Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিশু-কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যা বাড়ছে কেন

| প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৮ এএম

বেঁচে থাকার ইচ্ছা ও আকুলতা মানুষের চিরন্তন সহজাত প্রবণতা। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার উদগ্র বাসনায় মানুষ কীই না করে! কিন্তু এর একটি ব্যতিক্রমী চিত্রও আছে। প্রিয়জনের স্নেহের বন্ধন, সুন্দর পৃথিবীর মায়া ও সুখী জীবনের স্বপ্ন ত্যাগ করে এক শ্রেণীর মানুষ ক্রমবর্ধমান হারে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষত: তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার এই প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এক ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্বেগের জন্ম হচ্ছে। সম্প্রতি বৃটিশ সরকার এই সমস্যা মোকাবেলায় নতুন মন্ত্রনালয় গঠন করেছে এবং আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে সামাজিক উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারী উদ্যোগে কাউন্সিলিংয়ের পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে একেক দেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা একেক রকম হওয়ায় দেশে দেশে তরুণ ও শিশু-কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির কারণও ভিন্ন হতে বাধ্য। দারিদ্র্য, সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চনা এবং ঋণের বোঝা নিয়ে হতাশ হয়ে প্রতি বছরে ভারতে হাজার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করে। কিন্তু বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ ভিন্নতর। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম নামের একটি সংগঠনের দেয়া তথ্যে জানা যায়, গত ১১ মাসে বাংলাদেশে ২৯৩ শিশু আত্মহত্যা করেছে এবং আরো ২২জন আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ২০১৩জন আর ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ২০১৮ সালের প্রায় অর্ধেক। এখানে শুধু শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যার সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশে আত্মহত্যার সংখ্যা আরো অনেক বেশী। আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে শুধু একটি জীবনের অস্বাভাবিক পরিসমাপ্তি ঘটেনা, তাকে ঘিরে একটি পরিবারের সুন্দরও স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে।
গত রবিবার রাজধানী ঢাকার ভিকারুননিসা নুন স্কুলের নবমশ্রেনীর ছাত্রী অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনা দেশের শিক্ষাবিদ, সমাজ গবেষক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সামনে একটি নতুন প্রশ্ন তুলে ধরেছে। অরিত্রির আত্মহত্যার ঘটনা একদিকে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিশু-কিশোরদের মনোদৈহিক অবস্থা এবং এর পেছনে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভ‚মিকার প্রচ্ছন্ন যোগসুত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। গত ১০ বছরে একদিকে সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়, অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে গেছে অন্যদিকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নানামাত্রিক অনৈতিক প্রবণতা ও সংকট ভর করেছে যা স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের মধ্যে মনস্তাত্তি¡ক প্রভাব সৃষ্টি করছে। গত অক্টোবর মাসে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত আয়োজিত এক সেমিনারে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে দেশের ১৮ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে ভুগছে। শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অসচেতনতা এবং বিশেষ মুহূর্তে তাদের চাহিদা ও প্রবণতার প্রতি বেখেয়াল থাকার কারণে কারো কারো মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত শতকরা ১৮ভাগ শিশু-কিশোরের কর্মদক্ষতা কমে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য, সৃজনশীলতা এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির প্রতি লক্ষ্য রেখে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় মানুষের জাগতিক চিন্তা-চেতনায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে চলেছে। পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষার অনুপস্থিতি, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সম্প্রীতি ও মেলবন্ধনের ক্ষেত্রগুলো সংকুচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির মধ্যে যে একরৈখিক আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতার জন্ম হচ্ছে তা থেকেই অপরাধ প্রবণতা, মাদকাসক্তি এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ফেইসবুক, ইউটিউবের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি কিশোর-তরুণদের আসক্তি এই প্রজন্মের মধ্যে অবাস্তব কল্পনা, হতাশা ও আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া কিছু গেইম এবং অ্যাপে কিশোর-কিশোরীদের সরাসরি আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করতেও দেখা গেছে। এসব বিষয়ে অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা কারিকুলাম প্রণেতাদের নতুনভাবে ভাবতে হবে। পারিবারিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় করা এবং সন্তানদের মানসিক চাহিদা ও স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিতে হবে। সব ধর্মবিশ্বাসেই আত্মহত্যা মহাপাপ। ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের অনৈতিক স্বার্থের চর্চা ,সন্ত্রাস , রাজনৈতিক দলবাজি, ক্ষমতার অপপ্রভাব প্রভৃতি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব সৃষ্টি করছে। শিশু-কিশোরদের মানসিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়া, মাদকাসক্ত হওয়া, বিদেশমুখীহওয়া ও আত্মহত্যা করার প্রবনতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে যে সব সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ দায়ী তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য, শিক্ষাবাণিজ্য ও প্রাতিষ্ঠানিক হয়রানি বন্ধের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসার উদ্যোগ এবং কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিশু

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন