পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইংরেজিতে একটি কথা আছে। সেটি হলো Preparation is half the battle.অর্থাৎ সঠিক প্রস্তুতি থাকলে যুদ্ধের অর্ধেক বিজয় লাভ ঘটে। সেই ফর্মুলা মনে হয় আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনে প্রয়োগ করছে। বছর খানেক আগে থেকেই এই ইলেকশনে জয়লাভ করার জন্য আওয়ামী লীগ নানাভাবে তৎপর। জেলজুলুম, মামলা-মোকদ্দমা এগুলো তো এক বছর ধরে চলছিলোই। তারা বাজিমাত করতে চেয়েছে নমিনেশন পেপার যাচাই-বাছাইয়ে। নমিনেশন পেপার বাছাইয়ের পর নমিনেশনের তথা প্রার্থীদের যে চেহারা বেরিয়েছে সেটি দেখে বুদ্ধিজীবীরাতো দূরের কথা, সাধারণ মানুষেরও আক্কেল গুড়–ম। একথা কল্পনাতেও আসে না যে বিএনপির ৮১ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল। অর্থাৎ বিএনপির ৮১ জন প্রার্থী ইলেকশনে দাঁড়াতে পারছেন না। মনোনয়ন পত্র যখন যাচাই-বাছাই হয় তখন ঋণ খেলাপিসহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল কারণে দুই-চার জন প্রার্থী বাদ পড়ে যান। কিন্তু তাই বলে একেবারে ৮১ জন প্রার্থী বাদ পড়বেন সেটি একেবারে অবিশ^াস্য ব্যাপার। এর বিপরীতে আমরা যদি আওয়ামী লীগের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাচ্ছে, তার একজনের নমিনেশনও বাতিল হয়নি। বিএনপির ৮১টি নমিনেশন বাতিল হয়, আর আওয়ামী লীগের একটিও হয় না, এটি কি কোনো অবস্থায় বিশ্বাসযোগ্য? বিএনপির প্রার্থীরা কি সব গÐমূর্খ?
বগুড়া-৭ আসনে বেগম খালেদা জিয়াকেই শুধু বাতিল করা হয়নি, সেখানে তার দুই জন ব্যাক-আপ ক্যান্ডিডেট মোর্শেদ মিল্টন এবং সরদার বাদলকেও বাতিল করা হয়েছে। দুই জনের নামেই অভিযোগ এই যে, তারা দুইটি উপজেলার চেয়ারম্যান, কিন্তু তারা চেয়ারম্যানের পদ ত্যাগ না করে জাতীয় সংসদ পদে দাঁড়িয়েছেন। পক্ষান্তরে ঐ দুই প্রার্থী দৃঢ়তার সাথে বলছেন যে, তারা যথাযথ নিয়ম মেনেই পদত্যাগ করেছেন। তারা উভয়েই তাদের প্রার্থীতা বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য ঢাকা এসেছেন। এছাড়া বেগম জিয়া ফেনীর একটি আসনে নমিনেশন পেপার দাখিল করেছিলেন। তার ৩টি আসনের নমিনেশন পত্রই বাতিল হয়েছে। বিগত দিনগুলিতে আওয়ামী লীগ যে রকমভাবে ইলেকশন কমিশনের ঘাড়ে চেপে বসেছে তার ফলে বেগম জিয়ার নমিনেশন বাতিল হবে, এটা ধরেই নেওয়া হয়েছিল। সেজন্য বগুড়ার একটি আসনে তার জন্য মিল্টন এবং সরদার বাদল নামের দুই উপজেলা চেয়ারম্যানকে ব্যাক-আপ ক্যান্ডিডেট হিসাবে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এই আসনে আওয়ামী লীগকে ঢুকানোর জন্য মিল্টন এবং বাদল উভয়ের নমিনেশনই বাতিল করা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে যে, বেগম জিয়ার নমিনেশন পেপারের সাথে সাথে মিল্টনের নমিনেশন পেপারও বাতিল করা হয়েছে। তার অর্থ হলো, সেখানে বিএনপি বা ২০ দল বা ঐক্যফ্রন্টের কোনো প্রার্থী নাই। সেখানে এখণ আওয়ামী লীগের ফাঁকা মাঠে গোল। বগুড়াতে আওয়ামী লীগের দাঁত ফুটানোর জায়গা নাই। তাই খালেদা জিয়া এবং তার ব্যাক-আপ ক্যান্ডিডেটকে বাতিল করে আওয়ামী লীগ সেখানে মাথা গলানোর সুযোগ করে নিলো। বগুড়ার আর একটি আসনে ভাগ্যিস বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে ব্যাক-আপ ক্যান্ডিডেট করা হয়েছিল। তাই আওয়ামী লীগ সেখানে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারছেনা।
যেভাবে প্রার্থীতা বাতিল করা হয়েছে তাতে মনে হয় যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বেছে বেছে হিসাব করেই প্রার্থী বাতিল করেছে। যারা বাতিল হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা মীর নাসির উদ্দিন, জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি এবং মির্জা আব্বাসের পতœী বেগম আফরোজা আব্বাস, নব্বইয়ের গণ আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা এবং কেরানীগঞ্জের সাবেক এমপি বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান, রাজশাহী বিএনপি নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশিষ্ট শিল্পপতি মোর্শেদ খান, মীর নাসির উদ্দিনের পুত্র মীর হেলাল উদ্দিন, বিএনপির সক্রিয় নেতা ও কর্মী মোস্তফা কামাল পাশা, ঢাকা দক্ষিণের সংগ্রামী নেতা নবিউল্লাহ নবী, উত্তরবঙ্গের সংগ্রামী নেতা এবং বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। এছাড়াও যারা বাদ পড়েছেন তারা হলেন বিএনপির প্রাক্তন নেতা এবং চরম সুবিধাবাদি ব্যরিষ্টার নাজমুল হুদা, বিএনপির মাঠের লড়াকু নেতা আসলাম চৌধুরী , আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে সদ্য আগত প্রাক্তন সংসদ সদস্য গোলাম মওলা রনি, বোমা হামলায় নিহত আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী এবং ঐক্যফ্রন্টে সদ্য আগত জনাব কিবরিয়ার পুত্র রেজা কিবরিয়া, জাতীয় পার্টিতে নমিনেশন বাণিজ্যের জন্য তোপের মুখে পড়া মহাসচিব রুহুল আমিন তালুকদার, চিত্র নায়ক, প্রযোজক ও পরিচালক জাতীয় পার্টির নেতা সোহেল রানা, সেলিম ভূঁইয়া প্রমুখ। এছাড়াও চট্টগ্রামে আব্দুল লতিফ জনি, খুলনা বিভাগে বিএনপি থেকে পদত্যাগকারী এবং বিকল্পধারায় যোগদান কারী অধ্যাপক নাজিমুদ্দিন আল আজাদ, রাজশাহী বিএনপির শাহাদত হোসেন, মতিউর রহমান মন্টু, জাতীয় পার্টির সাহাবুদ্দিন বাচ্চু, বিএনপির আব্দুল গফুর, নাদিম মোস্তফা প্রমুখ।
দুই
নমিনেশন বাতিলের মাধ্যমে বিএনপির প্রতি সবচেয়ে বড় আঘাত হানা হয়েছে ৬টি নির্বাচনী এলাকার সমস্ত ক্যান্ডিডেটকে বাতিল ঘোষণা করে। এই ৬টি নির্বাচনী এলাকা হলো বগুড়া-৭, ঢাকা-১, মানিকগঞ্জ-২, রংপুর -৫, শরিয়তপুর-১ এবং জামালপুর-৪। এছাড়া সিরাজগঞ্জের সাবেক মন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং বিএনপি নেতা জাফরুল ইসলাম চৌধুরী। ইংরেজি ডেইলি স্টার গত ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ রিপোর্ট করেছে যে, ঢাকার রিটার্নিং অফিসার ঢাকা-৭ থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হাজী মোহাম্মদ সেলিমের মনোনয়ন পত্র গ্রহণ করেছেন। হাজী সেলিম ২০০৮ সালে ১৩ বছরের সাজায় দন্ডিত হন। তিনি আপিল করলে ২০১১ সালে তার দন্ড বাতিল হয়। কিন্তু ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ দুর্নীতি দমন কমিশনের হাইকোর্টের রায় নাকচ করে দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নি¤œ আদালতের রায় বহাল রাখেন। অর্থাৎ হাজী সেলিমের দন্ডাদেশ বহাল থাকে। হাজী সেলিমের মতো বিএনপি নেতা ইকবাল আমান, মীর নাসির এবং তার পুত্র হেলাল উদ্দিন এদের সকলকেই ২০০৮ সালের মামলায় বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। অনুসন্ধান করে দেখা যাচ্ছে যে, নাদিম মোস্তফা ছাড়াও মুন্সিগঞ্জের মইনুল ইসলাম শান্তকেও কারাদন্ড দেওয়া হয়। বিএনপি নেতা মরহুম নাসির উদ্দিন পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তারকেও কারাদন্ড দেওয়া হয়। মেজর আখতারুজ্জামান বেশ কয়েক বছর আগে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন। অনেক দিন ধরেই তিনি চেষ্টা করছিলেন বিএনপিতে ফিরে আসতে। কিন্তু এবার বৃহত্তর ঐক্যের খাতিরে এবং আওয়ামী লীগকে মোকাবেলার স্বার্থে মেজর আখতারকে একজন শক্তিশালী প্রার্থী বিবেচনা করে বিএনপি তাকে নমিনেশন দেয়। তার প্রতিদ্ব›িদ্ব ছিলেন অবসর প্রাপ্ত পুলিশের আইজি নূর মোহাম্মদ।
তিন
