শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
একজন মানুষের স্বপ্নের সাথে যখন অগণিত মানুষের স্বপ্ন মিশে যায়, তার চিন্তা কৃতকর্মের মাঝে যখন মানুষ আশার আলো দেখতে পায়, তখনই তিনি কিংবদন্তী হয়ে উঠেন। আর এই রুপাবয়বেই বিশ্ববাসী গুন্টার গ্রাসকে দেখতে পায় তার সমগ্র সৃষ্টিকর্মের মাঝে। গুন্টার গ্রাসের পুরো নাম গুন্টার ভিলহেলম গ্রাস। জন্ম পোল্যান্ডের বন্দর নগরী ডানজিগে ১৯২৭ সালের ১৬ অক্টোবর। পিতা-মাতার দ্বিতীয় সন্তান। পিতা ছিলেন মুদি দোকানদার। মা ডকের (জাহাজের) রাঁধুনী। গ্রাস ছিলেন কাশুবিয়ান আদিবাসী। গ্রাস দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ডানজিগে (বর্তমান দানস্ক, পোল্যান্ড) তার শৈশব অতিবাহিত করেন। পোল্যান্ডের ৬০ ভাগ লোক জার্মান ভাষাভাষী। মাত্র ১৪ বছর বয়সে জার্মান ভাষী হওয়ার জন্য মে ১৯৪৫ সালে তাকে হিটলারের যুব নাৎসি বাহিনী ভাপেন এস এস-এ যোগ দিতে হয়। ধরা পড়েন মিত্র বাহিনীর (আমেরিকার) হাতে। ২ বছর সংশোধন কারাগারে থেকে উপলব্ধি করেন কী সাংঘাতিক অপরাধ করেছেন। তারপর যেখানেই অমানবিকতা, যুদ্ধ সেখানেই সোচ্চার হন তিনি। একজন স্টোনম্যাসন এবং ভাস্কর হিসাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির পর, তিনি ১৯৫০ এর দশকে লেখালেখি শুরু করেন।
গ্রাস তার প্রথম উপন্যাস দ্য টিন ড্রাম (১৯৫৯) এর জন্য সারা পৃথিবীতে পরিচিতি পান, যা একটি ইউরোপীয় জাদু বাস্তবতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখণী। টিন ড্রামের জার্মান নাম ‘রেখস্ট্রোমেল’। প্রকাশের সাথে সাথে জার্মানীসহ ইউরোপে বইটির বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অপবাদ উঠে। টিন ড্রামের বিরুদ্ধে সমালোচনা মুখর ছিলেন জার্মান ক্রিটিসিজমের গুরু বলে খ্যাত মার্সেল রাইখ রুনিস্কিই। তিনি প্রচার করেন বইটি হাফ পর্নো। কিন্তু এত সমালোচনার ভেতরেও বইটির প্রচারে বাঁধা তৈরী করতে পারেনি। এর জনপ্রিয়তা স্পর্শ করে সারা পৃথিবীর মানুষের হৃদয়। পাঠ্য হয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্য টিন ড্রাম নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত্ত হয়, যা ১৯৭৯ সালে পাম ডি’অর এবং সেরা বিদেশী চলচ্চিত্রের জন্য একাডেমি পুরষ্কার অর্জন করে। গ্রাসের মোট উপন্যাস ১০টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দ্য টিন ড্রাম (১৯৫৯), ক্যাট এ্যান্ড মাউস (১৯৬১), ডগ ইয়ারস (১৯৬৩), দ্য র্যাট (১৯৮৬), মাই সেনসরি (১৯৯৯)।
২য় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পাঠকের মন মানসিকতা গ্রাস আমূল পাল্টে দিয়েছেন। কী গল্পে, কী উপন্যাসে, কী ছায়াছবি, কী ভাস্কর্যে কিংবা চিত্রকলায়। তার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস টিন ড্রামে তিনি কৌতুক, বিস্ময়, প্রতিবাদ ও হিউমারের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন জার্মানীর যুদ্ধ অভিজ্ঞতাকে। গুন্টার গ্রাসের বক্তব্য হচ্ছে সভ্যতাকে ধরে রাখা যায়না, সে সামনের দিকে এগোতে থাকে এবং কখন ও কখনও সে পুরোনো ধারায় প্রত্যাবর্তন করে।
গুন্টার গ্রাস (১৯২৭- ২০১৫)
১৯৮৬ সালের ৩ ডিসেম্বর গুন্টার গ্রাস কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। ছিলেন একসপ্তাহ। কোলকাতায় তিনি চারমাস ছিলেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ঢাকার সাথে কলকাতার পার্থক্য কী? গ্রাস বলেছিলেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখতে পাও, ওরা দেখতে পায় না’। ঢাকায় বেড়ানোর সময় কবির সার্বক্ষনিক গাইড ছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী। ঘুরে বেড়িয়েছেন পুরনো ঢাকা, লালবাগ কেল্লা, রায়ের বাজারের কুমোড় পাড়া, অহসান