Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড

| প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

নির্বাচনী মাঠে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’। দেশে-বিদেশে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল তো বটেই প্রায় সব মহলের অভিমত, আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে এখন পর্যন্ত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে কিছু নেই। প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বত্রই ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের দিক থেকেও ক্ষমতাসীন দল এগিয়ে। অন্যদিকে বিরোধী দলের সম্ভাব্য প্রার্থী এবং নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার হয়ে কোট-কাচারিতে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে হচ্ছে। কোনো কোনো প্রার্থীকে জেলেও পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আসন্ন নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাজ্যের সংসদের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্স গত বৃহস্পতিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করা হয়েছ, বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি সবার সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড-এর ধারে-কাছেও নেই। এখানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিচ্ছে। আর বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন তীব্রই রয়ে গেছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিয়মের প্রতি সার্বিক আস্থার মাত্রা তলানিতে রয়ে গেছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমান সুযোগ নিশ্চিতের বিষয়টি অনেক দূরে। বলার অপেক্ষা রাখে না, হাউস অব কমন্স-এর এ প্রতিবেদন আমলে না নিলেও দেশের সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে ধরনের পরিবেশ বলবৎ থাকা দরকার তা এখন পর্যন্ত হয়নি। নির্বাচন কমিশন এ কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রায় দুই বছর আগে থেকেই নির্বাচন কমিশন দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সংলাপের আয়োজন করেছিল। সংলাপে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করতে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাবসহ সব দলের জন্য সমান সুযোগের সুপারিশ করেছিল। নির্বাচন কমিশন তাদের সেসব সুপারিশ নোট করে তার সারমর্ম জনগণের সামনে তুলে ধরার কথা বলেছিল। শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, কমিশন তা করেনি। ফলে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আয়োজিত সংলাপটি যে এক ধরনের ‘লোক দেখানো’ ছিল, তা এখন প্রতিষ্ঠিত এবং জনমনে এ ধারণা বদ্ধমূল যে, কমিশন সরকারের ইশারা-ইঙ্গিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশ প্রকাশ করেনি। সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করেছে। জনমনের এ ধারণা থেকে কমিশন এখন পর্যন্ত বের হতে পারেনি। এ পরিস্থিতির মধ্যেই প্রধান বিরোধী দল ও জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। অথচ এর কৃতিত্ব নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। গত সপ্তাহে সিইসি বলেছেন, নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করায় তিনি সন্তুষ্ট। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন তার অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এখানে নির্বাচন কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই। তবে যেহেতু নির্বাচন কমিশনের কোনো ধরনের উদ্যোগ ছাড়াই প্রধান বিরোধী দল ও জোট নির্বাচনে এসেছে, তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে সব দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টিতে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা। দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে আসায় কমিশন যেন অনেকটা ক্ষমতাসীন দলের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দল বিভিন্নভাবে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। উল্টো কোনো কোনো কমিশনার সাফাই গেয়ে বলে দিচ্ছেন, নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘিত হয়নি। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দলের উপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরও বেশি চড়াও হয়েছে। গ্রেফতার থেকে শুরু করে রিমান্ডে যেমন নিচ্ছে, তেমনি অনেক প্রার্থীকে জামিন বাতিল করে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। নির্বাচনের এ সময়ে বিরোধী দলের প্রতি এ ধরনের আচরণ খুব বেশি দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিরোধী দলের প্রতি সরকার বিগত বছরগুলোতে যে আচরণ করেছে, নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাই করে চলেছে। বলা হচ্ছে, পুরনো মামলায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব মামলায় গ্রেফতারের বিষয়টি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বা নির্বাচন শেষে কি করা যেত না? নির্বাচনের এ সময়টিতেই কেন করা হচ্ছে? যে বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে সিইসি আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন, তিনি কি বিরোধী দল ও জোট যাতে নির্বাচনে অংশগ্রণ করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি না হয়, তা নিশ্চিত করতে পারেন না? বিরোধী দল-জোট তো প্রায় প্রতিদিনই নির্বাচন কমিশনে গিয়ে তাদের বিভিন্ন দাবী ও অভিযোগ লিখিতভাবে জানাচ্ছে। এসব দাবী ও অভিযোগের সবগুলোই যে আমলে নিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আবার একেবারে কোনোটিই আমলে নেয়া হবে না, এটাও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিরোধী দল ও জোটের মূল দাবীর মধ্যে অন্যতম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনে রদবদল করা। তাদের এ দাবী যে অযৌক্তিক তা বোধসম্পন্ন কেউ অস্বীকার করবে না। কারণ বিগত দশ বছরে প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে ব্যাপক দলীয়করণের অভিযোগ হয়েছে। এমন দলয়করণকৃত প্রশাসন নিয়ে নিরপেক্ষ ও প্রভাবহীন নির্বাচন হবে, তা কেউই আশা করে না। অথচ নির্বাচন কমিশন বিরোধী দল ও জোটের এ দাবী তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, প্রশাসনে কোনো রদবদল হবে না। কারও বিরুদ্ধে ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ’ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ’ তদন্ত করতে করতে দেখা যাবে নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের কথা যে একপাক্ষিক এবং সরকারের অনুকূলে, তা কারো বুঝতে বাকি থাকে না। নির্বাচন কমিশনের এমন আচরণের অর্থই হচ্ছে, সে সরকারের সাজানো-গোছানো প্রশাসনে হাত দিতে চায় না, বা তার সেই হিম্মত নেই। এতে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড-এর বিষয়টি এখন পর্যন্ত দিল্লী দূরস্ত হয়েই আছে।
‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে যে আগামী নির্বাচন অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এতে দেশ এক গভীর সংকটে পড়বে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমর্যাদা ভুলুন্ঠিত হবে। দেশ রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাবে। হাউস অব কমন্সের প্রতিবেদনেও এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ব্যতীত নির্বাচন হলে নির্বাচনী প্রচারকালে বা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপর সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা শুরু হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে আগামী নির্বাচন যে আন্তর্জাতিক মহলে বিশ্বাসযোগ্য হবে না, এমন আশঙ্কায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কোনো পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কমনওয়েলথ থেকেও পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়। অর্থাৎ আগামী নির্বাচনটি যে গ্রহণযোগ্য হবে বা নির্বাচন কমিশন তা গ্রহণযোগ্য করতে পারবে-এমন বিশ্বাস দেশ ও বিদেশের কোনো মহলেই এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন সৃষ্টি আশ্বস্থ করতে পারেনি। আমরা মনে করি, এটি নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা নিয়ে নির্বাচন হলে তার দায়দায়িত্ব পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের ওপরই বর্তাবে এবং দেশ রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার কবলে পড়লে তার দায় এই কমিশনকেই বহন করতে হবে। কাজেই নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, দায় এড়ানোর বক্তব্য না দিয়ে বিষয়গুলো আমলে নিয়ে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন