পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সত্তর এবং আশির দশক ছিলো বাংলাদেশের ফুটবলের স্বর্ণযুগ। খেলা বলতে তখন সবাই ফুটবলকেই বুঝতো। সে সময় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও আবাহনী ক্রীড়া চক্রের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। এই দুই দলের খেলার দিন ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) তিল ধারণের জায়গা থাকতো না। তো ওই সময় যখন খেলোয়াড়দের দল বদলের প্রক্রিয়া শুরু হতো, তখন সবাই উৎসুক থাকতেন কোন খেলোয়াড় কোন ক্লাবে যাচ্ছে তা জানার জন্য। কোন খেলোয়াড়ের দাম সবচেয়ে বেশি উঠলো তাও থাকতো আলোচনায়। সালাম মুর্শেদী, বাদল রায়, কায়সার হামিদ, ফজলু কে কোন ক্লাবে যাচ্ছে, কাকে কোন ক্লাব কত অফার করেছে এসব নিয়ে অলোচনা তর্ক-বিতর্ক হতো। এখন ঢাকাই ফুটবলের সে অবস্থা নেই। তার জায়গা দখল করেছে ক্রিকেট। অবশ্য আজকালকার তরুণরা দেশীয় না হলেও বিদেশি ফুটবল বেশ উপভোগ করে। ইংলিশ কিংবা স্প্যানিশ লীগের কোন টিমের কোন খেলোয়াড় কোন টিমে গেল তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে তারা মুহূর্তেই জেনে যাচ্ছে।
যাক, ফুটবল-ক্রিকেট খেলোয়াড়দের দল বদল এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। খেলোয়াড়দের দল বদল একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তারা টাকার জন্য একটি দলে চুক্তিবদ্ধ হয় এক মৌসুমের জন্য। পরের মৌসুমে যে ক্লাব টাকা বেশি দেয় তারা সে ক্লাবের জার্সি গায়ে চড়িয়ে মাঠে নামে। এখানে আদর্শ বা কমিটমেন্টের কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে যখন ক্লাবের মতো দল বদলের ঘটনা ঘটে, তখন সচেতন মানুষদের চিন্তা হয় সঙ্গত কারণেই। কেননা, রাজনীতি এক মৌসুম বা এক বছরের চুক্তি ভিত্তিক কোনো খেলা নয়। এখানে প্রধান বিষয় নীতি-আদর্শ। যে যেই দলই করেন, তিনি সে দলের নীতি-আদর্শে পরিপূর্ণ আস্থা রেখেই করেন।
তারপরেও রাজনীতিতে দলবদলের ঘটনা নজিরবিহীন বা অস্বাভাবিক নয়। মাঝে মধ্যেই নানা কারণে নেতাদের দল বদল করতে দেখা যায়। এসব দল বদলে যে আত্মস্বার্থ প্রধাণ কারণ হিসেবে কাজ করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য দল বদলকারী নেতারা বলে থাকেন যে, মতের মিল না হওয়ায় এবং দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের স্বার্থে তিনি বা তারা পূর্বতন দল ত্যাগ করে নতুন দলে যোগ দিয়েছেন। দল ত্যাগের সাথে সাথে তাদের আদর্শও পরিবর্তিত হয়ে যায়। আগে যিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুজারি, তিনি বনে যান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের তত্ত¡ প্রচার করতে করতে যিনি এতোদিনে কয়েক টন ঘাম শরীর থেকে ঝরিয়ে ফেলেছেন, তিনি হয়ে যান বাঙালি জাতীয়তাবাদের কট্টর সমর্থক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যিনি পিতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন, তিনি তখন জিয়াউর রহমানকে তার আদর্শিক নেতা হিসেবে মাথায় তুলে নাচতে শুরু করেন। উল্টো পিঠে যিনি জিয়াউর রহমানকে তার জীবনের একমাত্র আদর্শ বলে উচ্চকণ্ঠে প্রচার করতেন তিনি চোখের পলকে হয়ে যান বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত। এ যেন ভোজবাজীর খেলা। চোখের পলকে নীতি-আদর্শ সব পাল্টে যায়, বদলে যায় রাজনৈতিক গন্তব্য। শ্রদ্ধা নিবেদনের স্থানও যায় বদলে! ফুলের তোড়া হাতে এতদিন যিনি গিয়েছেন ক্রিসেন্ট লেকের উত্তর পাড়ে, তিনি ছুটতে থাকেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার দিকে।
