনে,
বাঁধিব তোমারে নিবিড় প্রণয় শাসনে;
দেবীর মতন পুরাব তোমার  বাসনা।’
‘খেয়া’ (১৯০৬) তে যে আধ্যাত্ম বোধের সূচনা সেই বোধের চরম উৎকর্ষ সার্থকভাবে রূপায়িত ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০) তে। ‘চৈতালী’ (১৯১২)  কাব্যে আবার তাকে বাস্তব পৃথিবীর হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের চিত্র বর্ণনায় দেখা গেল। ‘দিদি’ কবিতার দিদি। ‘বড় ব্যস্ত সারা দিন’ ঘরকন্যার কাজে। তার কর্মব্যস্ততায় সে আর দিদি থাকেনি। কবির কাছে মনে হয়েছে, ‘জননীর প্রতিনিধি/ কর্মভারে অবনত অতি ছোট ‘দিদি’।
‘পরিচয়’ কবিতাতেও দিদি যেন বিশ্ব জননীÑ
‘এক কক্ষে ভাই লয়ে, অন্য কক্ষে ছাগ,
দুজনেরে বাঁটি দিল সমান সোহাগ।
পশু শিশু, নর শিশু দিদি মাঝে পড়ে
দোঁহারে বাঁধিয়া দিল পরিচয় ডোরে।।’
নারী সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উক্তি ধরা পড়েছে ‘চৈতালী’ কাব্যের ‘মানসী কবিতায়। কবি লিখেছেনÑ
‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
পুরুষ গড়েছে তোমা সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমা সূত্রে বুনিছে বসন।...
সে কারণে কবির মনে হয়েছেÑ
‘পড়েছে তোমার ’পরে প্রদীপ্ত বাসনা,
অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।’
‘খেয়া’, ‘চৈতালী’ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে প্রকাশিত। এ সময়ে তার স্বজন বিয়োগের ফলে উল্লেখযোগ্য কাব্য নেই। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে রবীন্দ্রনাথ যা রচনা করেছেন তা তার ব্যক্তিগত কয়েকটি কারণে পূর্ববর্তী রচনা থেকে স্বতন্ত্র। স্ত্রী-কন্যা-নাতনির মৃত্যুতে তার মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়ভাবে ধরা পড়েছে। ‘স্মরণ’ কাব্য কবির সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর স্মরণে লেখা। একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের গভীর দুঃখ-বেদনা এই কাব্যে একটি সর্বজনীন রসোপলব্ধির পর্যায়ে উন্নীত। কবি প্রিয়াকে মৃত্যুর পর উপলব্ধি করার যে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এর অনেকগুলো কবিতায়।
‘যুগল মিলন’ কবিতায় কবি বলেছেনÑ
‘মিলন সম্পূর্ণ আজি হল তোমা সনে,
এ বিচ্ছেদ-বেদনার নিবিড় বন্ধনে।’
‘উৎসর্গ’ (১৯১৪) কাব্যেও নারী কবির কাছে রহস্যময়ী। ‘ছল’ কবিতায় রহস্যময়ী এই নারীর ছলনায় কবির বক্তব্যÑ
‘তোমারে পাছে সহজে বুঝি তাই কি
এত লীলার ছল
বাহিরে যবে হাসির ছটা ভিতরে থাকে
আঁখির জল।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনাÑ
যে কথা তুমি বলিতে চাও সে কথা তুমি বল না।’
কিন্তু নিজেকে আড়াল করা নারীর পক্ষে সব সময় সম্ভব হয় না। তাই তো ‘চেনা’ কবিতায় কবির প্রশ্নÑ
‘আপনার তুমি করিবে গোপন কী করি
হৃদয় তোমার আঁখির পাতায় থেকে থেকে পড়ে ঠিকরি!’
বলাকা (১৯১৬) কাব্যের মধ্য দিয়ে বিংশ শতাব্দীতে-বাংলা কবিতায় নূতনত্ব আনলেন রবীন্দ্রনাথ। এ কাব্যে যৌবনের জয়গান ও গতিবেগের গুনগানই মূল কথা। ‘বলাকা’ থেকে রবীন্দ্রনাথ তার রচনা রীতি নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন শেষ পর্যায়ের কাব্যে তা-ই চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। এ কাব্যে বিশেষ কীভাবে নিবিশেষ হয়ে যায় তা প্রকাশ পেয়েছে ‘ছবি’ ‘শা-জাহান’ কবিতায়। ‘বলাকা’ কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘ছবি’। এতে দেখা যায় জীবনের কেন্দ্রস্থলে যে বস্তুটি স্থির সেটি তার কিশোর প্রেম, কবিত্বের অনুপ্রেরণার উৎস। ভাবনার অবলম্বনÑ ‘নাহি জানে কেহ নাহি জানে/ তব সুর বাজে মোর প্রাণে/কবির অন্তরে তুমি কবি/নও ছবি, নও শুধু ছবি।’
তার কিশোর জীবনের প্রেম মৃত্যুর আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। এখন সে শুধু ছবির স্থির রেখা বন্ধনে আবদ্ধ। জীবন প্রভাতে যাকে পেয়েছিলেন, মরণের অন্ধকারে যাকে আবার হারিয়েছেন তাকেই জীবনের পথ চলার অগোচরে বার বার উপলব্ধি করেছেন কবি।
‘বিস্মৃতির মর্মে বসি রক্তে মোর দিয়েছে যে দোলা।
‘শা-জাহান’ কবিতায় তুলে ধরা হয়েছে এমন এক সত্যকে যা চিরন্তন। চলার পথে জীবনের সমস্ত কিছুই পেছনে ফেলে যেতে হয়, এমন কি প্রেমকেও। স¤্রাট শাহজাহান তাজমহলকে ‘কালের কপোল তলে’ ‘শুভ্র সমুজ্জ্বল’ ‘এক বিন্দু অশ্রুজল’ রূপে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শাহজাহানের জীবন, জীবনের মুহূর্তে আবদ্ধ থাকেনি বরং জীবনের অন্তবেদনা বস্তুরূপে তাজমহলের মধ্যে আবদ্ধ হয়েছে এবং ‘তুচ্ছ করি জীবন মৃত্যুর ওঠাপড়া/যুগে যুগান্তরে কহিতেছে এক স্বরে/চির বিরহির বাণী নিয়াÑ
ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া।’
‘বলাকা’ কাব্যে কবির দৃষ্টি অনেক বাস্তবমুখী হয়েছে যার ফলে ‘পলাতক।’ (১৯১৮) কাব্যের মতো মানব জীবনের হাসি-কান্না এবং দৈনন্দিন সুখ-দুুঃখের জোয়ার-ভাটায় আন্দোলিত কাব্য রচনায় স্বাচ্ছন্দ্য হয়েছেন। ‘পলাতকা’র কবিতাগুলি সহজ জীবনের মধ্যে যে হাহাকার তারই প্রতিচ্ছবি। কবিতা ও কাহিনী যে এক সঙ্গে গাঁথা যেতে পারে, কবি তার পরিচয় দিলেন এ কাব্যে। গল্পগুলোর প্রতিপাদ্য বিচ্ছেদ, বিদায় এবং মৃত্যু। এ প্রসঙ্গে ‘মুক্তি’ কবিতাটির কথাই ধরা যাক। এখানে মেয়েদেরকে সমাজের তথা রাষ্ট্রের বৃহৎ কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে রেখে তাকে আবদ্ধ করা হয়েছে অন্তঃপুরে এবং চালানো হচ্ছে নানাবিধ অত্যাচার।
অন্তঃপুর বাসিনী একত্রিশ বছর বয়সী নারী যখন রোগে শোকে পরপারে যাত্রা করতে বসেছে তখন তার মনে হয়েছে সে তো সামান্য নয়, তার একটি জীবন ছিল। আসন্ন মৃত্যুকে শিয়রে নিয়ে সে উপলব্ধি করে এই বিশ্ব জগৎ বছরের ছয় ঋতু বাইশ বছর ধরে এসেছে আবার চলেও গেছেÑ যাবার বেলায় বার বার বলেছে,
‘খোলরে দুয়ার খোল’। কিন্তু নিরানন্দ এই গৃহকোনের  নাগপাশ ছিঁড়ে সে-বাণী প্রবেশ করতে পারেনি। রান্নাঘরের ধোঁয়া এবং অন্তঃপুরের অন্ধকার কারাগারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে গেছে। নয় বছর বয়সে এ সংসারে এসেছিল, বাইশ বছর ধরে ‘নামিয়ে চক্ষু মাথায় ঘোমটা’ টেনে সবার আবদার মিটিয়েছে, সবাই তাকে বলেছে, লক্ষ্মী সতী ভালো মানুষ অতি। আজ তার যাবার সময় কেবলই মনে হচ্ছেÑ আমি কি শুধু সতী লক্ষ্মী? আর কিছু নই?
