পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ততই প্রশ্ন উঠছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে তো বটেই, দেশের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রতিদ্বিদ্বতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য করার পথে অনেকগুলো পর্বতপ্রমাণ বাধা রয়েছে। প্রথম বাধা হলো, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। আমরা দেখেছি যে, গত পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে মামলা, গ্রেফতার ও হয়রানির মাধ্যমে সরকার তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘরছাড়া করেছে, যাতে তারা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে না পারে। এর মাধ্যমে তথাকথিত ‘খুলনা মডেলে’র নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি এ ধরনের দমন-পীড়ন ও হয়রানিতে নতুনমাত্রা যুক্ত হয়েছে।’ এদিকে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার জন্য কমিশন (ইসি) সচিব, জনপ্রশাসন ও পুলিশের ৯২ জন কর্মকর্তার প্রত্যাহার চেয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, এসব কর্মকর্তা ক্ষমতাসীন দলের অনুগত ও বিতর্কিত। গত বৃহস্পতিবার পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় জেলার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সুপারদের (এসপি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে বদলি বা প্রত্যাহার আতঙ্ক কাজ করছে। এই আতঙ্ক নিয়ে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। এ প্রেক্ষিতে, ইসি সঙ্গে সঙ্গে তাদের আশ্বস্ত করে বলেছে, আতঙ্কের কিছু নেই। বদলি করা হবে না।
নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বহু আগে থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক জোট, দল এবং নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কথা বলা হচ্ছে। তারা নির্বাচন কমিশনকে দৃঢ় হয়ে তাদের উপর অর্পিত সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্যবহার করে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য ক্রমাগত আহ্বান। তবে এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কোনো ভ্রুক্ষেপ বা বোধোদয় হয়েছে বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে না। বরং তার আচরণে একপক্ষীয় মনোভাব প্রকাশিত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রশ্ন উঠলে বা লিখিতভাবে অভিযোগ দাখিল করলে, নির্বাচন কমিশন বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবে বলে বক্তব্য দিয়েই দায় সারছে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকা কমিশনে তুলে ধরলেও কমিশন তা আমলে নেয়নি। এমনকি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তার নিজের করা তদন্ত প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। যেখানে নির্বাচন কমিশনের একজন কমিশনারের তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নেয়া হয় না, সেখানে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে বা করবে, এমন আশা করা বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয়। বলা বাহুল্য, নির্বাচন কমিশনকে বরাবরই তার নিরপেক্ষতা নিয়ে ‘লিপ সার্ভিস’ দেয়া ছাড়া তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনী প্রচার সামগ্রী অপসারণের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। নির্বাচনী প্রচার সামগ্রী সরিয়ে নেয়ার আল্টিমেটাম দেয়া সত্তে¡ও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সেগুলো বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন যেখানে এ কাজটুকু করার সক্ষমতা দেখাতে পারেনি, সেখানে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে এবং অনিয়ম ও বাড়তে থাকবে তারা কি তা সামাল দিতে পারবে? নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেখে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, কমিশন এখনো সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ীই চলছে। তা নাহলে, পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে বরাবরই দলীয়করণের অভিযোগ উঠলেও নির্বাচন কমিশন কেন তাতে কোনো ধরনের রদবদলের ব্যবস্থা নিচ্ছে না? উল্টো পুলিশের পক্ষ থেকে বদলি আতঙ্ককে আমলে নিয়ে তাদের বদলি করা হবে না বলে আশ্বস্ত করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পুলিশ রাষ্ট্রের বাহিনী। এ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যকে প্রয়োজন অনুযায়ী যেখানেই বদলি করে দায়িত্ব দেয়া হবে, সেখানেই সে কাজ করতে বাধ্য। তাদের মধ্যে, কেন বদলি আতঙ্ক কাজ করবে? নির্বাচন কমিশন কি সাধারণ এ বিষয়টি বুঝতে পারে না? যে পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ প্রায় প্রত্যেক মহল থেকে উঠেছে, সে বাহিনীর রদবদল করলে নির্বাচন কমিশনের কী ক্ষতি হয়ে যাবে? বরং নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে রদবদল করলে তা সব মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সাধারণভাবে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীতে রদবদলের বিষয়টি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই ধরে নেয়া হয়। তা না করে কমিশন রদবদল না করতে কেন পুলিশের আবদার রক্ষা করছে? এটাতো সবাই জানে, সরকারের দীর্ঘ প্রায় দশ বছর শাসনকালে প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক দলীয়করণ হয়েছে। এ অবস্থায় সরকার ক্ষমতায় থেকে যখন জাতীয় নির্বাচন করছে, তখন প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা নিরপেক্ষ হবে, তা একজন অতি সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে না। নির্বাচন কমিশন এই সাধারণ বিষয়টি বুঝে না, তা মনে করার কারণ নেই। বলা যায়, কমিশন বুঝে শুনেই সরকারের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে যে কয়টি উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে মূর্তির মতো, নির্বাচন কমিশন সচিবের এমন মন্তব্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। নির্বাচন কেন্দ্রে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ এবং টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এসব উদ্যোগকে পর্যবেক্ষরা মনে করছেন, বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মী ও পর্যবেক্ষকদেরকে অনেকটা হাত-পা বেঁধে সাতার কাটার মতো পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে, তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সক্ষম, তবে এমন বিধিনিষেধ আরোপের কোনো কারণ থাকতে পারে না। এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের যে আচরণ, তাতে এটাই বিলক্ষণ মনে হচ্ছে যে, কমিশন সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারছে না বা করছে না। কোনো অভিযোগ উঠলে তা খতিয়ে বা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেই খালাস হয়ে যাচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে- এমন আশা করা কঠিন। আমরা মনে করি, আগামী জাতীয় নির্বাচন দেশ ও জাতির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনটি যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হয় এবং দেশ গভীর সংকটে পড়ে, তবে এর পুরোপুরি দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে। আশা করি, বিষয়টি উপলব্ধি করে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনকে সব মহলে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে এখনই উদ্যোগী হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।