মঞ্জিল, শাঁখারী বাজার, মোহাম্মদ পুরের জেনেভা ক্যাম্প, সোনার গাঁর পানাম নগর। সদর ঘাটের ভাসমান রেস্তোরাঁতেও খেয়েছেন তিনি। দ্বিতীয় বার ঢাকায় আসেন ২০০১ সালে। বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাবার পর বাংলাদেশ ও কোলকাতায় তার ভ্রমন নিয়ে একটি বই লিখেন তিনি। বইটির নাম ‘মাই ব্রোকেন লাভ: গ্রন্টার গ্রাস ইন ইন্ডিয়া এ্যান্ড বাংলাদেশ’। বইটি সম্পাদন করেছিলেন জার্মান লেখক ও গবেষক মারটিন ক্যাম্পচেইন। বইটি জার্মানী এবং ইংল্যান্ডে প্রচুর বিক্রি হয়েছিল।
পুঁজিবাদের শোষনে ক্লিন্ন ও ক্লিষ্ট তৃতীয় বিশ্বের মানুষের অধিকার আদায়ে রাজপথে সরব ছিলেন গ্রাস। গ্রাস স্বপ্ন দেখতেন তরুনদের নিয়ে। তরুনরাই আশার বানী শোনাবে। বয়স্ক লোকদের তিনি পঙ্গু ও নপুংশক বলে রায় দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক নের্তৃত্ব আজ সেই পঙ্গু ও নপুংসক লুম্পেনদের হাতেই। তাদের উপর চেপে বসে আছে বিদেশী পরাশক্তির অদৃশ্যহাত। এই সা¤্রাজ্যবাদী পরাশক্তির উপর গুন্টার গ্রাসের ক্রোধ নানাভাবে বিস্ফোরিত হয়েছে তার বিভিন্ন লেখায়, বিশেষ করে তার স্বপ্নময় ভাষণে। পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। আমাদের দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা আত্মসম্প্রসারণে তৎপর পুঁজিবাদের উলঙ্গ সেবাদাস। গ্রাস জানতেন ওয়েস্টমিনিস্টার মার্কা গণতন্ত্রের ভেলকি দেখিয়ে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় না।
হাইনরিশ ব্যোল ১৯৭২ সালে যখন নোবেল পুরস্কার পাবার খবর পেলেন, তখনই তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, গুন্টার গ্রাসের খবর কী? ১৯৬৭ সালে হান্স ভেরনার রিখটার প্রতিষ্ঠিত ‘গ্রæপ-৪৭’ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জার্মান সাহিত্যে নবতরঙ্গ দান করে। এই গ্রæপের অন্য কয়েকজন লেখক কবি নোবেল পেলেও, সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত গুন্টার গ্রাসের কপালে তখন ও নোবেল জোটেনি মূলত তার বিশ্বাসগত ও আদর্শিক কারনে। গ্রাস একসময় সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিলেন, ছিলেন সক্রিয় রাজনীতিক। পরে রাজনীতি থেকে দূরে সরে দাঁড়ান। তারপর ও মানবসভ্যতার বিপর্যয়, ভয়াবহ ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কঠোর ভাষায় সতর্ক করে দিতে ভোলেন নি। মানুষের লাগামহীন লোভ, যুদ্ধ, বিপন্ন পরিবেশ, মূল্যবোধের বিপর্যয় তাঁকে ক্ষিপ্ত করে। রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার পর তার নোবেল প্রাইজ আর ঠেকায়কে? ১৯৯৯ সালে গুন্টার গ্রাস সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান। সুইডিশ একাডেমি তাকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়ার সময় বলেছে, ‘ভুলে যাওয়া অতীতকে পূনরুদ্বারের এক অপূর্ব ক্ষমতা তার লেখায় মুর্ত হয়ে উঠেছে।
পূর্ব ও পশ্চিমের বিভেদ, বৈষম্য, ধনতন্ত্রের সাথে কমুনিজমের দ্ব›দ্ব অতি সুনিপূন ভাবে তার লেখায়, কবিতায় উঠে এসেছে। বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তী মানবতাবাদী, সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী সোচ্চার কন্ঠস্বর গুন্টার গ্রাস ১৩ এপিল ২০১৫ সালে জার্মানীর লুবেক শহরে মৃত্যু বরণ করেন। পৃথিবীর দেশে দেশে, মানুষে মানুষে আজ যে বৈষম্য, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে মানুষের যে নিঃস্পেষণ, মানবতা যে করুন চাহনী নিয়ে ধুকে ধুকে মরছে, এই দু:সময়ে গুন্টার গ্রাসের সৃষ্টিকর্ম আমাদেরকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগাবে। বেঁচে থাকুন গুন্টার গ্রাস।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।