‘জানলা দিয়ে চেয়ে আকাশ পানে
 আনন্দে আজ ক্ষণে-ক্ষণে জেগে উঠছে প্রাণে
 আমি নারী, আমি মহীয়সী,
আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎ¯œা বীণায় নিদ্রবিহীন  
আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা/শশী।
মিথ্যা হ’ত কাননে ফুল ফোটা ॥’
সে শুধু জানত ‘রাঁধার পরে খাওয়া আবার খাওয়ার পরে রাঁধা’। সে আজ এই চাকাতে বাঁধা জীবন থেকে মুক্তি নিচ্ছে। মরণের মধ্যে পেতে চাইছে মুক্তি এবং স্বাধীনতার স্বাদÑ এ জীবনে যা সে কোনো দিনই পায়নি। ‘স্বামী কর্তৃক অবহেলিত এই নারী চরম মুহূর্তে উপলব্ধি করিয়া গেল নারী জীবনের সার্থকতা মাতৃত্বে নয়, প্রেয়সীত্বে নয়, পতœীত্বে নয় তাহার সার্থকতার ক্ষেত্র অস্তিত্বের মূলগত ক্ষেত্র নারীত্বে।’
(প্রথম নাথবিশী/রবীন্দ্র সরণ।)
...বিশ শতকের আধুনিকতা, বাংলার সুখ-দুঃখ, হাস্য-পরিহাস, আচার-সংস্কার, ভয়-লোভ-লজ্জা, তার শক্তি, তার ব্যর্থতা প্রায় সবই ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথের এ সময়ে রচিত রচনাবলীতে। পুরুষের নির্বোধ দাম্ভিক আত্মকেন্দ্রিকতা তাও আছে, আছে বালিকা বধূর নিঃশব্দ বেদনা, আছে আত্মবশ আধুনিকতার দীপ্তমূর্তি।
নারী সম্পর্কে উনিশ শতকীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও ছিল। শ্রী প্রিয়লাল দাস লিখেছেনÑ ‘রবীন্দ্রনাথের রমণী প্রেমের সম্বন্ধে বলিবার যদি কিছু থাকে, তাহা হইলে বলিতে হয় যে, এই প্রেমের চিত্রে বাঙালি বাবু প্রেমের পবিত্র মন্দিরে দেবতা সাজিয়া বসিয়া আছেন, আর দারুণ বুভুক্ষায় পীড়িতা বাঙালিনী ক্ষুধাতুর হৃদয় লইয়া দ্বার হইতে ফিরিয়া যাইতেছেন।
‘কেন রে চাস ফিরে ফিরে চলে আয়রে চলে আয়
এরা প্রাণের কথা বোঝে না যে.../হৃদয় কুসুম দলে যায়। বাঙালির মেয়েরা রবীন্দ্রনাথের গীতি কবিতায় কেবল হায় হায় করিয়া কাঁদিয়াই সারাÑ
‘না সজনি না, আমি জানি জানি সে আসিবে না।
এমন কাঁদিয়ে পোহাইবে যামিনী; বাসনা তবু পুরিবে না।
অন্যত্র বলেছেনÑ
‘ওলো রেখে দে, সখি; রেখে দে,/মিছে কথা ভালবাসা!
সুখের বেদনা সোহাগ যাতনা/বুঝিতে পারি না ভাষা/ ...পরের সুখের হাসির লাগিয়া/অশ্রু সাগরে ভাসা।
জীবনের সুখ খুঁজিবারে গিয়া/জীবনের সুখ নাশা/অনুতপ্ত রবীন্দ্রনাথ নিজের মতাদর্শ পরিবর্তনের অঙ্গীকারে লিখেছেনÑ
‘শতবার ধিক্্ আজি আমারে সুন্দরী/ তোমারে হেরিতে চাহি এত ক্ষুদ্র করি। তোমার মহিমা জ্যোতি তব মূর্তি হতে/আমার অন্তরে পড়ি ছড়ায় জগতে। যাহোক, সব মিলিয়ে ‘কল্পনা’ থেকে ‘পলাতকা’ পর্যন্ত রবীন্দ্রকাব্য সাধনায় নারী ভাবনা একটি বিশেষ স্তরে উন্নীত হয়ে ক্রমাগত এগিয়ে গেছে।
কবির ভাষায় ‘পুরবী’ (১৯২৫) যেন ‘বিধবা সন্ধ্যার নীরব অশ্রু মোচন’। তাই ‘পূরবী’তে অস্তরাগ উদ্ভাসিত জীবন শেষে জীবনের স্মৃতিচারণ থাকলেও বাস্তব নারী চিত্র এখানে দুর্লভ। তবে ‘মহুয়া’ (১৯২৯) এর ব্যতিক্রম। এখানে নারী তার অধিকার সম্বন্ধে সচেতন। ‘মহুয়া’ কাব্যের ‘সবলা’ কবিতায় নারী তার স্বাধিকারের প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেÑ
‘নারীরে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার?