সরকারের ডিজাইন সম্পর্কে আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছি। এই সরকার ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করছেনা। তাদের একমাত্র বিবেচনা যে কোনো মূল্যে এই নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়া। সেই ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান অন্তরায় ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। তাকে যে কোনো মূল্যে নির্বাচনী দৃশ্যপট থেকে দূরে রাখতে হবে। এজন্য শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারই তার বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা দায়ের করেছে। খালেদা জিয়ার ইলেকশন থেকে দূরে রাখার জন্যই দুইটি মামলায় ১৭ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে এবং তাকে কারাগারে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। এসব কথা সকলেই জানেন। সর্বশেষ বিএনপির ৮১জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করে সরকার ইলেকশনে জেতার পথকে নিষ্কন্টক করছে। সরকারের একটির পর একটি বেআইনী এবং জবর দস্তি মূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিএনপি শুধুমাত্র লিপ সার্ভিস অর্থাৎ বিবৃতি অথবা সংবাদ সন্মেলনে বক্তব্য দেওয়া ছাড়া আর কিছু করেনি। এর ফলে আওয়ামী লীগ তাদেরকে অত্যন্ত দুর্বল ভেবেছে এবং তাদেরকে সাইজ করার জন্য মামলা, হামলা এবং রিমান্ডকে প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে। আওয়ামী লীগের এই প্রচন্ড দমননীতি প্রাথমিক ভাবে তাদেরকে ডিভিডেন্ড দিয়েছে। প্রাথমিক সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে সরকার বিএনপির বিরুদ্ধে অল আউট দমনীতির পথে গেছে। সেটি করতে গিয়ে তারা নির্বাচন এবং নির্বাচনী তফসিলের তোয়াক্কা করছে না।
চার
নির্বাচনের আর মাত্র ২৬ দিন বাঁকি আছে। এতদিন পর্যন্ত বিএনপি যখন কোনো দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি তখন এই ২৬ দিনে তারা রাজপথ প্রকম্পিত করতে পারবে এমন আশা করা দুরাশা। কারণ তার নেতাকর্মীরা সকলেই নির্বাচন করার জন্য মফস্বলের দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়বে। এর মধ্যেও যদি লেভেল প্লেইং ফিল্ডের দাবিতে বিএনপি দুর্বার গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে তাহলে সেটি হবে সোনায় সোহাগা। আর যদি সেটি না পারে তাহলে তাদেরকে একটি কাজ অবশ্যই করতে হবে। আর সেই কাজটি হলো দুই প্রকার। একটি হলো ভোরের আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে বিএনপির সমস্ত কর্মীকে ছোট ছোট গ্রæপে ভাগ করে বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি পাঠাতে হবে। পুরুষ মানুষদেরকে তো বলবেই, বিশেষ করে ঘরের গৃহিণী এবং অন্যান্য মহিলাকে সাথে করে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে। ঘর থেকে তাদেরকে ভোট কেন্দ্রে আনার পথে বাধার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এখানে প্রয়োজন হবে তাদের সাহস। সরকারী দলের বাধাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তাদেরকে ভোটারের কাফেলা সহ কেন্দ্রে আসতে হবে।
কেন্দ্রে আনার পর হবে তাদের দ্বিতীয় অগ্নি পরীক্ষা। প্রতিটি কেন্দ্রে তাদেরকে পাহারা দিতে হবে। একথাটি বলছেন কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল, আসম রব এবং মাহমুদুর রহমান মান্না। একটি ভোটও যাতে কারচুপি না হয় তার জন্য বিএনপির ভলান্টিয়ারদের সজাগ থাকতে হবে। সরকার পক্ষ যেন গায়ের জোরে পোলিং এজেন্ট এবং অন্যান্য নির্বাচনী কর্মকর্তাকে ইনফ্লুয়েন্স করে ভোট আদায় করতে না পারে সেটি নিশ্চিত থাকতে হবে। শেষ পর্যায় হলো গণনা। প্রতিটি পোলিং এজেন্ট এবং পোলিং অফিসারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, গণনা যেন সঠিক হয়। এসব কাজ করতে পারলে সরকার পক্ষ যতই পুলিশ বা বিজিবির সাহায্য নিক না কেন জয় তাদের সুনিশ্চিত হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।