এরশাদের জমানায় এসব ঘটনা ঘটেছে এন্তার। দু’টো ঘটনার উল্লেখ করছি এখানে। বিক্রমপুরের এক আওয়ামী লীগ নেতা, যিনি দলটির সহ-সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটে তথ্যমন্ত্রী ছিলেন, ঢাকার এক জনসভায় তিনি এরশাদের বিরুদ্ধে কঠিন বক্তৃতা দিলেন একদিন। উপস্থিত জনতা বাহ্হা দিল আর বললো, এমন নেতা থাকলে এরশাদ বেশিদিন গদীতে থাকতে পারবেন না। কিন্তু দেখা গেল, তিনিই আওয়ামী লীগে থাকলেন না। বিকালে এরশাদকে বকলেন, রাত আটটার বিটিভির খবরে দেখা গেল তিনি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন! আরেকজন, তিনি ছিলেন সুনামগঞ্জেরে লোক। তির্যক বক্তৃতা দিয়ে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি। বায়তুল মোকাররমের সামনের রাস্তায় সাত দলীয় ঐক্যজোটের এক জনসভায় তিনি তুলোধুনো করলেন এরশাদকে। দুই কি তিন দিন পর সবাই দেখলো তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভার একটি আসনে উপবেশন করে আছেন। যে দু’জনের কথা বললাম, তারা এখন ইহজগতে নেই। তাই তাদের নাম উল্লেখ করলাম না। সে সময় কোনো নেতাকে এরশাদের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তৃতা করতে শুনলেই অনেকের মনে সন্দেহ জাগতো, তিনি শিগগিরই মন্ত্রী হয়ে যাবেন নাতো! এ ধরনের দল বদল একেবারে অভিনব নয়। নানা কারণে একেকজন দলবদল করে থাকেন। তবে, সে কারণগুলোর মধ্যে আত্মস্বার্থই মুখ্য। দেশ ও জাতির স্বার্থ গৌণ।
এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দল বা জোট বদলের যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে, এমনটি আগে কখনো ঘটেনি। কতিপয় রাজনৈতিক নেতা যেন লজ্জা-শরমের মাথা খেয়েই পক্ষ বদল করছেন। কেউ কেউ আজীবন যে নীতি আদর্শের অনুসারী ছিলেন এবং যে আদশের্র বাণী প্রচার করতেন, তিনি এবার গিয়ে অবস্থান নিয়েছেন সে আদর্শের একেবারে বিপরীত মেরুতে। অবস্থান বা রঙ বদলের ক্ষেত্রে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রেকর্ড ভাঙার চেষ্টাও অনেককে করতে দেখা যাচ্ছে। এবার এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি গত কয়েক মাসের মধ্যে দুইবার তার অবস্থান বদল করে ফেলেছেন। প্রথমে যুক্তফ্রন্ট নিয়ে শামিল হলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন প্রক্রিয়ায় এবং ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর সব কথাবার্তা বললেন। কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে তার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের দুই শরিক দলকে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হবার পর তিনি নিজেকে পাল্টে নিলেন। ওই ইস্যুতে তার দল বিকল্পধারাও ভেঙে গেল। তারপর তিনি কয়েকটি ভগ্নাংশ দল নিয়ে আবার যুক্তফ্রন্ট সচল করলেন। তারপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে গিয়ে তিনি যা করে এলেন তা দেখে মানুষ হতবাক। তিনি সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে রাজী বলে ঘোষণা করলেন। এরপর দেখা গেল যুক্তফ্রন্ট আর তার চিন্তাভাবনায় নেই। তিনি তার দলের জন্য নিদেনপক্ষে দুইটি আসন পেতে দেন দরবার করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে। অথচ এই তিনি এবং তার পুত্র বিএনপির সাথে ঐক্য করার শর্ত দিয়েছিলেন তাদেরকে দেড় শ’ আসন দিতে হবে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, দেড় শ’ আসন চাওয়া বিকল্পধারার মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে সাকুল্যে এক শ’ ৩৭টি। সরকারবিরোধী অবস্থান থেকে ডা. বি. চৌধুরীর সরকারের পক্ষে নেয়া এই অবস্থান দেশবাসীকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিয়েছে। একদা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবক্তা বি. চৌধুরী এখন কী করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মঞ্চে কথা বলবেন অনেকেই তা ভেবে পাচ্ছেন না। বি. চৌধুরীর এ পক্ষ বদলের মধ্যে আদর্শগত কোনো বিষয় আছে, এটা কেউ বিশ্বাস করেন না।