হে বিধাতাÑ
যাব না বাসর ঘরে বাজায়ে কিঙ্কিনী
আমারে প্রেমের বীর্যে কর অশঙ্কিনী।’
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গদ্য কবিতায় সার্থকতার পরিচয় দিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘পরিশেষ’ (১৯৩২) কাব্যের ‘বাঁশি’ কবিতায় গদ্য ছন্দে যে নারীকে তুলে ধরলেন সে নারী তার কলমের সোনার পরশে হয়ে উঠল অনন্যা, অসামান্য।
এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধূলি লগ্নে/সেই খানে
বহি চলে ধলেশ্বরী,
তীরে তাল তমালের ঘন ছায়াÑ
আঙিনাতে
যে আছে অপেক্ষা করে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।’
‘পুনশ্চে’র (১৯৩২) সাধারণ মেয়ে শরৎ বাবুকে অনুরোধ করেছে তাকে নিয়ে একটি গল্প লিখতে, সাধারণ মেয়ের গল্প, তাকে পাঠিয়ে দেয়া হোক সমঝদার এবং দরদীদের দেশে। সেখানে তাকে নিয়ে আলোচনা হবে শুধু বিদূষী বলে নয়, নারী বলে। শেষ পর্যন্ত সাধারণ মেয়ে নিজের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। তার মনে হয় কৃপণ বিধাতা তাকে সম্পূর্ণরূপে সৃষ্টি করেননি। সামান্য মেয়ে সৃষ্টি করে বিধাতা শক্তির অপচয় করেছেন। নারী হৃদয়ের এসব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ নারীকে পুরুষের পাশাপাশি এনে দাঁড় করিয়ে স্বাধিকারের স্বপক্ষে তার জোরালো অবস্থান ঘোষণা করেছেন। পুরুষ নিজেই প্রতিজ্ঞার ভাষায় বলছেÑ
‘আমরা দু’জনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরনীতে
মুগ্ধ ললিত অশ্রু গলিত গীতে ॥...
কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয়, তুমি আছ, আমি আছি।
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্নপালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ, আমি আছি।...
এই গৌরবে চলিব এভাবে যতদিন দোঁহে বাঁচি।
এ বাণী, প্রেয়সী, হোক মহীয়সীÑ তুমি আছ, আমি আছি।’

রবীন্দ্র প্রতিভার প্রাথমিক অনুষঙ্গ
এনায়েত আলী বিশ্বাস
পদ্য ও গদ্য রচনার বৈচিত্র্যে রবীন্দ্র সাহিত্য অতুলনীয়। তবুও একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি। তাঁর প্রেরণার উৎস অনেককাল আগ থেকে অনেকেই খুঁজেছেন কিন্তু তাঁর কাব্য রচনার পরমার্থ ও স্তর ভেদ নিয়ে বিচার ও বিশ্লেষণের কিছু অবকাশ রয়েছে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্রগ্রন্থ পরিচয়’ প্রকাশ করে এ বিষয়ে নতুন করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, এবং তিনি তাঁর পরিশিষ্টে কবির শুরুর প্রথম মুদ্রিত কবিতা হিসেবে ‘অভিলাষ’ এর নাম উল্লেখ করেছেন। এটি ১৮৭৪ সালের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যায় যখন এটি ছাপা হয় তখন কবির বয়স ১৩ বছর ৬ মাস। কিন্তু কবিতাটি তার অন্তত এক বছর আগে লেখা। কারণ লেখকের নাম না দিয়ে শুধু দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের রচিত এইটুকু কবিতার সাথে জুড়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কবিতাটি ছাপিয়ে দেন। এছাড়া ১৭৯৭ শকে ‘প্রকৃতির খেদ’ শীর্ষক আর একটা কবিতাও বালকের রচিত বলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ওই পত্রিকায় প্রকাশ করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথই যে রবীন্দ্র প্রতিভার আসল জহুরী ছিলেন সে বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। কবি নিজেও বারবার সে কথা স্বীকার করেছেন। রচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ সেই তরুণ বয়সেই যে দাদার সহকর্মী ছিলেন সেটা জানা যায়। ব্রজেন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জুলাই ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘পূরু বিক্রম’ নাটকে রবীন্দ্রনাথের একটা গান কিছুটা অদলবদল করে জুড়ে দেন। একসূত্রে বাঁধিয়াছি সহ¯্র মন/এক কার্যে সঁপিয়াছি সহ¯্র জীবন/আসুক সহ¯্র বাঁধা বাধুক প্রলয়/আমরা সহ¯্র প্রাণ রহিব নির্ভয়/...। ১৮৭৫ সালের ৩০ নভেম্বর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘সরোজিনী’ নাটকে রবীন্দ্রনাথের ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ-দ্বিগুণ’ গানটি বসানো হয়। রবীন্দ্রনাথের এমন অনেক বেনামী রচনা রয়ে গেছে। ঠিকতম অনুসন্ধান করলে হয়তো বেরিয়ে আসবে। ‘অভিলাষ’ কবিতার মত আর একটি বেনামী কবিতা ড. সুকুমার সেন ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ তৃতীয় সংস্করণ ১৩৪৯, ১২৮০’র মাঘ সংখ্যার ‘বঙ্গদর্শন’ থেকে উদ্ধার করেছেন। প্রকাশের তারিখ অনুসারে এই ‘ভারত ভূমি’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের সর্ব প্রথম প্রকাশিত রচনা বলে হয়ত গণ্য হতে পারে। কবিতাটি যে বছর বঙ্গদর্শনে মাঘ মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ১৮৭৪) ছাপা হয়। সেই ১২৮০ সালের শ্রাবণ সংখ্যায় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বপ্ন প্রয়াণে’ প্রথম সর্গও বঙ্কিমচন্দ্র ছাপেন। এক্ষেত্রে অনুমান করা যায় যে, দ্বিজেন্দ্রনাথই বালক কবি রবীন্দ্রনাথের ‘ভারত ভূমি’ প্রকাশের জন্য বঙ্কিমচন্দ্রকে দিয়েছিলেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ১২ বছর ছিল বলে তার দাদা নিশ্চিত করে জানালেও বঙ্কিমের মন্তব্যে, চর্তুদশ বর্ষীয় বালকের রচনা কি করে ছাপালেন বোঝা যায় না। কয় মাস পরে অভিলাষ ছাপার সময় মেজ দাদা স্পষ্ট দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের উল্লেখ করে গেছেন। এক্ষেত্রে ভারত ভূমি কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের না হয়ে বঙ্কিমের পরিচিত ১৪ বছরের অন্য কোন বালক কবিরও হতে পারে। ভারত ভূমি সম্বন্ধে ড. সুকুমার সেনের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা বঙ্কিমের দ্বারা সংশোধিত হইয়াছিল বলিয়া ইহার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বাড়িয়া গিয়াছে। বঙ্কিম চন্দ্রের সংশোধনের জন্য আমরা দুঃখিত নই, কিন্তু তিনি যে কবিতাটির অংশত ছাটিয়েছিলেন সে জন্য ক্ষোভ হইতেছে। কবিতাটি অসন্দিগ্ধভাবে বালক রবীন্দ্রনাথের বলে প্রমাণ হলে এর মধ্যে পাব বঙ্কিমচন্দ্রের গভীর সহানুভূতি ও অন্তর দৃষ্টির পরিচয়। রবীন্দ্রনাথের সন্ধ্যা সঙ্গীত প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালের ৫ জুলাই। রবীন্দ্রানাথের কবি প্রতিভার সম্পর্কে বঙ্কিম চন্দ্রের অভিব্যক্তিতে একবার তিনি রমেশকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘রমেশ তুমি সন্ধ্যা সঙ্গীত পড়িয়াছ? রমেশচন্দ্র দত্তের কন্যার বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকে বঙ্কিমচন্দ্র যখন এই প্রশ্নচ্ছলে রবীন্দ্রনাথের কাব্যলক্ষ্মীর স্থায়ী প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত করেন তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স বিশ-একুশ। তার আট নয় বছর আগেরকার রচনার মধ্যেও সে প্রতিভার সন্ধান পাওয়া বঙ্কিম ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ বঙ্কিম সে কালের কবিদের কড়া সমলোচকই ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর সম্পাদিত বঙ্গদর্শনে রবীন্দ্রনাথের প্রথম কবিতা ছাপা হওয়ায় তাৎপর্য আরোও নতুন করে বোঝা যায়। ‘ভারত ভূমি’ কাঁচা রচনা হলেও কাব্য সরস্বতী পাদপীঠে শিশু রবীন্দ্রনাথের কচি হাতের প্রথম আল্পনা। সেই সঙ্গে কবির প্রথম দিকের রচনা ‘অচলিত সংগ্রহে’ প্রকাশিত তাঁর কাব্য রচনাগুলো এবং বিশেষ ভাবে মে ১৮৮৪তে ছাপা তাঁর শৈশব সঙ্গীত ও ১৩০৩ সালের কাব্য গ্রন্থাবলীতে ছাপা ‘কৈশোরক’ পড়া উচিত। ১২৯১ সালে ছাপা হলেও শৈশব সঙ্গীতের অধিকাংশ কবিতা ১২৮৪-৮৭ সালে ভারতীতে প্রকাশিত হয় এবং সেগুলো কবির ১৩ থেকে ১৮ বছরের রচনা। রবীন্দ্রনাথকে ছেলেবেলায় বয়সের যে কিছু বড় দেখাত তার প্রমাণ তাঁর এগারো বছর বয়সে পিতার সঙ্গে প্রথম বোলপুর (১২৭৯) হয়ে অমৃতসর পর্যন্ত ট্রেন যাত্রার গল্পের মধ্যে আছে। সুতরাং ১২ বছরে রচিত ভারত ভূমি কবিতাটি চতুর্দশ বর্ষীয় বালকের বলে যে বঙ্কিম গ্রহণ করেন তারও খানিকটা কারণ মেলে।
সে যুগের এসব রচনা অচলিত সংগ্রহে স্থান না পেলেও তাদের সন্ধান করা দরকার। কারণ কবির ৫০ বছরে রচিত জীবনস্মৃতির মধ্যে তিনি নিজে অস্পষ্ট, অথচ মূল্যবান আভাস দিয়ে গেছেন তাঁর শিক্ষারম্ভ অধ্যায়ে। ‘তখনকর, খল প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি “জল পড়ে পাতা নড়ে”। আমার জীবনে এটিই আদি কবির প্রথম কবিতা’। ছন্দ ঋত্বিক রবীন্দ্রনাথের ওপর ছন্দ সরস্বতীর সেই প্রথম আশীর্বাদ। এখনকার কালে যদি পাঁচ বছরে শিক্ষারম্ভ হয়ে থাকে তাহলে ছন্দ বোধের এই প্রথম উন্মেষ দেখি ১৮৬৬-৬৭ সালে। তখন প্রাক-কংগ্রেস যুগের প্রথম জাতীয় আন্দোলন বিখ্যাত হিন্দু মেলার উদ্বোধন চলছে (১২ এপ্রিল ১৮৬৭)। কবির পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ও দাদারা এ আন্দোলনে অগ্রণী। দেবেন্দ্রনাথের অর্থ সাহায্যে হিন্দু মেলার সহ-সম্পাদক নব গোপাল মিত্র ‘ন্যাশনাল পেপার’ ইংরেজি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি’ সত্যেন্দ্রনাথের ‘জয় ভারতের জয়” (১৮৬৮) গণেন্দ্রনাথের ‘লজ্জায় ভারত যশ গাইব কি করে’ রঙ্গলালের ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়রে’ ও হেমচন্দ্রের ‘বিংশতি কোটি মানুষের বাম’ (১২৭৭ এডুকেশন গেজেট ১৭ শ্রাবণের সখ্যায় মুদ্রিত)। ‘ভারত সঙ্গীত’ প্রভৃতি গান ও কবিতা রবীন্দ্রনাথের শৈশব রচনাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তার সন্ধান কবি নিজে দিয়েছিলেন। একেবারে হারিয়ে যাওয়া ছিন্নবিচ্ছিন্ন নীল হাতা বাঁধানো লেট্স ডায়রি নিবন্ধ রচনা ও অধূনা লুপ্ত ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ কাহিনীর মধ্যে। এই বীর রসাত্মক কাব্যটি প্রথম বোলপুর ভ্রমণের ‘তৃণহীন কংকর শয্যায়’ লেখা হয়। কিন্তু কাব্যে হাতেখড়ি হয়েছিল তার ৭-৮ বছরে। অর্থাৎ ১৮৮৮-৮৯ সালে। যখন তাঁর ভাগিনেয় জ্যোতি প্রকাশ হ্যামলেটের উক্তি আবৃতি করতেন ও পয়ার ছন্দে চৌদ্দ অক্ষরে যোগাযোগের রীতি পদ্ধতি রবীন্দ্রনাথকে বুঝিয়ে দিয়ে বাংলা সাহিত্যে এক নব যুগের উদ্বোধন করেন। মধুসূদন সে কালের সাহিত্য গগনে মধ্যাহ্ন সূর্য ও তিনি কবির মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু ও বিলাত প্রবাসের সহযাত্রী। সত্যেন্দ্রনাথের মারফতে আমরা জানি যে, দেবেন্দ্রনাথ মাইকেলের মস্ত সমজদার ছিলেন ও তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু রাজনারায়ণ বসু মাইকেলের সহপাঠী ও সমালোচক ছিলেন। তাই মাইকেলের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে কারণে ভারতীতে নিজ নামে পদ্য ও গদ্য রচনা ছাপার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘনাধ বধ’ কাব্যকে আক্রমণ করেন। মাইকেলের প্রভাব ‘ভারত ভূমি’ কবিতায় স্পষ্ট এবং তারও আগে মেজদাদা শিশু কবির রচনা নবগোপাল মিত্রকে শুনিয়েছিলেন। তখন ভ্রমরকে অবজ্ঞাভরে তাড়িয়ে কবি দ্বিরেক প্রয়োগে গর্বিত। সুতরাং ভারত ভূমি কবিতার ‘পুরন্দর’ শব্দের সঙ্গে ক্ষপাকর মেলান রবীন্দ্রনাথেরও কীর্তি হতে পারে, অথবা বঙ্কিমের?
ভাগিনেয় যখন হেমলেট আবৃতিতে মত্ত তার কিছু কালের মধ্যে ম্যাকবেথ নাটকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হওয়া অসম্ভব নয়। কারণ তাঁর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ আজীবন সেক্সপিয়ার ভক্ত এবং প্রায় ৮০ বছর বয়সেও তাঁকে হ্যামলেট আবৃতি করতে শুনা গেছে। উত্তর ভারত ভ্রমণ শেষ করে রবীন্দ্রনাথ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তিনি আনন্দ চন্দ্র বেদান্তবাগিশের পুত্র জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে ‘কুমার সম্ভব’ ও ম্যাকবেথ পড়তেন। শুধু তাই নয় (১৮৭৩-৭৪) সালে ম্যাকবেথ বাংলা ছন্দে তর্জমা না করা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের গুরু তাকে ঘরে বন্দি করে রাখতেন। সেই অনুবাদের কিছু অংশ কবির সংস্কৃত অধ্যাপক রাম সর্বস্ব প-িত বিদ্যাসাগর মহাশয়কে শোনান। তখন রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় তার কাছে ছিলেন। এই অনুবাদের খ-িত অংশ মাত্র রক্ষা পেয়েছে। ভারতী ১২৮৭ আশ্বিন থেকে তা সজনীকান্ত দাস উদ্ধার করেন। অভিলাষ কবিতার ২৪ থেকে ৩১ পদগুলোতে তার ছায়া দেখা যায়।
ভারত ভূমি কবিতার সঙ্গে যোগ হয়েছে এ কালের তাঁর স্বাক্ষরিত ও অধূনা সুপরিচিত অন্য দু’একটা রচনায় ১৮৭৫ ফেব্রুয়ারিতে পঠিত ও প্রকাশিত ‘হিন্দু মেলার উপহার’ ও ১৮৭৭ ডিসেম্বর হিন্দুমেলার দ্বিতীয় কবিতা ‘লিটন দরবার’ উপলক্ষে। এ সম্বন্ধে ব্রজেন্দ্রনাথ তার ‘রবীন্দ্রগ্রন্থ পরিচয়ে’ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ও যতিনাথ ঘোষ জ্যোতিরিন্দ্রের ‘স্বপ্নময়ী’ নাটকে (১৮৮২) একটা কবিতার সঙ্গে এর ভাবগত মিল দেখিয়েছেন। এসব রচনার মধ্যে হেমচন্দ্র ও রঙ্গলালের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। হিন্দু মেলার প্রথম ফেব্রুয়ারি ১৮৭৫ ও দ্বিতীয় ডিসেম্বর ১৮৭৬ কবিতার মাঝখানে আরও একটি মূল্যবান কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। ‘প্রকৃতির খেদ’ ‘তত্ত্ব বোধিনী’ পত্রিকায়  আষাঢ় ১৮৭৫ জুন-জুলাই ছাপা হয় অভিলাষ কবিতাটি। কবিতাটি ছাপার আট মাস পরে ‘অভিলাষ’ ৩-৪ পদে, যেমন ‘ভারত ভূমি’র ছাপ কতকটা বহন করছে। তেমনি, ‘প্রকৃতির খেদ’ অনেক জায়গায় রবীন্দ্রনাথের ‘বনফুল’ কাব্যোপন্যাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বই হিসাবে ১৮৮০’র নয় মার্চে প্রকাশিত হলেও বনফুলের কবিতাগুলো ১৮৮২-৮৩ সালে শ্রীকৃষ্ণদাস সম্পাদিত ১২৭৮ আরম্ভ ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ ও ‘প্রতিবিম্ব’ পত্রে প্রকাশিত হয়। হিন্দু মেলার প্রথম স্বাক্ষরিত কবিতা প্রকাশেরর সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স তের বছর নয় মাস এবং ‘প্রকৃতির খেদ’ ছাপার সময় তাঁর বয়স চৌদ্দ বছর দুই মাস ছিল। এই কবিতাটির ভাব ও ভাষার সাহায্যে ‘বনফুল’ (১২৮২) ও ‘কবি কাহিনী’ ১২৮৪ যেন এক নতুন রূপে দেখা যায়। এছাড়া ১২৮৪ শ্রাবণে ‘ভারতী’ পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কবির ছদ্ম নামে ‘ভানু সিংহের পদাবলী’ প্রথম কিস্তি  সাতটি পদ ছাপা হয়। তার