নির্বাচনকে সামনে রেখে এই যে পক্ষ বদল, এটাকে সহজভাবে নিতে পারছেন না অনেকেই। সচেতন মানুষদের কথা হলো, একজন মানুষ এতদিন একটি আদর্শকে অনুসরণ করে আসার পর হঠাৎ তার আদর্শ বদলায় কী করে? নীতি আর আদর্শ পরিবর্তনের এ ম্যাজিক আজ দেশবাসীকে রাজনীতি বিমুখ করে তুলেছে, রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি কমিয়ে দিয়েছে শ্রদ্ধা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, একমাত্র তাকে ছাড়া আওয়ামী লীগের সবাইকেই কেনা যায়। কথাটির গুরুত্ব বলে বোঝানোর দরকার নেই। ওয়ান-ইলেভেনের সময় এর প্রমাণ দেশবাসী পেয়েছে। সে সময় সংস্কারের জার্সি গায়ে দেয়ার প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছিলেন বড় দুই দলের মহাসচিব, প্রেসিডিয়াম সদস্য, স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ ছোট-বড় নানা সাইজের নেতা। সুতরাং শেখ হাসিনা আর বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া আর সবাই যে নানা কারণে বিক্রি হয়ে যেতে পারেন তা অবিশ্বাস্য নয়।
রাজনীতিকদের অবস্থান বা দল বদল সম্পর্কে দেশের বিশিষ্টজনেরা যেসব মন্তব্য করেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। তারা মনে করেন, দেশের রাজনীতি থেকে নীতি আদর্শ বিতাড়িত হয়েছে, এটা তারই প্রতিফলন। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে হবে, সংসদ সদস্য হতে হবে, এটিই আসল কথা। তাদের মতে রাজনীতিবিদদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। নেই নিজের ওপর আস্থা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও অনুসারিদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া, এটা বুর্জোয়া রাজনীতি। এখানে কোনো আদর্শ নেই। এদের লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া, ক্ষমতার ভাগ নেওয়া। এ রাজনীতি অন্তঃসারশূন্য।’ বিশিষ্ট লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রে বিভিন্ন দলের জোট করা স্বাভাবিক রীতি। সব দল একই নীতি আদর্শে বিশ্বাসী হবে তাও নয়। রক্ষণশীলদের সঙ্গে বামপন্থীরাও থাকতে পারে। কিন্তু আজীবন যে দলের বিরুদ্ধে ছিল, একটি দু’টি আসন পাবার আশায় সেখানে শুধু যাচ্ছে না, নিজের প্রতিষ্ঠিত দলের সমালোচনায়ও মুখর। এতে নেতাদের চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। আদৌ কারো কোনো নীতি আছে কি না মানুষ বুঝতে পারছে না।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, রাজনীতিতে যে শেষ কথা বলে কিছু নেই, এটা তারই প্রতিফলন। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে হবে, সংসদ সদস্য হতে হবে। ক্ষমতায় গেলে, সংসদ সদস্য হলে অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়।’
বিশিষ্টজনদের উপরোক্ত অভিমত থেকে রাজনৈতিক নেতাদের সাম্প্রতিক দল বা জোট বদলের অন্তর্নিহিত কারণটি আর অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ- এ জাতীয় মুখরোচক ও চিত্তাকর্ষক বাণী তারা ইথারে ছড়িয়ে দিলেও মূল কারণটি যে রাষ্ট্রক্ষমতার মেওয়া হাতে পাওয়া তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।