প্রায় পাঁচ বছর আগে (১২৭৯-৮০) সারদা চরণ ও অক্ষয় সরকার প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ প্রকাশ করেন এবং সেটি কবির লোভের সামগ্রী হয়েছিল সেকথা তিনি তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখে গেছেন। মৈথিলী ভাষায় বিদ্যাপতি পাঠ ও ‘কৃত্রিম’ ব্রজবুলিতে ভানু সিংহ রচনার জের অনেককাল রবীন্দ্রনাথ টেনেছেন তার প্রমাণ মেলে। বৈষ্ণব পদাবলীর ঝংকার তাঁর কাব্যে ও গানে কি নতুন রস দিয়েছে এবং মৈথিলী ব্রজবুলির চর্চা থেকে শব্দতত্ত্বের নেশা তাকে কেমন করে পেয়ে বসেছিল তার আলোচনা আরো দরকার। তাঁর কাঁচা বয়সের কিছু পদ্য অনুবাদ লুকিয়ে আছে অনেক গদ্য প্রবন্ধের মধ্যে। ১৮৮৫ ‘ভারতী’ পত্রিকায় দান্তে ‘ওবিয়েতিচ’ প্রবন্ধে এবং এংলো সাকসন ও এংলো ন¤œান সাহিত্যের আলোচনায় কিছু কিছু পদ্য অনুবাদ পাওয়া যায়। ২০ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮ রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিলাত যাত্রা করেন। তখন হয়ত তাঁর প্রথম ছাপা বই ‘কবি কাহিনী’র ফাইল তাঁর হাতে ছিল। ওই সময়ে পাওয়া যায় তাঁর একটা গান ‘জয় জয়ন্তী’ যেটি স্বদেশীযুগে বহুদিন ধরে আদৃত হয়েছিল, ‘তোমারি তরে মা সঁপিনু দেহ/তোমারই তরে মা সঁপিনু প্রাণ’। এগান স্মরণ করিয়ে দেয় বিদেশ যাত্রার সময় মধুসূদনের ‘রেখ মা দাসেরে মনে’। অথচ ১২৮৪তে ভারতীতে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘনাদ’ সমালোচনা। এবং তারও দু’বছর আগে জ্ঞানাঙ্কুর (১২৮২) পত্রে ভুবন মোহিনী প্রতিভার বিশ্লেষণ। সুতরাং, পদ্যে ও গদ্যে রবীন্দ্র প্রতিভা ছেলেবেলায় যে আত্মপ্রকাশ করেছিল সেকথা মনে রেখে এসব কাঁচা লেখা গুলো ধৈর্য্যরে সাথে নতুন করে পড়া দরকার।
যে মুলোটা বাড়ে তার পাতা দেখলে যেমন বোঝা যায়, তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে একজন বড় কবি হবেন তার প্রমাণ ছেলে বেলাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বার বছর বয়সের একটা কিশোর তার মধ্যে কবি হওয়ার যে বাসনা তা সত্যিই আমাদের মুগ্ধ করে। এর মূলে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা অপরিসীম। রবীন্দ্র পরিবার সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গণে সে সময় সারা বাংলায় বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। সে প্রভাবে রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত হয়েছিল নিঃসন্দেহে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু আমাদের স্বভাব আমরা একটি প্রস্ফুটিত ফুলকে দেখে খুশি হই, তার সুবাস নিতে উদগ্রীব হই, কিন্তু বুঝতে চাইনা একটা পূর্ণ বিকশিত ফুল হতে হলে তাকে কত কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে আসতে হয়। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এটা সুস্পষ্ট। যদিও তাঁর ছেলেবেলার সাহিত্য সাধনার কথা এখনও অনেকের কাছে অজ্ঞাত প্রায়। সময় এসছে রবীন্দ্র প্রতিভা বিকাশের। দরকার আরো একটু চেষ্টা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রবীন্দ্রকাব্যে নারীভাবনা
আরও পড়ুন